মুক্তি পেতে চলেছে ভিকি কৌশল অভিনীত ছবি ‘স্যাম বাহাদুর’। ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশের জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন মেঘনা গুলজ়ার। ১ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। ছবিটি নিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে উত্তেজনাও তুঙ্গে।
কিন্তু যাঁকে নিয়ে এই ছবি, সেই মানেকশ কে, তা অনেকেরই অজানা। তাঁকে জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১৯১৪ সালের ইতিহাসে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হব হব করছে।
ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামশেদজি মানেকশ ছিলেন ভারতের অন্যতম বৈগ্রহিক সেনাকর্তা। ১৯১৪ সালের ৩ এপ্রিল পঞ্জাবের অমৃতসরে এক পারসি পরিবারে মানেকশর জন্ম।
মানেকশর বাবা চিকিৎসক হরমিজড মানেকশ কোনও দিনই চাননি যে ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন স্যাম। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তা হলে তাঁর বাবার তাঁকে পড়়াশোনার জন্য লন্ডনে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। লন্ডনে গিয়ে তিনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হবেন বলেও জানিয়ে দেন তিনি। কিন্তু মানেকশর বাবা তাতেও রজি হননি।
এর পরে মানেকশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। বাকিটা ইতিহাস।
স্নাতক হওয়ার পর ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন মানেকশ। শীঘ্রই দ্বিতীয় লেফ্টেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি হয় তাঁর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বর্মায় (বর্তমান মায়ানমার) জাপানি সেনার সঙ্গে সংঘাতের সময় মানেকশ ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার ৪/১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সেনাকে হারানোর পরও মানেকশর নেতৃত্বে জাপানিদের পরাজিত করে সিটং সেতু দখল করতে সফল হয়েছিল ভারতীয় সেনা।
মানেকশই প্রথম সেনা অফিসার যিনি পাঁচতারা র্যাঙ্কের ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হন।
মানেকশ ৪০ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ভারতের হয়ে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন তিনি— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
২৫ মার্চ, ১৯৭১। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর নৃশংস ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ৩ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই যুদ্ধে যোগদান করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে অস্ত্র নামিয়ে রাখে। এই দিনটিকে ভারতের শৌর্যের ইতিহাসে একটি সোনালি দিন বলে মনে করা হয়। ভারতকে সেই ঐতিহাসিক জয় এনে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন মানেকশ।
শোনা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যোগদানের ঠিক আগে আগে সেনার প্রস্তুতি কেমন, তা নিয়ে মানেকশকে জানতে চান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সেই সময় মানেকশ নাকি বলেছিলেন, ‘‘আমি সর্বদা প্রস্তুত সুইটি।’’
ইন্দিরার স্বামী ফিরোজ গান্ধী ছিলেন পারসি। শোনা যায়, মানেকশর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেই জন্য ইন্দিরাকে মাঝেমধ্যেই নাকি ‘সুইটি’ বলে ডাকতেন মানেকশ।
১৯৫৩ সালে মানেকশ ৮ গোর্খা রাইফেলস রেজিমেন্ট এবং ৬১ ক্যাভালরি বাহিনীর কর্নেল হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৯ সালের ৮ জুন মানেকশকে ‘চিফ অফ আর্মি স্টাফ’ নিযুক্ত করা হয়। ভারতীয় সেনার সেনাপ্রধান হিসাবে তিনি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একত্রিত করে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে বহু বার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে ফেরেন মানেকশ। সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন হিসাবে ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনার সঙ্গে লড়াইয়ের সময় মানেকশর শরীরে নাকি ন’টি গুলি লেগেছিল। গুরুতর জখম হন তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের সময়, মানেকশর সহযোদ্ধা শের সিংহ তাঁকে এসে উদ্ধার করেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে আবার সেনায় যোগ দেন তিনি।
মানেকশর বিখ্যাত উক্তি ছিল, “যদি এক জন মানুষ বলে যে সে মরতে ভয় পায় না, তা হলে হয় সে মিথ্যা কথা বলছে, নয়তো সে গোর্খা।”
মানেকশর আরও একটি উক্তি জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি যদি দেশভাগের সময় পাকিস্তানে চলে যেতেন তা হলে কী হত? উত্তরে মানেকশ বলেছিলেন, ‘‘তা হলে পাকিস্তান সমস্ত যুদ্ধে জয়লাভ করত।’’
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মানেকশর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৪২ সালে তাঁকে ‘সামরিক ক্রস’, ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭২ সালে পদ্মবিভূষণে সম্মানে সম্মানিত করা হয়।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে মানেকশর চাকরির মেয়াদ ছ’মাস বাড়ানো হয়েছিল। প্রথমে তিনি মেয়াদবৃদ্ধি নিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও পরে রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান জানিয়ে সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
২০০৮ সালের ২৭ জুন তামিলনাড়ুর ওয়েলিংটনের সেনা হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান মানেকশ। মানেকশকে সম্মান জানাতে ২০১৪ সালে ওয়েলিংটনে তাঁর একটি মূর্তি তৈরি করা হয়।