১৮ ডিসেম্বর। লুসেইল স্টেডিয়ামের মঞ্চে ফুটবল বিশ্বকাপের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। হাজার আলোর মাঝে কালো রঙের জমকালো পোশাকে হাতে মাইক নিয়ে হাজির হলেন বলি-তারকা নোরা ফতেহি। সারা বিশ্ব যেন তাঁর দিকে চেয়ে। মঞ্চে বাল্কিস, রহমা রিয়াদ এবং মানালের সঙ্গে ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় ‘লাইট দ্য স্কাই’ গানে গলা মেলালেন নোরা।
গানের তালে নাচও করতে দেখা গেল নোরাকে। এই পারফরম্যান্সের ভিডিয়ো নিজের ইনস্টাগ্রামে ভাগ করে নোরা জানান, স্কুলের অডিটোরিয়াম থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ, সারা জীবন যেন এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। নোরার মতে, তাঁর কেরিয়ারে এ যেন এক ‘মহাকাব্যিক মুহূর্ত’।
শুধু সমাপ্তি অনুষ্ঠানেই নয়, বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে ফিফা অনুরাগী উৎসবেও দেখা গিয়েছিল নোরাকে। ১ ডিসেম্বর দোহার মঞ্চে ‘সাকি সাকি’ গানটি গেয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিলেন তিনি। বলি-তারকা বিশ্বকাপের মঞ্চে ইতিহাস গড়েছেন দেখে দেশবাসীদের একাংশ গর্ববোধ করলেও নোরাকে নিয়ে বিতর্কও কিছু কম হয়নি।
সম্প্রতি আর্থিক দুুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত সুকেশ চন্দ্রশেখর তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকা এবং বলি-অভিনেত্রী জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ়কে দামি উপহার পাঠাতেন নোরা। জ্যাকলিনের দাবি, নোরাও নাকি সুকেশের কাছে বহুমূল্য উপহার নিয়েছিলেন। সেই সূত্রে নোরাকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তরফে তলব করা হয়।
জ্যাকলিনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও করেন নোরা। নোরার দাবি, জ্যাকলিন এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করছেন। কিন্তু তাঁকে এই ‘নোংরামি’র সঙ্গে জড়ানোর কোনও কারণ নেই। সেই মর্মে নিজেকে দুর্নীতি মামলা থেকে মুক্ত করার আবেদনও জানিয়েছেন অভিনেত্রী।
১৯৯২ সালে এক মরোক্কান পরিবারে জন্ম নোরার। বেড়ে ওঠা কানাডায়। কেরিয়ার গড়তে ভারতে এসেছিলেন তিনি। ভারতের নাগরিক না হওয়া সত্ত্বেও কেন নোরা বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতেকে উপস্থাপন করবেন, তা নিয়ে সরব হয়েছিল নেটব্যবহারকারীদের একাংশ।
তার উপর দোহার মঞ্চে দেশের পতাকা ভুলবশত উল্টো করে তুলে ধরেছিলেন বলে তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। অবশ্য তাতে ‘হৃদয়ে ভারতীয়’ বলে নিজের পরিচয় দেওয়া নোরার কিছু যায়-আসে না। শৈশব থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে বিতর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
ছোট থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ ছিল নোরার। কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে। ঘর বন্ধ করে নেটে ভিডিয়ো দেখে নিজে থেকেই নাচ শিখেছিলেন নোরা। স্কুলে কখনও নাচ করলে তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে কটুকথা শোনাতেন। তবুও দমেননি নোরা।
ছেলেবেলা থেকে মঞ্চে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সামনে পারফর্ম করতেন নোরা। কিন্তু তাঁর কৈশোর খুব একটা সুখকর ছিল না। ১৬ বছর বয়স থেকে অর্থের প্রয়োজনে কাজ করতেন তিনি। কখনও রেস্তরাঁয় খাবার পরিবেশন করতেন, কখনও বা লটারির টিকিট বিক্রি করতে হত নোরাকে। পানশালার কর্মী হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি।
নাচের পাশাপাশি মডেলিংয়ের দিকেও ঝুঁকতে শুরু করেছিলেন নোরা। সেই জগতে কাজের সুযোগও পেয়ে যান তিনি। কলেজের পড়াশোনা শেষ না করে নিজের কেরিয়ার তৈরি করতে ভারতে আসেন নোরা। নাচে দক্ষতার জন্য ফিল্মজগতে কাজ পেয়ে যান তিনি।
২০১৪ সালে ‘রোর: দ্য টাইগার্স অফ সুন্দরবনস’ নামে একটি হিন্দি ছবি মুক্তি পায়। ওই ছবিতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন নোরা। তার পর দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘আইটেম সং’-এ নাচের দৃশ্যে প্রায়ই দেখা যেত নোরাকে।
‘বাহুবলী: দ্য বিগিনিং’ ছবির ‘মনোহরী’ নাচটির দৃশ্যেই হোক বা ‘কিক ২’ ছবির ‘কিরুকু কিক’— তেলুগু, মালয়ালম এবং হিন্দি ছবিতে ‘আইটেম সং’-এ নাচ করতে দেখা গিয়েছে নোরাকে। কিন্তু তাঁর জীবনে মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায় ‘দিলবর’ গানের মিউজ়িক ভিডিয়ো।
ব্রহ্মাণ্ডসুন্দরী সুস্মিতা সেনের জন্য যে গানটি এত বিখ্যাত হয়েছিল, তা-ই আবার নতুন ভাবে তৈরি করা হয় ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্যমেব জয়তে’ ছবির জন্য। ওই ছবির ‘দিলবর’ গানের ভিডিয়োয় নেচেছিলেন নোরা। ইউটিউবে প্রকাশ পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ কোটি মানুষ ভিডিয়োটি দেখেন। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান নোরা। তার পর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কোনও হিন্দি ছবিতে ‘আইটেম সং’-এর প্রয়োজন হলে পরিচালক-প্রযোজকদের প্রথম পছন্দ নোরা। দুর্দান্ত বেলি ডান্সের মাধ্যমে খুব কম সময়ের মধ্যে দর্শকের মন জয় করে ফেলেছিলেন তিনি।
ধীরে ধীরে অভিনয়ও করতে দেখা যায় নোরাকে। ইউটিউবের স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিয়োয় টুকটাক অভিনয় করলেও দর্শক নোরাকে অভিনেত্রী হিসাবে দেখতে পান ২০২০ সালে। ‘স্ট্রিট ডান্সার’ ছবিতে বরুণ ধওয়ান, শ্রদ্ধা কপূরের সঙ্গে অভিনয় করেন তিনি। যদিও এই ছবিতে অভিনয়ের থেকে নাচের দিকেই বেশি জোর দিয়েছিলেন নোরা।
এর পর গুরু রণধাওয়া, হার্ডি সন্ধু এবং রফতারের মতো গায়কদের সঙ্গে মিউজ়িক ভিডিয়োয় কাজ করেছেন নোরা। শুধু বলিউডের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। জ্যাক নাইট এবং রেভ্যানির মতো গায়কদের সঙ্গে মিউজ়িক ভিডিয়োয় নাচের দৃশ্যে তাঁকে দেখা গিয়েছে।
সাফল্যের সিঁড়িতে উঠতে উঠতে অবশেষে বিশ্বকাপের মঞ্চে পৌঁছে গিয়েছেন নোরা। পরিবারের আপত্তি, জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসা— নিজের কেরিয়ারের জন্য ত্যাগও কম করেননি তিনি! বলিজগতের ‘আইটেম সং’-এর দুনিয়া একা হাতেই কাঁপিয়ে চলেছেন তিনি। নোরা যেন আধুনিক যুগের হেলেন। এক সময় হেলেনও এই জগৎ মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর নাচের পারফরম্যান্সের ধারেকাছে পৌঁছনো খুব সোজা কথা ছিল না। এখন যেন সেই হেলেনের ভূমিকাতেই যেন রয়েছেন নোরা।