শুক্রবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ড্রামা ঘরানার হিন্দি ছবি ‘উঁচাই’। চার জন বয়স্ক বন্ধুর এভারেস্ট বেস ক্যাম্প যাত্রা নিয়ে এই ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে। ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্চন, অনুপম খের, বোমান ইরানি এবং ড্যানি ডেনজোংপার মতো বলিপাড়ার বর্ষীয়ান অভিনেতারা। ছবি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন পরিচালক সুরজ বরজাতিয়া।
পরিবার, বন্ধুত্ব, রোম্যান্স— এই তিনটি বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে একের পর এক হিট ছবি বানিয়ে গিয়েছেন পরিচালক সুরজ। কিন্তু ২০২২ সালে এসে সেই চিরাচরিত ধারা ভেঙে কাজ করলেন ‘উঁচাই’ ছবিতে। ৩৫ বছর ধরে বলিপাড়ায় কাজ করে মাত্র আটটি ছবি বানিয়েছেন তিনি। প্রতিটি ছবিই বাণিজ্যিক ভাবে সফল।
কিন্তু তাঁর পরিচালনার কাজে নামার কাহিনি অন্য রকম। নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে কম বয়সে ছবি পরিচালনায় হাত দিয়েছিলেন সুরজ ।
সুরজের ঠাকুরদা তারাচাঁদ বরজাতিয়া ১৯৪৭ সালে ‘রাজশ্রী প্রোডাকশনস’ নামে একটি প্রযোজনা সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুরদার সঙ্গে হাত লাগিয়েছিলেন তাঁর বাবা রাজকুমার বরজাতিয়াও।
আশির দশক থেকে এই প্রযোজনা সংস্থা বহু হিট ছবি দর্শককে উপহার দিয়ে এসেছে। কিন্তু এক সময় পর তাদের ছবির মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জনপ্রিয়তাও কমে যেতে থাকে বরজাতিয়া পরিবারের প্রযোজনা সংস্থার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই সংস্থাটি বিক্রি করে দেওয়া হবে।
এত নামী সংস্থার এই দশায় পৌঁছনো মানে বলি ইন্ডাস্ট্রিতে বরজাতিয়া পরিবারের সম্মানহানি হওয়া। তখন সুরজ সবেমাত্র ২৪ বছরের গণ্ডি পার করেছেন। ‘সারাংশ’ ছবিতে মহেশ ভট্টের সঙ্গে পরিচালনার কাজে হাতেখড়ি করছেন তিনি।
সেই বয়সেই পরিবারকে বাঁচাতে ‘রাজশ্রী প্রোডাকশনস’-এ যোগ দিলেন সুরজ । নিজে থেকে ছবির গল্প লিখতেও শুরু করেন তিনি। পরিবারের সকলে তাঁর সিদ্ধান্তে ঘাবড়ে গেলেও তাঁর ঠাকুরদা এবং বাবা সমর্থন করেছিলেন সুরজকে। ।
তার পর সুরজ ‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’ ছবির গল্প লিখে ফেলেন। কিন্তু ছবি বানানোর সময় ঝামেলা শুরু হয়। সলমন খানকে তখন ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকে চিনে ফেলেছেন। তখন সলমনের চেহারা নিয়েও কটাক্ষ করতেন অনেকে। এমন ছিপছিপে চেহারার কেউ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করলে মানাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বলিপাড়ার একাংশ।
তাই দর্শকের নজর কাড়তে সলমনের বিপরীতে ভাগ্র্যশ্রীকে বেছে নিয়েছিলেন সুরজ । কিন্তু ভাগ্যশ্রীও শুট শুরু করার আগে কয়েকটি শর্ত রাখেন। তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে অভিনেত্রীর। রোম্যান্টিক ঘরানার ছবিতে অভিনয় করতে চলেছেন শুনে তিনি আগে থেকেই জানিয়ে দেন, কোনও রকম ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে তিনি অভিনয় করতে পারবেন না।
ভাগ্যশ্রীর শর্ত মাথায় রেখে ছবির কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৮৯ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’ ছবিটি। ছবিটির গল্প থেকে শুরু করে ছবির গান, সবই দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়।
কেরিয়ারের প্রথম ছবি, তাতেই ছক্কা মেরেছিলেন পরিচালক। মুহূর্তের মধ্যেই যেন সুরজের কাছ থেকে সকলের প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যায়। সকলে তাঁকে পরবর্তী ছবির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন।
‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’ ছবির সাফল্যে প্রযোজনা সংস্থাকে বিক্রির হাত থেকে রক্ষা করেছিল। তাই সেই ছবির তেলুগু ডাবিংও বানানো হয়। সুরজকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘নদিয়া কে পার’ ছবির গল্পের ভিত্তিতে অন্য একটি ছবি বানাতে।
দ্বিতীয় ছবির গল্পও লিখে ফেললেন তিনি। ‘হম আপকে হ্যায় কৌন’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রে দেখা যায় সলমন খান এবং মাধুরী দীক্ষিতকে। ছবি মুক্তি পাওয়ার প্রথম কয়েক দিন কোনও ইতিবাচক সাড়া পাননি সূর্য। পরিচালক ভাবলেন, ছবিতে গানের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে গিয়েছে, তাই ছবি থেকে কয়েকটি গান বাদও দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু কয়েক দিন পর থেকেই এই ছবি দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাপ্রেমীদের ভিড় উপচে পড়তে থাকে। টানা ২৫ সপ্তাহ ধরে এই ছবিটি প্রায় দেড়শোটিরও বেশি সিনেমাহলে চলে। চড়া দামে বিক্রি হয়েছিল এই ছবির টিকিট।
পরিচালক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তাঁর প্রত্যেকটি ছবির গল্পের সঙ্গে নিজের জীবনের কোনও যোগসূত্র রয়েছে। প্রথম ছবি বানানোর সময় সুরজ বিয়ে করেছিলেন। তাই একটি পুরোদস্তুর রোম্যান্টিক ঘরানার ছবি বানান।
দ্বিতীয় ছবি বানানোর মুহূর্তে তাঁর পরিবারে নতুন অতিথির আগমন ঘটে। তাই একটি পারিবারিক ছবি বানিয়েছিলেন সুরজ । তৃতীয় ছবিটি বানানোর সময় তাঁর মনের অবস্থা ঠিক ছিল না। পরিচালকের নিকটাত্মীয় গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তার ছাপ তৃতীয় ছবি ‘হম সাথ সাথ হ্যায়’ ছবির মধ্যে পড়ে।
অনেকে এই ছবি পছন্দ করলেও বলিপাড়ার একাংশ জানিয়েছিলেন, সুরজ যে ধাঁচের ছবি বানান, তাতে একটি ইতিবাচক মনোভাব ফুটে ওঠে। কিন্তু এই ছবিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে, তা দর্শকের মনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
তার পর বলিপাড়া থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিরতি নেন পরিচালক। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নতুন প্রজন্মের তারকাদের নিয়ে কাজ করবেন তিনি। তাই হৃতিক রোশন, করিনা কপূর খান এবং অভিষেক বচ্চনের সঙ্গে ‘ম্যায় প্রেম কি দিওয়ানি হুঁ’ ছবি তৈরি করেন।
পরিচালক দাবি করেন, ছবিতে তিনি যা দেখিয়েছেন, এই ঘটনাটি তাঁর নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু ছবিটি বক্স অফিসে সেরকম সাড়া পায়নি। প্রথম তিনটি ছবিতে সলমনের সঙ্গে কাজ করার পরে এই ছবিতে কেন তাঁকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে।
বলিপাড়ার একাংশের দাবি, সলমন সেই সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ঐশ্বর্যা রাই বচ্চনের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়াও অভিনেতার বিরুদ্ধে তখন বহু অভিযোগ। মামলাও চলছে তাঁর বিরুদ্ধে। সেই কারণেইনাকি সলমনের সঙ্গে আর কাজ করতে চাননি সুরজ ।।
২০০৬ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘বিবাহ’ ছবিটি। মুখ্যচরিত্রে শহিদ কপূর এবং অমৃতা রাওকে অভিনয় করতে দেখা যায়। ছবিটি বিপুল সাড়া ফেলায় একই ঘরানার আরও একটি ছবি বানান তিনি— ‘এক বিবাহ... অ্যায়সা ভি’। কিন্তু সেই ছবিটি সাড়া পায়নি।
এর পর আবার বলিপাড়া থেকে দীর্ঘ বিরতি নেন সুরজ । ২০১৫ সালে আবার সলমনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ফিরে আসেন তিনি। তবে, ‘প্রেম রতন ধন পায়ো’ ছবিটিও দর্শকের মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
পরিচালক জানিয়েছিলেন, সময়ের সঙ্গে দর্শকের চিন্তাধারা পাল্টে গিয়েছে। তাই ভিন্ন ধারার ছবি তৈরি করেছিলেন তিনি। গল্পের মধ্যে অ্যাকশনও রেখেছিলেন যা সাধারণত তিনি এড়িয়ে চলেন।
সুরজ তাঁর স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি এমন ধরনের ছবি বানাবেন যা বহু বছর পরেও পরিবারের সকলে মিলে দেখতে পারেন। তাই ২০২২ সালে আবার একটি পারিবারিক ছবি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে ফিরেছেন তিনি।
সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, সলমন এবং সুরজ একই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এমনকি, তাঁদের বেড়ে ওঠাও একসঙ্গে। কর্ণ জোহর এবং আদিত্য চোপড়া পরিচালক হিসাবে সুরজকে আদর্শ মনে করেন।