সুবিশাল নদীর কঙ্কালসার চেহারা! আর সেই হাড় জিরজিরে দশা দেখে চোখ কপালে উঠেছে পরিবেশবিদদের। এই অবস্থা চলতে থাকলে আস্ত একটা নদী যে অচিরেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়ে গিয়েছেন তাঁরা। আর এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
মৃত্যুপথযাত্রী ওই নদীটিকে দুনিয়া চেনে সোলিমোস নামে। তবে এ তার অর্ধেক পরিচয়। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় নদী আমাজনের দু’টি বড় উপনদী রয়েছে। তারই একটি হল এই সোলিমোস।
জলপ্রবাহের হারের নিরিখে বিশ্বের বৃহত্তম নদী হল আমাজন। তার উপনদীর আর যাই হোক জলের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে ভয়ঙ্কর জলসঙ্কটে ভুগছে সোলিমোস। অবস্থা এমনই যে, এই নদীর অর্ধেকটাই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।
চলতি বছরে খরার কবলে পড়েছে ব্রাজ়িলের আমাজন অববাহিকা। যার জেরে নামতে নামতে একেবারে তলানিতে চলে গিয়েছে সোলিমোসের জলস্তর। বেরিয়ে এসেছে নদীর বুকের বালি। কোনও কোনও এলাকায় নদীতে নেমে মাটি খুঁড়লে তবে মিলছে জল!
ব্রাজ়িলের অন্যতম বন্দর শহর মানাউস থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে মানকাপুরুতে রিও নিগ্রো নদীতে গিয়ে মিশেছে সোলিমোস। দুই নদীর মিলনে জন্ম নিয়েছে আমাজন। অথচ এই মানাউসেই সোলিমোসের গভীরতা মাত্র ৩ মিটারে (৯.৮ ফুট) এসে ঠেকেছে।
আমাজনের এই উপনদী প্রায় জলশূন্য হয়ে পড়ায় ধাক্কা খেয়েছে মানাউসের অর্থনীতি। সেখানে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে জলপথ পরিবহণ। ফলে এলাকাবাসীরা শস্য রফতানি বা নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করতে পারছেন না।
ব্রাজ়িল সরকারের দাবি, ১৯০২ সালের পর এ হেন ভয়ঙ্কর খরা আর দেখা যায়নি। অর্থাৎ, ১২২ বছর পর মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। যার প্রভাব আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের উপর পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত বছরও এই সময়ে জলসঙ্কটে ভুগছিল সোলিমোস। তবে তা এতটা প্রবল ছিল না। ২০২৫ সালের ২৫ অক্টোবর ব্রাজ়িলের সিভিল ডিফেন্স দফতরের তরফে নদীর গভীরতা পরিমাপ করা হয়েছিল। এ বার তার থেকেও জলস্তর ১১ সেন্টিমিটার (৪.৩ ইঞ্চি) নেমে গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
পেরুর আন্দিজ পর্বতে উৎপত্তি হওয়া সোলিমোসের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। নদী বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগামী দিনে এর জলস্তর আরও কমবে। কারণ শুষ্ক মরসুম শেষ হয়ে বৃষ্টি শুরু হতে অন্তত আরও এক মাস দেরি আছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোলিমোসের একটি শাখা সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছে। ফলে একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে সেখানকার জীবজগৎ। ২০২৩ সালে লেক টেফো এলাকায় ২০০টির বেশি মিষ্টি জলের ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে।
তবে আমাজনের উপনদী খরার গ্রাসে পড়ায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। নদী সংলগ্ন গ্রামগুলি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফলে সেখানকার বাসিন্দারা পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় জল পাচ্ছেন না।
সোলিমোসের গভীরতা এতটাই কমে গিয়েছে যে এর উপরে নৌকা চালানো একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী তীরবর্তী গ্রামবাসীদের তাই বাধ্য হয়ে হেঁটেই পারাপার করতে হচ্ছে। দিনের বেলা নদীর বুকের তপ্ত বালির উপর দিয়ে অন্তত দু’ঘণ্টা হেঁটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করছেন তাঁরা।
জলশূন্য নদীর তীরে বসবাস কতটা কঠিন, তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন তাসিয়ারা সুজা অলিভেইরা নামের এক তরুণী। তাঁর কথায়, ‘‘নদীর বুক চিরে বালির উপর দিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হচ্ছে। এটা প্রতি দিনই করছি। আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।’’
সোলিমাস চির দিন যে এমন ছিল, তা নয়। একটা সময়ে এর উপর দিয়ে যাতায়াত করত বড় বড় নৌকা ও লঞ্চ। এখন শুষ্ক নদীর বুকে ইতিউতি পড়ে রয়েছে সে রকমই কয়েকটি জলযানের ভাঙাচোরা কঙ্কাল।
ওই এলাকার বাসিন্দা ম্যানুয়েল ডি কাস্ত্রো রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘খরা একটা অভিশাপ। যার প্রকোপ থেকে আমরা বেরোতে পারছি না। এখন শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা করছি। একমাত্র সেটাই আমাদের স্বস্তি দেবে।’’
নদী তীরবর্তী এলাকার অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ হল মাছ শিকার। যা মানবদেহে প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। সোলিমাস অববাহিকার ক্ষেত্রেও এত দিন তার অন্যথা হয়নি। কিন্তু নদী জলশূন্য হয়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় আর তেমন ভাবে মিলছে না মাছ। ফলে বদলাচ্ছে মানুষের খাদ্যাভাস।
পরিবেশবিদদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এই এলাকায় দাপট দেখাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। যা আমাজনের নদীগুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে। আর আমাজন বৃষ্টি অরণ্যকে নিয়ে যাচ্ছে দাবানলের দিকে। ফলে প্রতি দিন একটু একটু করে অসুস্থ হচ্ছে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’।