মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম। নাম হলগরা। যে গ্রামের শোচনীয় অবস্থা দেখে গ্রামটিকে ২০১৭ সালে দত্তক নিয়েছিলেন সে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। শোচনীয় হওয়ার কারণ— খরা এবং জল কষ্ট।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই হলগরার ভোল একেবারে পাল্টে দিয়েছেন সেই গ্রামেরই ছেলে দত্তা পাতিল। প্রদীপের তলা থেকে বার করে এনে নিজের জন্মস্থানকে রীতিমতো মডেল গ্রামে পরিণত করেছেন তিনি।
দত্তা বর্তমানে বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। চাকরি সূত্রে দেশের বাইরেই থাকেন। দীর্ঘ দিন তিনি ইয়াহুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন। থাকতেন ক্যালিফর্নিয়ায়।
ক্যালিফর্নিয়া থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে হলগরা আসতেন দত্তা। শুধু আসতেনই না, যত দিন গ্রামে থাকতেন, তত দিন গ্রামের উন্নতির স্বার্থে একের পর এক কাজ করতেন।
শাহরুখ খানের ‘স্বদেশ’ সিনেমার মোহন ভার্গবকে মনে আছে? দত্তা যেন সেই চরিত্রেরই বাস্তব রূপ।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামেরই স্কুলে পড়েছেন দত্তা। একাদশ-দ্বাদশ শহরের স্কুলে। তার পরে ইঞ্জিনিয়ারিং। বাবা-মা মোট আট একর জমির প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে তাঁকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। পড়াশোনা শেষে দত্তা চাকরি পান মাইক্রোসফটে। বেশ কিছু দিন সেই সংস্থায় কাজ করে যোগ দেন ইয়াহুতে।
ইয়াহুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিরেক্টর হতে বেশি সময় লাগেনি মেধাবী এবং পরিশ্রমী দত্তার।
ক্যালিফর্নিয়ায় থাকতে থাকতেই দত্তার মাথায় ঘুরত গ্রামের দুর্দশা ঘোচানোর নানা পরিকল্পনা। তাই প্রতি বছর জানুয়ারিতে ছুটি নিয়ে গ্রামে আসতে শুরু করেন তিনি।
২০১৬-র জানুয়ারিতে ছুটি কাটাতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, চারপাশ শুকনো। ছেলেবেলার সবুজ ঢেকে গিয়েছে ফুটিফাটা খয়েরি-কালো রঙে।
দত্তা দেখেন গ্রামের দিকে দিকে জলের অভাব। অনেকখানি পথ হেঁটে পাশের গ্রামগুলি থেকে জল আনতে হয় হলগরাবাসীদের।
গ্রামের সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করতে ইন্টারনেটে ডুব দেন দত্তা। তিনি দেখেন, সে বছরে হলগরার অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে ক্যালিফর্নিয়ার সান্টা ক্লারায়। টানা পাঁচ বছর খরাও দেখেছে সেই শহর। তবুও হলগরার মতো জলকষ্ট তো সেখানে নেই!
আরও বিস্তর লেখাপড়া করে দত্তা দেখলেন ক্যালিফর্নিয়ায় ভৌমজলের স্তর যেখানে মাত্র ৭০ ফুট নীচে, লাতুরে সেখানে জলস্তর ৮০০ ফুট নীচে।
দত্তা অবিলম্বে গ্রামে জল সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেখেন বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে গ্রামের জলের চাহিদা অনেকাংশে মিটতে পারে।
সেই সময়ে, একটি জনপ্রিয় টিভি শোয়ের তরফে জল ব্যবস্থাপনার জন্য কোন গ্রাম কী করতে পারে, তা দেখার জন্য বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সংক্রান্ত এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়।
দত্তা, তাঁর মা এবং গ্রামের কয়েক জন বন্ধুকে সেই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে জল সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় শিখতে রাজি করান।
এর পর সেই কাজে নিজেও হাত লাগান দত্তা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দত্তার পাশে এসে দাঁড়ান। এই যুদ্ধের গোড়াতেই তিনি পাশে পেয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে জল সংরক্ষণ নিয়ে কর্মরত আমির খান, কিরণ রাওদের অলাভজনক সংস্থাকে।
জল সংরক্ষণ করে গ্রামের অবস্থা ফেরাতে গাঁটের কড়ি খরচ করতেও পিছপা হননি দত্তা। উপার্জনের ১০ লক্ষ টাকা গ্রামের উন্নতিতে খরচ করেন তিনি।
এ ছাড়াও, গ্রামবাসীর প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য ইয়াহুর তরফে ৭০ লক্ষ টাকার অনুদান দেওয়া হয়। তা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন দত্তা। তাঁর এবং গ্রামবাসীদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কয়েক বছরেই চেহারা পাল্টে যায় হলগরার।
গ্রামবাসীদের গাছ লাগাতে এবং শৌচাগার তৈরি করতেও উত্সাহিত করেছিলেন দত্তা।
বর্তমানে, হলগরা ভারতের একটি মডেল গ্রাম। যেখানে ২০০ কোটি লিটারের বেশি জল সঞ্চয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।