Ram Baboo

১০০ দিনের কাজে মজুরি খাটতেন এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জজয়ী, রাম বাবুর কাহিনি যেন সিনেমার মতো

সদ্যসমাপ্ত এশিয়ান গেমসের পর রাম বাবুর নতুন পরিচয়— তিনি পদকজয়ী অ্যাথলিট। বাণিজ্যসফল সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই যেন গতি বদলেছে তাঁর জীবন!

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
লখনউ শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৩ ১১:১৯
Share:
০১ ২২

দিনমজুরি করে সংসার চালান বাবা। সংসার টানতে কখনও ঘরে তৈরি ক্ষোয়া বিক্রি করেন মা। যে ছেলের স্বপ্নপূরণে উদয়াস্ত খাটুনি মা-বাবার, উত্তরপ্রদেশের সেই রাম বাবু লকডাউনের সময় ১০০ দিনের কাজে মজুরি খেটেছেন। তবে সে সবই এখন অতীত।

০২ ২২

সদ্যসমাপ্ত এশিয়ান গেমসের পর রাম বাবুর নতুন পরিচয়— তিনি ব্রোঞ্জজয়ী অ্যাথলিট। বাণিজ্যসফল সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই যেন গতি বদলেছে তাঁর জীবন! হতদরিদ্র অখ্যাত পরিবার থেকে একেবারে তারকার খ্যাতি পাচ্ছেন তিনি।

Advertisement
০৩ ২২

পদক জয়ের নিরিখে হ্যাংঝাউ এশিয়ান গেমসে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে ভারত। এই প্রথম ১০০টি পদকের গণ্ডি পার করেছেন এ দেশীয় ক্রীড়াবিদেরা। মোট ১০৭টি পদকের মধ্যে ২৮টি সোনা-সহ ৩৮ রুপো এবং ৪১ ব্রোঞ্জ জিতেছেন তাঁরা। এই প্রতিযোগিতার ১৯তম পর্বে এটিই ভারতের সেরা প্রদর্শন। আর পদকজয়ীদের মধ্যে ঝলমল করছেন রাম বাবু।

০৪ ২২

এশিয়ান গেমসে ৩৫ কিলোমিটার হাঁটায় মিক্সড টিম ইভেন্টে মঞ্জু রানির সঙ্গে মিলে ব্রোঞ্জ জিতেছেন তিনি। তার পর থেকে সোনভদ্র জেলার অখ্যাত বেহুরা গ্রামের এই সন্তানকে নিয়ে কম মাতামাতি হচ্ছে না। অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্নের পিছুধাওয়া করতে যে লড়াই চালিয়েছেন তিনি, তা প্রকাশিত হচ্ছে নানা সংবাদমাধ্যমে।

০৫ ২২

সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের কাছে এক সাক্ষাৎকারে ২৪ বছরের রাম বাবু বলেন, ‘‘বারাণসীতে ওয়েটারের কাজ করা থেকে বাবার সঙ্গে মনরেগা-য় গ্রামে রাস্তা তৈরির কাজ— এখনও পর্যন্ত জীবনে যা যা সম্ভব, তা-ই করেছি।’’

০৬ ২২

বেহুরা গ্রামে ফসল তোলার সময় দিনমজুরির কাজ করেন রাম বাবুর বাবা ছোটালাল। দিনভর কায়িক শ্রমের পরেও রোজগার মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। যে টাকায় ছ’জনের সংসার চালানো দায়।

০৭ ২২

ঘরের কাজ সামলে তাই মাঝেমধ্যে মধুপুর বাজারে ক্ষোয়া বিক্রি করতে যান তিন কন্যা এবং এক পুত্রসন্তানের মা মীনা দেবী। কখনও আবার ক্ষেতখামারে স্বামীর কাছে হাত লাগান তিনি। রাম বাবু বলেন, ‘‘আমাদের নিজেদের জমি নেই। ফসল তোলার মরসুমে বাবার হাতে কাজকর্ম থাকলেও সারা বছর বিশেষ রোজগারপাতি হয় না। স্বপ্নপূরণের জন্য তাই কাজ করতে হয়।’’

০৮ ২২

ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না রাম বাবুর। মায়ের জোরাজুরিতে বাড়ির কাছেই জওহর নবোদয় বিদ্যালয় (জেএনবি) ভর্তির পরীক্ষায় বসেছিলেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সেই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলে থাকাকালীনই অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। তাঁর কথায়, ‘‘পড়াশোনা করতে ভাল লাগত না। খেলাধুলোকেই পেশা করতে চেয়েছিলাম।’’

০৯ ২২

জেএনবি-তে পড়াশোনার সময় নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলেন রাম বাবু। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি তখন স্কুলের হস্টেলের টেলিভিশনে ২০১২ সালের অলিম্পিক্সে ভারতীয় অ্যাথলিটদের প্রদর্শন গ্রোগাসে গিলছেন।

১০ ২২

ওই অলিম্পিক্সে পদক জিতেছিলেন দেশের ছ’জন ক্রীড়াবিদ। রাম বাবুর কথায়, ‘‘ক্লাস এইটে পড়ার সময় লন্ডন অলিম্পিক্সে মেরি কম, সাইনা নেহওয়াল এবং গগন নারংকে পদক জিততে দেখেছিলাম টিভিতে। খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে ওঁদের সম্পর্কে সব রিপোর্টও প়ড়েছিলাম। সে সব খবর কাগজ থেকে কেটে একটা ফাইলে রেখে দিয়েছিলাম।’’

১১ ২২

স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত খেলাধুলো করতেন তিনি। সে সব খেলার সময় লক্ষ করেছিলেন, দীর্ঘ ক্ষণ দৌড়লেও সহপাঠীদের মতো হাঁপিয়ে পড়ছেন না তিনি। সে সময়ই স্থির করেন, দূরপাল্লার দৌড়বিদ হবেন।

১২ ২২

গোড়ায় ১০ হাজার এবং পাঁচ হাজার মিটার ম্যারাথনে অংশ নিতেন রাম বাবু। তবে হাঁটুর ব্যথায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। এর পর কোচ প্রমোদ যাদবের পরামর্শে ম্যারাথন ছেড়ে হাঁটায় মন দেন। সে সময় সমাজমাধ্যমের পাতায় ফিটনেস এবং দূরপাল্লার দৌড় নিয়েও খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলেন তিনি।

১৩ ২২

অ্যাথলেটিক্সের নেশায় ২০১৭ সালে বারাণসীর পথে রওনা দেন ১৭ বছরের ছাত্রটি। সেখানকার একটি স্টেডিয়ামের কোচ চন্দ্রবাহন যাদবের সংস্পর্শে আসেন। ওই শহরে দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় একটি ঘরে গিয়ে উঠেছিলেন রাম বাবু। এ ছাড়া, হাতখরচের জন্য বাড়ি থেকে যৎসামান্য টাকা পেতেন।

১৪ ২২

ওই টাকায় বারাণসীতে থাকা দায় হয়ে উঠেছিল। তাই সেখানকার একটি রেস্তরাঁয় ওয়েটারের পার্ট টাইম কাজ শুরু করেন রাম বাবু। তিনি বলেন, ‘‘সে সময় ভোর ৪টেয় উঠে ট্রেনিংয়ের জন্য স্টেডিয়ামে ছুটতাম। এর পর মাঝরাত পর্যন্ত ওয়েটারের কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকা পেতাম। কখনও রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করতে হত।’’

১৫ ২২

রাম বাবু বলতে থাকেন, ‘‘ওয়েটারের কাজে বিশেষ সম্মান ছিল না। খদ্দেররা অনেক সময়ই দুর্ব্যবহার করতেন। তাই বারাণসী ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসি।’’ ২০১৯ সালে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সাই)-র ভোপাল শাখার এক কোচের কাছে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

১৬ ২২

পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল রেস ওয়াক চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ কিলোমিটার ইভেন্টে অংশ নিয়েছিলেন রাম বাবু। ওই ইভেন্টে চতুর্থ হয়েছিলেন তিনি। অতিমারির কবলে এর কয়েক মাস পরেই দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হয়েছিল। ওই আবহে ভোপালের কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে ফিরে আসেন রাম বাবু।

১৭ ২২

লকডাউনের সময় পেট চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছিল তাঁদের। রাম বাবু বলেন, ‘‘ভাগ্যক্রমে লকডাউনের সময় মনরেগা-য় কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম। ওই প্রকল্পের আওতায় আমাদের গ্রামে রাস্তা তৈরির কাজ চলছিল। সেখানে বাবার সঙ্গে গর্ত খোঁড়ার কাজ করতাম। দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার হত।’’

১৮ ২২

প্রায় দেড় মাস ধরে ১০০ দিনের কাজে মজুরি খাটার পর ফের ভোপাল রওনা দেন তিনি। ২০২১ সালের জাতীয় প্রতিযোগিতায় নিজের ইভেন্টে রুপো জিতে নেন রাম বাবু। এ বার কোচ বসন্ত রানার সাহায্যে পুণের আর্মি স্পোর্টস ইনস্টিটিউটে জায়গা পেয়ে যান।

১৯ ২২

২০২১ সালে নিজের ইভেন্ট ছেড়ে ৩৫ কিলোমিটার বিভাগে হেঁটেছিলেন তিনি। সে সময় জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা ছিনিয়ে নেন। এর কয়েক মাস পর বেঙ্গালুরুর জাতীয় শিবিরে ডাক পান। জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা জয়ের জেরে ভারতীয় সেনায় কাজও জুটে যায়।

২০ ২২

এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে হাবিলদার পদে রয়েছেন রাম বাবু। তিনি বলেন, ‘‘পরের মাস পর্যন্ত সেনায় শিক্ষানবিশ হিসাবে থাকব। এখন ১০ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। এর পর পুরো বেতন পাব। তখন মা-বাবার ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারব।’’

২১ ২২

কেরিয়ারের অগ্রগতির জন্য যে উচ্চমানের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তা জানিয়েছেন রাম বাবু। পরের বছর থেকে মিক্সড ইভেন্ট ছেড়ে ২০ কিলোমিটারে নামতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘মিক্সড ইভেন্টে হয়তো কোনও দিন আমার সঙ্গীর খারাপ দিন যেতে পারে। সে সব তো আমার হাতে নেই। তাই পরের বছর থেকে ২০ কিলোমিটারে হাঁটব।’’

২২ ২২

শত আর্থিক দুর্দশা সত্ত্বেও পদক জয়কেই পাখির চোখ করেছেন রাম বাবু। তিনি বলেন, ‘‘অটুট সঙ্কল্প নিয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকাটাই আসল কথা। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে লক্ষ্যভেদের রাস্তা আপনাআপনিই পেয়ে যাবেন। (এশিয়ান গেমসে) সেটাই করেছি আমি!’’

সব ছবি সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement