সমাধিতে ঢুকে মমি নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে মৃত্যু! এ রকম ঘটনার সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই ঘটনার নেপথ্যে অনেকে ‘ফারাওদের অভিশাপ’কে দায়ী করেন। দায়ী করেন ‘যক’-কে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি মমি আগলে রাখে পুরোহিতদের নিয়োগ করা ‘আত্মা’ বা ‘যক’? এই নিয়ে অনেক বাদ-বিবাদ রয়েছে। সম্প্রতি এক মিশর বিশেষজ্ঞ এই নিয়ে অদ্ভুত এক দাবি তুলেছেন। তাতে আবার শুরু হয়েছে জল্পনা।
শতাধিক বছর ধরে খোলা হয়নি এমন এক সমাধিতে ঢুকেছিলেন র্যামি রোমানি। গোটা ঘটনাই ধরে রেখেছিলেন ভিডিয়োতে। ওই সমাধিতে ঢুকে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল রোমানির। তার পর তাঁর বিশ্বাস হয় যে, মিশরের প্রাচীন ওই সব সমাধিতে ছায়া ফেলেছে ‘ফারাওদের অভিশাপ’।
লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দা রোমানি এক জন মিশর বিশেষজ্ঞ। মিশরে এক সমাধিতে একটি মমি শনাক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর ধারণা ছিল, বাইবেলের কোনও ঐতিহাসিক চরিত্রের সমাধি সেটি।
রোমানি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন ওই মমি আসলে মিশরের প্রাচীন সম্রাট আখেনাতেনের। তিনি সেই সমাধিতে প্রবেশের লাইভ করছিলেন একটি চ্যানেলে। আর তা করার মাঝেই ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি পরে রক্তবমিও হয় তাঁর। সেই নিয়েই তৈরি হয় জল্পনা।
ঠিক কী হয়েছিল রোমানির? একটি সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘ওই সমাধিতে কোনও দিন কেউ যাননি। আমি আখেনাতেনের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম।’’
রোমানি জানিয়েছেন, অন্তত ৬০০ বছর ওই সমাধিতে কেউ প্রবেশ করেননি। খোলা হয়নি সেই সমাধি। হাওয়াবাতাস প্রবেশ করেনি। পাথর সরিয়ে সমাধিতে ঢুকতেই সাপের হিসহিস শুনতে পান রোমানি এবং তাঁর সহকারীরা। বুঝতে পারেন, সমাধি থেকে বার হয়ে আসছে একের পর এক সাপ।
এর পরেই রেকর্ডিং শুরু করেন রোমানি। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সমাধির ভিতরে ঢুকে গেলাম। অনেক কিছু খুঁজে পেলাম। আমার শ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। ভিতরে অনেক চামচিকে। গন্ধটা ভয়ঙ্কর। সমাধি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। শরীরটা ভাল লাগছে না।’’
রোমানি পরে এক সংবাদমাধ্যমে জানান, একটি চ্যানেলের সঞ্চালক হয়ে ওই লাইভ করছিলেন। তাও নিজের অসুস্থতা লুকোতে পারেননি তিনি।
রোমানির দাবি, এ সবই তাঁর হয়েছিল মমির ‘অভিশাপ’-এর ফলে। যদিও অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হারবিঞ্জার দাবি করেন, সাপ এবং চামচিকের জন্যই ও সব হয়েছিল। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন রোমানি।
সমাধিতে প্রবেশের পরের দিন থেকেই অসুস্থতা বাড়ে রোমানির। প্রবল জ্বর হয়। রোমানি জানিয়েছেন, সেই জ্বর ১০৭ ডিগ্রিতে পৌঁছে যায়। অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। রক্তবমি হতে থাকে।
রোমানি জানিয়েছেন, ভুলভাল দেখতে শুরু করেছিলেন তিনি। ‘হ্যালুসিনেশন’ হতে থাকে। তাঁর স্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়েন। ভেবেছিলেন, আর হয়তো বাঁচবেন না তাঁর স্বামী। রোমানি নিজেও ভেবেছিলেন, মরে যাবেন।
একাধিক চিকিৎসক তাঁকে দেখে যান। তাঁদের সব কথা জানিয়েছিলেন রোমানি। সেই সমাধি, ‘মমির অভিশাপ’। চিকিৎসকেরা তা মানতে চাননি। জানিয়েছিলেন, দীর্ঘ দিন সমাধিতে কেউ প্রবেশ করেননি। ধুলো জমেছিল। সেখানে বাসা বেঁধেছিল সাপ আর চামচিকে। এই ধুলো, সাপ আর চামচিকেই অসুস্থতার কারণ।
যদিও রোমানির মন মানেনি। তিনি এখনও মনে করেন, ‘ফারাওয়ের অভিশাপ’-এই তাঁর ওই অবস্থা হয়েছিল। যেমন হয়েছিল ১৯২০ সাল নাগাদ হাওয়ার্ড কার্টারের অভিযানকারী দলের কয়েক জন সদস্যের।
সময়টা ১৯২২। তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের জন্য অভিযানে নেমেছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক কার্টার। সমাধিতে ঢুকে ভয়ঙ্কর পরিণতি হয়েছিল কার্টারের অভিযানকারী দলের কয়েক জনের।
মনে করা হয়, খ্রিস্ট জন্মের ১৩২৩ বছর আগে মৃত্যু হয়েছিল ফারাও তুতানখামেনের। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। সেই যুগের অনেক আগের সমাধিও মিশরে আবিষ্কৃত হয়েছিল। একমাত্র তুতানখামেনের সমাধিতেই তার আগে কারও পা পড়েনি। বাকি প্রায় সব সমাধিতেই মাঝের কয়েকশো বছরে কারও না কারও পা পড়েছে। কখনও চোর-ডাকাত, কখনও স্থানীয় কেউ ঢুকেছিলেন। তুতানখামেনের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
সেই সমাধিতে ঢুকে তরুণ ফারাওয়ের মমির সঙ্গে একাধিক মূল্যবান জিনিসপত্র পেয়েছিলেন কার্টারেরা। ছবি, খোদাই করা ফলক, ধর্মীয় সরঞ্জাম ছিল তাতে।
বেশ কিছু সাহিত্যিক এই সমাধি নিয়ে রোমাঞ্চকর কিছু গল্প লেখেন। তার অনেকগুলিরই বিষয় ছিল, ওই সমাধিকে ঘিরে থাকা ‘অভিশাপ’। সে সব গল্প, উপন্যাসের বিষয় ছিল, যাঁরা সমাধিতে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের রহস্যজনক মৃত্যু।
তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পরে কার্টারের দলের বেশ কয়েক জন সদস্যের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ১৯২৩ সালে স্ত্রীর হাতে খুন হন কার্টারের দলের সদস্য আলি কামেল ফাহমি বে।
১৯২৪ সালে হঠাৎই মারা যান ডগলাস রিড। তিনি তুতানখামেনের মমির এক্সরে করেছিলেন। কার্টারের দলের সদস্য আর্থার মেস ১৯২৮ সালে আর্সেনিক সংক্রমণে মারা যান। কার্টারের সচিব রিচার্ড বেথেল ১৯২৯ সালে ঘুমের মধ্যেই মারা গিয়েছিলে।
কার্টার নিজে কখনওই এই ‘অভিশাপের তত্ত্ব’ মানেননি। তিনি বার বার দাবি করেছিলেন, এই মৃত্যুর সঙ্গে ‘মমির অভিশাপের’ কোনও যোগ নেই। ১৯৩৯ সালের মার্চে তিনিও নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যান। বয়স হয়েছিল ৬৪। শেষ বয়সে তাঁর ক্যানসার হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছিল। কার্টারের মৃত্যুর পর আবার শুরু হয় জল্পনা। সমাজের একটা বড় অংশ সিলমোহর দেয় ‘ফারাওদের অভিশাপ’ তত্ত্বে। বলতে থাকেন, ভবিষ্যতে কেউ যাতে সমাধিতে প্রবেশ করতে না পারে, মমি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে না পারে, তাই অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিলেন মিশরের ফারাওরা। সেই অভিশাপ আজও ঘুরছে সমাধির অন্দরে। আর শেষ করছে অভিযানকারীদের। রোমানিও সেই দাবিই করেছেন। যদিও অনেক ইতিহাসবিদই তা মানতে নারাজ।