থ্যালিডোমাইডকাণ্ডের ছ’দশক পেরিয়ে গিয়েছে। সেই বিভীষিকার কথা আজও বিশ্ববাসীর স্মরণে রয়েছে। সেই ঘটনার জন্যই এ বার আনুষ্ঠানিক ভাবে আক্রান্ত পরিবারগুলির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল অস্ট্রেলিয়ার সরকার।
২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সরকার এবং আইনসভার তরফে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির কাছে ক্ষমা চাইবেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ়।
সোমবার একটি বিবৃতিতে, অ্যান্টনি ‘থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি’কে অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বের ইতিহাসে একটি ‘অন্ধকার অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ঘটনায় যে সব শিশু মারা গিয়েছিল বা ভয়ঙ্কর ওষুধের প্রভাবে যে সব শিশুর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতেই এই উদ্যোগ।
থ্যালিডোমাইড আসলে কী? এটি হল একটি রায়ায়নিক উপাদান যা ব্যথার ওষুধে ব্যবহার করা হয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মহিলারা থ্যালিডোমাইডযুক্ত ওষুধ সেবন করলে শিশুদের জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
থ্যালিডোমাইডযুক্ত ব্যথা উপশমকারী ওষুধটি পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে অস্ট্রেলিয়া এবং সারা বিশ্বের বহু অন্তঃসত্ত্বা মহিলার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
কিন্তু পরে আবিষ্কৃত হয়েছিল যে, থ্যালিডোমাইড শিশুদের জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করে।
‘অস্ট্রেলিয়ান থ্যালিডোমাইড সারভাইভার্স সাপোর্ট প্রোগ্রাম’ অনুযায়ী, থ্যালিডোমাইডের প্রভাবের পরেও ১৪৬ জন শিশু বেঁচে গিয়েছিল। যদিও আক্রান্ত শিশুর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
বহু দিন ধরে থ্যালিডোমাইডের শিকার শিশুদের ন্যায়বিচারের দাবিতে লড়ছ ‘থ্যালিডোমাইড গ্রুপ অস্ট্রেলিয়া’ নামের এক সংস্থা। সেই সংস্থার মতে, থ্যালিডোমাইডের প্রভাবে আক্রান্ত শিশুদের ৪০ শতাংশ তাদের জন্মের এক বছরের মধ্যে মারা যায়।
জার্মানির এক ওষুধ সংস্থার বিজ্ঞানীরা থ্যালিডোমাইড তৈরি করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে থ্যালিডোমাইড জার্মানির বাজারে প্রবেশ করে।
উদ্বেগ, অনিদ্রা, গ্যাস্ট্রাইটিস এবং উত্তেজনা নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত এই ওষুধ ব্যথা উপশমকারী এবং ঘুমের ওষুধ হিসাবে বাজারজাত করা হয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের বমি বমি ভাব কাটিয়ে তোলার জন্যও সেই ওষুধ ব্যবহার করা হত।
সেই সময় গবেষকেরা দেখতে পান যে থ্যালিডোমাইড একটি কার্যকর বমিনিরোধক ওষুধ। খুব কম সময়ের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার বাজারেও ওষুধটি পৌঁছে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় ‘ডিস্টাভাল’ নামে বিক্রি হত সেই ওষুধ।
১৯৫৮ সালে থ্যালিডোমাইড ব্রিটেনে প্রথম ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছিল। সেখানেও ‘ডিস্টাভাল’ নামে বিক্রি হয়েছিল সেই ওষুধ।
প্রাথমিক ভাবে থ্যালিডোমাইড সেবন করা রোগীরা খুব কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করেছিলেন। তবে বেশি মাত্রায় থ্যালিডোমাইড নেওয়ার কারণে অনেকের মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়।
দেখা যায়, যে সমস্ত অন্তঃসত্ত্বা মহিলা গর্ভাবস্থার আট থেকে চোদ্দো সপ্তাহের মধ্যে থ্যালিডোমাইড সেবন করেছেন, তাদের শিশু হয় মারা গিয়েছে, না হলে তাঁরা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিয়েছেন।
১৯৬০ সালের মধ্যে অ্যাসপিরিনের মতোই হু হু করে বিক্রি হতে থাকে থ্যালিডোমাইড মেশানো ওষুধ। বিশ্বের ৪৬টি দেশে তখন রমরমিয়ে বিক্রি হতে থাকে সেই ওষুধ।
গর্ভাবস্থায় থ্যালিডোমাইড সেবন করা মহিলাদের জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুরা ‘থ্যালিডোমাইড শিশু’ হিসাবে পরিচিত হয়। থ্যালিডোমাইডের কুপ্রভাবে আক্রান্ত প্রথম শিশু জন্মগ্রহণ করে ১৯৫৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। যে ওষুধ সংস্থা ওই ওষুধ তৈরি করেছিল, তারই এক কর্মীর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিল সেই শিশু।
থ্যালিডোমাইড শিশুরা মূলত চোখ এবং মুখের পেশির ত্রুটি, মেরুদণ্ডের ত্রুটি, হৃদ্রোগ, চোখের অস্বাভাবিকতা, ক্ষতজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিচ্ছিল। অনেকে আবার জন্ম নিচ্ছিল হাত এবং আঙুল ছাড়া।
এ ছাড়াও কিছু শিশু হৃৎপিণ্ড, গলব্লাডার, অন্ত্র এবং পাচনতন্ত্রের ক্রটি নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ‘থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি’ বা ‘থ্যালিডোমাইড স্ক্যান্ডাল’ নামে পরিচিত।
১৯৬১ সালের মার্চ মাসে, অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় ‘ডিস্টাভাল’কে একটি শক্তিশালী ওষুধ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ এটি কেবল কয়েকটি অনুমোদিত দোকান থেকেই বিক্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৯৬১ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড প্রথম থ্যালিডোমাইডের কুপ্রভাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে তিনি যে দাবি করেছিলেন, তাকে মান্যতা দিতে রাজি ছিল না ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা। উল্টে ডিস্টাভালের বিক্রয় বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ওষুধটিকে ‘নিরাপদ’ বলে দাবি করে প্রচুর লিফলেটও বিতরণ করা হয়েছিল ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার তরফে।
তবে ম্যাকব্রাইড হাল ছেড়ে দেননি। থ্যালিডোমাইড ব্যবহার বন্ধ করতে লড়াই চালিয়ে যান তিনি। ১৯৬১ সালের জুন মাসে, ম্যাকব্রাইডের চেষ্টায় সিডনির মহিলা হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের থ্যালিডোমাইড দেওয়া বন্ধ করা হয়। তবে তার আগেই ব্রিটেনে সেই ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করা হয়।
ওই বছরেরই ডিসেম্বরে, থ্যালিডোমাইড এবং জন্মগত ত্রুটির যোগসূত্র তুলে ধরে ম্যাকব্রাইডের একটি প্রতিবেদন একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৬২ সালের ৯ অগস্ট অস্ট্রেলিয়ায় থ্যালিডোমাইডের ব্যবহার বন্ধ করা হয়। ম্যাকব্রাইডের চেষ্টাতেই ‘থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি’র অবসান ঘটে।
তবে যে তিন-চার বছর থ্যালিডোমাইড বাজারে বিক্রি হয়েছিল, তার প্রভাবে নাকি বিশ্বব্যাপী ১০ হাজার শিশু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিল। ‘থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি’র কারণে, ১৯৬৮ সালে ব্রিটেনে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে বেশির ভাগ দেশে থ্যালিডোমাইড নিষিদ্ধ করা হলেও, পরবর্তী কালে এটি রক্তরস কোষের ক্যানসার এবং কুষ্ঠ রোগের জন্য একটি কার্যকর ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হয়। ওষুধ হিসাবে বন্ধ করা হলেও বিভিন্ন জৈব রায়ায়নিক পরীক্ষায় এখনও থ্যালিডোমাইড ব্যবহার করা হয়।