গোদের উপর বিষফোঁড়া! ‘ড্যানিয়েল’ ঝড়ের জেরে ভারী বৃষ্টি। এমনিতেই জলমগ্ন ছিল উত্তর-পূর্ব লিবিয়া। তার মধ্যেই জলের চাপে ভেঙে পড়ল দু’টি বাঁধ। তার জেরে ইতিমধ্যে প্লাবিত এলাকায় বাড়ল জলস্তর। মারা গেলেন হাজার হাজার মানুষ। নিখোঁজ তারও কয়েক গুণ। আস্ত শহর এখন শূন্য। কাদাজলে ঢেকে গিয়েছে জনপদ। দেখে মনে হবে ‘ভূতুড়ে’!
লিবিয়ায় আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অফ রেড ক্রসের প্রধান তামের রমদান জানিয়েছেন, বন্যায় মারা গিয়েছেন অন্তত ২০০০ জন। নিখোঁজ ১০ হাজার।
পূর্ব লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওথমান আবদুলজলিল জানিয়েছেন, দেশের পূ্র্বে ডারনা শহরেরই ৬০০০ মানুষ নিখোঁজ।
সোমবার ডারনা শহর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আব্দুলজলিল। অবস্থা দেখে শিহরিত মন্ত্রী। তিনি জানালেন, ডারনা এখন ‘ভূতুড়ে শহর’।
আব্দুলজলিল বলেন, ‘‘শহরের এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ। বহু মানুষ এখনও প্লাবিত ঘরে বন্দি। না খেয়ে দিন কাটছে তাঁদের। ধসের নীচে চাপা পড়ে রয়েছে আরও কয়েকশো দেহ। অনেকেই ভেসে গিয়েছেন সমুদ্রে।’’
মন্ত্রী জানালেন, শুধু ডারনা, বেনগাজি নয়, লিবিয়ার উত্তর-পূর্বের বহু শহর ভেসে গিয়েছে। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী গ্রামগুলির প্রায় কোনও অস্তিত্বই নেই। কোনও কোনও গ্রামে হাতে গুনে কয়েক জন হয়তো বেঁচে রয়েছে।
লিবিয়ার পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দুই প্রশাসনের মধ্যে বছরের পর বছর সংঘাত চলছে। সে কারণে ব্যাহত হয়েছে উদ্ধারকাজ।
গত সপ্তাহে নিম্নচাপ বলয়ের কারণে গ্রিসে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ক্রমে ভূমধ্যসাগরের দিকে এগোতে থাকে সেই নিম্নচাপ বলয়। তার পর শক্তিশালী হয়ে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। একে বলে মেডিকেন।
এই ঝড় ক্রমেই লিবিয়ার দিকে এগোতে শুরু করে। রবিবার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ে উপকূলীয় শহর ডারনা এবং লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজির উপর। ডারনার এক বাসিন্দা আহমেদ মহম্মদ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমরা তখন ঘুমোচ্ছিলাম। গোটা শহর তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম ভাঙতেই দেখি বা়ড়ির চারপাশ দিয়ে জলের স্রোত বইছে। সে কী ভয়ঙ্কর স্রোত! সেই জল ১০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছ গিয়েছিল। আমরা বেরোনোর চেষ্টা করেও পারিনি। শেষে বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিই।”
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, এই ভারী বৃষ্টির কারণে ডারনাতেই মারা গিয়েছেন অন্তত ৩০০ জন। সেখানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, ত্রাণ এবং উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়েছে।
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যবদ্ধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ ডিবেইবা জানিয়েছেন, ১৪ টন ত্রাণ সমেত একটি বিমান বেনগাজিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বন্যাবিধ্বস্ত ডারনাতে এখনও ত্রাণ পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
লিবিয়া জাতীয় সেনাবাহিনী (পূ্র্ব)-র মুখপাত্র আহমেদ মিসমারি জানিয়েছেন, জলস্রোতের চাপে পূর্ব লিবিয়ায় ওয়াদি ডারনা নদীর উপর দু’টি বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। তার জেরে ভেঙে পড়েছে দু’টি সেতু।
বাঁধের জল ঢুকে প্লাবিত পাহাড় ঘেরা ডারনা শহর, যা রয়েছে সমুদ্রের উপকূলে। মিসমারি জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না লিবিয়া। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও তেমন ভাবে ছিল না। ফলে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে।
শুধু ডারনা বা বেনগাজি নয়, ‘ড্যানিয়েল’-এর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে আল-বায়দা, আল-মার্জ, তোবরুক, বাতাহ-র মতো বেশ কিছু শহর। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ডারনা এবং বেনগাজির।
২০১১ সালে শাসক মুয়াম্মর গদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দেশবাসী। পতন হয় সরকারের। নেপথ্যে ছিল ন্যাটো বাহিনী। তার পর থেকে পূর্বে বেনগাজিকেন্দ্রিক প্রশাসন এবং পশ্চিমে ত্রিপোলিকেন্দ্রিক প্রশাসনের মধ্যে বিরোধ চলছে। তার প্রভাব পড়েছে বন্যাবিধ্বস্ত পূর্ব লিবিয়ার উদ্ধারকাজে।