হাজার হাজার বিদেশি নিরাপত্তা আধিকারিককে প্রশিক্ষণ দেবে চিন। বিশ্বকে যাতে আরও ‘ন্যায্য, যুক্তিসঙ্গত এবং দক্ষ’ ভাবে পরিচালনা করা যায়, তার জন্যই এই উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন চিনের জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ওয়াং জিয়াওহং।
বার্ষিক বিশ্ব নিরাপত্তা মঞ্চে ওয়াং বলেন, “যে সব দেশে দ্রুত এবং কার্যকর ভাবে নিরাপত্তা আধিকারিক এবং আইন ব্যবস্থার উন্নতির প্রয়োজন, সেই দেশগুলিতে আমরা পুলিশ প্রশিক্ষক পাঠাব।’’
সোমবার পূর্ব চিনের শহর লিয়ানয়ুঙ্গাংয়ে ১২২টি দেশ এবং ইন্টারপোলের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার আইন রক্ষাকারীদের সামনে এই ঘোষণা করেন ওয়াং।
তবে কোন দেশগুলির নিরাপত্তা আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষক হিসাবে কাদের পাঠানো হবে, সে সম্পর্কে বিশদ জানাননি ওয়াং।
কিন্তু সত্যি কি বিশ্বের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করাই চিনের লক্ষ্য? এবং তার জন্যই এত উদার হচ্ছে শি জিনপিং সরকার? না নেপথ্যে লুকিয়ে অন্য কারণ?
২০২২ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ’ (জিএসআই) চালু করেন। চিনের দাবি ছিল, জিএসআই চালু করা হয়েছে বিশ্বের ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি এবং শান্তির প্রচার’ করতে।
এ বার জিএসআই প্রকল্পের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা আধিকারিককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করল চিন। চিনের এই ঘোষণার পর তৈরি হয়েছে বিতর্কও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতেই এই পদক্ষেপ করল চিন। আবার অনেকে এ-ও মনে করছেন, বিশ্বের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আমেরিকার আধিপত্যকে শেষ করতে চাইছে চিন। সে কারণেই এই ঘোষণা।
সম্প্রতি আফ্রিকার নিরাপত্তা আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ দিতে চুক্তি করে বিশেষ প্রশিক্ষকদের পাঠিয়েছিল চিন। যদিও তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার গোষ্ঠী।
মানবাধিকার ওই গোষ্ঠীগুলির দাবি, চিনা প্রশিক্ষকেরা আফ্রিকার পুলিশ আধিকারিকদের চিন সরকারের আদলে কর্তৃত্ববাদী কৌশল চালু করার প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের আবার দাবি, যে দেশগুলিতে চিনের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে এবং যে সব দেশে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প চালু করা যাবে, শুধুমাত্র সেখানেই এই পুলিশ প্রশিক্ষকদের পাঠাতে আগ্রহী চিন। আদপেও এর সঙ্গে বিশ্ব নিরাপত্তার উন্নতির কোনও সম্পর্ক নেই।
উল্লেখ্য, ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকাকে জল, সড়ক, রেল, পাইপলাইন এবং আকাশপথে যুক্ত করতে চিনের স্বপ্নের প্রকল্প হল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প।
বেজিং আগে দাবি করেছিল ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তির ক্ষেত্রে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তি প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে জিএসআই।
পাশাপাশি বহু বার দাবি ভেসে এসেছে যে, বিগত দু’বছরে আফ্রিকা এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উন্নয়নশীল দেশগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা এবং পুলিশ চুক্তির চেষ্টা করে চলেছে জিএসআই। চিনের নতুন ঘোষণা সে দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
গত বছর চিন জানিয়েছিল, বিশ্ব নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলিতে নিরাপত্তা আধিকারিকদের জন্য আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে ইচ্ছুক জিএসআই।
সেই মতো চিন গত বছর অন্যান্য দেশের ২৭০০ জন নিরাপত্তা আধিকারিককে ইতিমধ্যেই প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলেছে বলে ওয়াং জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে বিশেষ বৈঠকে বসেছিল চিন-আফ্রিকা। সেই আলোচনার পরে বেজিং ঘোষণা করে, আফ্রিকা মহাদেশে আরও ১০০০ পুলিশ আধিকারিককে প্রশিক্ষণ দেবে চিন। যৌথ এই প্রকল্পে কর্মীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হবে।
মঙ্গলবার জননিরাপত্তা বিষয়ক চিন-মধ্য এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণ দেন ওয়াং। পাঁচটি সহযোগী দেশের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে দেখাও করেন। সেখানেও ‘আইন প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী’ করার বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
জুলাই মাসে, তিমুর লেস্টের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা বেজিং সফর করেন এবং জিনপিংয়ের সঙ্গে সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সকল স্তরে আদানপ্রদান বৃদ্ধি করা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
২০২২ সালে ‘আইন প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে’ সলোমন দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে চুক্তি করে চিন। যা আমেরিকা এবং অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলি-সহ অনেক দেশের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল।