কলঙ্কের নয়, গর্বের। ভোট দিতে গিয়ে বাঁ হাতের তর্জনীর উপর লাগে যে কালি। ভোট দিয়ে বেরিয়ে অনেকেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের অহঙ্কার ধরে রাখেন নিজস্বীতে। কমবয়সিদের মধ্যে সেই প্রবণতা বেশি। এই ‘কালি-কথা’ অনেক রহস্যে মোড়া। ইতিহাসও দীর্ঘ দিনের।
ভারতে ভোটের কালির ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬২ সালে। দেশে তৃতীয় লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে। ঠিক হয়, ভোটে কারচুপি বন্ধ করতে ভোটারদের বাঁ হাতের তর্জনীতে কালি লাগিয়ে দেওয়া হবে। সেই শুরু। কালের নিয়মে কালি লাগানোর নিয়মও বদলেছে। তবে কালি বদলায়নি।
সবাই ‘ভোটের কালি’ বলে চিনলেও এর আসল নাম ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’। অর্থাৎ, যে কালি সহজে বদলে ফেলা যায় না, মুছে ফেলা যায় না। পালস পোলিও টিকাপ্রাপক খুদেদের হাতে ‘ইনডেলিবল ইঙ্ক’ লাগানো হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ভোটের কালি অন্য রকম।
নির্বাচন কমিশন যে কালি ব্যবহার করে, তা খোলাবাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। কমিশন বরাত দিয়ে বানায়। সেটাও আবার একটি সংস্থা থেকেই।
মাইসুরুর সংস্থা ‘মাইসোর পেন্টস অ্যান্ড ভার্নিশ লিমিটেড’ (এমপিভিএল) নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন অনুযায়ী এই কালি তৈরি করে। এই সংস্থার ইতিহাসও দীর্ঘ।
১৯৩৭ সালে মাইসুরুর রাজপরিবারের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ‘মাইসোর ল্যাক ফ্যাক্টরি’ নামে এক সংস্থা। স্বাধীনতার পরে সংস্থাটি অধিগ্রহণ করে কর্নাটক সরকার। শুরুতে গালা তৈরির সংস্থা হিসাবে পরিচিতি থাকলেও এখন অন্যান্য সামগ্রীর পাশাপাশি ভোটের কালিও বানায় এমপিভিএল।
ইভিএম-এর যুগে মূলত কালি কিনলেও আগে ব্যালট বাক্স সিল করার জন্য এই সংস্থা থেকেই গালা কিনত নির্বাচন কমিশন। শুধু ভারতই নয়, এই সংস্থার কালি ভোটের জন্য যায় পাকিস্তান থেকে ডেনমার্ক, নেপাল থেকে কানাডা, বিশ্বের অনেক দেশে।
সত্যিই কালি-সহায় মাইসুরুর এমপিভিএল সংস্থার কাছে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুধু ভোটার সংখ্যা বাড়ার জন্যই নয়, নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তিত নিয়মে এখন কালি লাগেও বেশি। আগে বাঁ হাতের তর্জনীর নখ আর চামড়ার সংযোগস্থলেই লাগানো হত। এখন লম্বা করে একেবারে নখের উপরিভাগ থেকে তর্জনীর প্রথম গাঁটের আগে পর্যন্ত।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেও স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের কালি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল এমপিভিএল। যদিও মার্চ মাস শেষের আগেই কালি তৈরির কাজ শেষ করে ফেলেছে তারা।
সূত্রের খবর, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের জন্য ২৬ লক্ষ ৫৫ হাজার শিশি কালির প্রয়োজন। যা তৈরিতে খরচ হচ্ছে ৫৫ কোটি টাকা। ১০ মিলিগ্রামের একটি শিশি থেকে প্রায় ৭০০ জন ভোটারের নখে কালি লাগানো যেতে পারে।
গত লোকসভা নির্বাচনে কালির শিশি প্রতি দাম ছিল ১৬০ টাকা। এ বছর তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৪ টাকা হয়েছে বলে খবর। কালি তৈরির উপাদানের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই কালির দামেও ফারাক পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশের লোকসভা নির্বাচনে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ বছর অন্য আরও ৬০টি দেশে কালি রফতানির কথা রয়েছে এমপিভিএল-এর ।
কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, কী থাকে এই কালিতে? কেন তা সহজে মুছে ফেলা যায় না? এর নেপথ্যে রয়েছে কঠোর গোপনীয়তা।
১৯৬২ সালে কালির ফর্মুলা তৈরি করেছিল ‘ন্যাশনাল ফিজ়িক্যাল ল্যাবরেটরি’। গোপন সেই ফর্মুলা তুলে দেওয়া হয়েছিল এমপিভিএল-এর হাতে। এখনও পর্যন্ত সংস্থা গোপনই রেখেছে সেই ফর্মুলা।
শোনা যায়, সংস্থার দু’জন কর্মী অর্ধেক অর্ধেক ফর্মুলা জানেন। এটাই নিয়ম। তাঁরা অবসর নেওয়ার আগে বিশ্বস্ত উত্তরসূরি বেছে নেন। বলে দিয়ে যান ফর্মুলার কথা। এ ভাবেই চলতে থাকে। উৎপাদনে অনেকে যুক্ত থাকলেও উপাদানের কথা কেউই পুরোটা জানতে পারেন না।
তবে মনে করা হয়, ‘সিলভার নাইট্রেট’ এই কালির অন্যতম উপাদান। এ ছাড়াও কিছু রাসায়নিক এবং রং থাকে। আর চট করে শুকিয়ে যাওয়ার জন্য থাকে অ্যালকোহল।
মূলত ‘সিলভার নাইট্রেট’ থাকার কারণেই নাকি আঙুলে লাগার পরে চামড়ার প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় আটকে যায়। আর সূর্যের আলো পেলে অতিবেগনি রশ্মির গুণে কালচে রং হয়ে আঙুলে চেপে বসে।
শুধু তা-ই নয়, ‘সিলভার নাইট্রেট’-এর পরিমাণের উপরে নির্ভর করে কত দিন সেই দাগ স্থায়ী হবে। তবে সেটা এমন পরিমাণেই দেওয়া হয়, যাতে চামড়ার কোনও ক্ষতি না হয়। ভারতে যে কালি ব্যবহার করা হয়, তা ২ থেকে ৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা’-র মতো লাগলে পরে না ছাড়ার গুণ থাকলেও ভোটের কালিকে নাকি হারানো যায়। নানা নামে বার বার ভোট দিয়ে যাঁরা গর্ব করতেন এবং করেন, তাঁদের কাছে অনেক কারসাজির কথাও শোনা যায়। কালি লাগানোর আগে ও পরে নানা কৌশলে সাফল্য সত্যিই কতটা মেলে, তা জানা না গেলেও তারও অনেক ‘গোপন’ ফর্মুলা শোনা যায়। ও সব ‘কু’জনদের কাজ। সুজনরা মনে করেন, ভোট দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার কী দরকার! বরং, আঙুলে আঙুলে লেগেই থাকুক গণতন্ত্রের গর্ব।