২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের যাবতীয় আশঙ্কা সত্যি করে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। ভ্লাদিমির পুতিনের সিদ্ধান্তে পূর্ব ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা।
সে দিনের পর কেটে গিয়েছে আস্ত একটি বছর। রাশিয়া, ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনও থামেনি। বিশ্ব এগিয়েছে তার চেনা ছন্দে। কেবল ইউরোপের এক কোণে জীবনের তাল কেটেছে বার বার।
রাষ্ট্রপুঞ্জ সমর্থিত পরিসংখ্যান বলছে, রাশিয়া, ইউক্রেনের এই যুদ্ধে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত ৭ হাজার ১৯৯ জন ইউক্রেনীয় নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছে অন্তত ৪০০ শিশু। সশস্ত্র যোদ্ধা থেকে শুরু করে নিরীহ সাধারণ মানুষ, যুদ্ধ কাউকে রেয়াত করেনি।
রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধে হতাহত এবং ক্ষতির কোনও নিশ্চিত পরিসংখ্যান মেলে না। ইউক্রেন সরকার অন্তত ১৬ হাজার নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে। কেউ কেউ আবার বলেন ইউক্রেনে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে ৩০ হাজারের গণ্ডি।
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের বলি হয়েছেন দুই দেশের প্রায় ৩ লক্ষ যোদ্ধা। ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, এই লড়াইয়ে রুশ বাহিনীর ২ লক্ষ সৈনিক নিহত হয়েছেন। ইউক্রেনের ১ লক্ষের বেশি সেনা মারা গিয়েছেন যুদ্ধে।
যুদ্ধের কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বহু সাধারণ মানুষ। ইউক্রেন থেকে গত এক বছরে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শরণার্থী সংখ্যা বেড়েছে ইউরোপের অন্য দেশগুলিতে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, শিল্প ও বাণিজ্যের কাঠামো এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে ইউক্রেনে।
ইউরোপের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ইউক্রেন এই মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। আয়তনের বিচারে রাশিয়ার পরেই তার স্থান। ইউক্রেনের তিন দিকের সীমান্তেই রয়েছে রাশিয়া। ছবির মতো সাজানো দেশটি যুদ্ধের প্রতিঘাতে ছারখার হয়ে গিয়েছে।
যুদ্ধ চলাকালীন ইউক্রেনের যে ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। কোথাও বিলাসবহুল বাড়ি বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, কোথাও ঝকঝকে সেতু ভেঙে হয়েছে ধূলিস্যাৎ।
কিভ, খারকিভ, মারিওপোল, খেরসন— সর্বত্র ছবিটা একই। খারকিভের এক স্কুলের প্রিন্সিপাল তাঁর স্কুলের আগের এবং পরের ছবি প্রকাশ করেছেন সমাজমাধ্যমে। তাতে দেখা গিয়েছে হালকা হলুদ রঙের স্কুলবাড়ি গুলি এবং বোমার ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত। স্কুলের ছাদ ভেঙে পড়েছে। ধুলো, ছাই, আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে স্কুলের কাঠামো। তাকে স্কুল বলে আর চেনা যায় না।
সাজানো বসতবাড়ি, তাকে ঘিরে থাকা গাছগাছালি ঝলসে গিয়েছে যুদ্ধের তেজে। চার দিকে কেবল ভেঙে পড়া পাথরের চাঁই, তুবড়ে যাওয়া গাড়ি আর তার মাঝখান থেকে উঁকি মারছে এক সময়ের নিখুঁত কোনও বহুতলের ভাঙাচোরা কাঠামো।
বিধ্বস্ত শহরের আগের রূপ এবং যুদ্ধের দাপটের পরবর্তী ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনবাসী। চেনা শহরের স্মৃতি হাতড়ে তাঁরা বার বার অভিশাপ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে।
এক সময় ছবির মতো সাজানো ছিল কিভের লেনিন স্ট্রিট। শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই জনবহুল এলাকায় যেন শ্মশানের নীরবতা। রুশ বাহিনীর আক্রমণে ঝলসে গিয়েছে লেনিন স্ট্রিটের প্রায় সমস্ত বাড়ি। কোনওটিই আর বাসযোগ্য নয়।
ইউক্রেনের একটি জিমের আগের এবং পরের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। মসৃণ মেঝেতে পর পর সাজানো ছিল শরীরচর্চার নানা উপকরণ। রুশ আক্রমণের পরে সাজানো যন্ত্রপাতি সব তছনছ হয়ে গিয়েছে। ভাঙা দেওয়াল, ছাদের পলেস্তারা খসে মেঝেতে ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়েছে। জিমে আর পা ফেলার জায়গা নেই কোথাও।
এক সময় শহরের যে এলাকায় নিয়মিত জমে উঠত গানবাজনার আসর, রুশ আক্রমণের পর সে সব অতীত। যুদ্ধের শহরে শুধুই মৃত্যুমিছিল। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বন্দুকধারী রুশ সেনাদের দেখা মেলে। কোথাও দেখা যায় আহতদের স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসার খোঁজে।
ইউক্রেনের একটি টাওয়ারকে যুদ্ধের ধ্বংসলীলার মাঝেও মাথা তুলে থাকতে দেখা গিয়েছে। বাসিন্দারা সেই ছবি দেখিয়ে সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, রাশিয়ার দু’টি শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র এই টাওয়ারকে টলাতে পারেনি।
ড্রোনচিত্রে ধ্বংসের ছবি যেন আরও ভয়াবহ রূপে ধরা দিয়েছে। উঁচু থেকে যে শহরের দিকে তাকালে সবুজে চোখ জুড়িয়ে যেত, যুদ্ধ সেখান থেকে সবুজের অস্তিত্বই মুছে দিয়েছে। গাছগাছালি, সবুজ মাঠ ধূলিস্যাৎ। কালো ধোঁয়া, ভাঙাচোরা বাড়িঘরের স্তূপ দেখা যায় ড্রোনের মাধ্যমে তোলা ছবিতে।
যুদ্ধ ইউক্রেনের আকাশকেও যেন ঢেকে দিয়েছে বিষাক্ত বাষ্পে। কিভ, খারকিভে এখন নীল আকাশের দেখা মেলা ভার। বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাগুলিতে প্রায় সর্ব ক্ষণ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে ইউক্রেনের আকাশ। বাসিন্দারা কেউ আপনজন হারিয়েছেন। কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বছর ঘুরে গিয়েছে। যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্তি চাইছেন সাধারণ মানুষ।