২০০৯ সালের ১৩ মার্চ। ব্রিটেনের প্রেক্ষাগৃহে মু্ক্তি পায় ‘ব্রনসন’ ছবিটি। টম হার্ডি অভিনীত এই ছবিটি নিয়ে শুরু হয় বিপুল চর্চা। এই ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ব্রিটেনের সবচেয়ে ভয়ানক অপরাধী চার্লস ব্রনসনের জীবনের উপর ভিত্তি করে ছবিটি বানানো হয়েছে বলে দাবি করেন অনেকেই।
তবে, বড় পর্দার ব্রনসনের চেয়ে বাস্তবের ব্রনসনের জীবন অনেক অন্ধকারময়। যত বার তিনি জেলবন্দি হয়েছেন, তত বার জেলের কোনও অপরাধী, কর্মী অথবা উচ্চপদস্থ কোনও আধিকারিককে আঘাত করেছেন তিনি। কখনও সারা গায়ে মাখন লাগিয়ে জেলের ভিতর নগ্ন হয়ে ঘুরেছেন, কখনও বা জেলে বসে নিজের আঁকা ছবি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করে খবরের শিরোনামে এসেছেন চার্লস।
১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশয়্যারে জন্ম চার্লসের। তাঁর আসল নাম অবশ্য মাইকেল গর্ডন পিটারসন। ছোটবেলায় বেশ শান্ত ছিলেন মাইকেল। সকলের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতেন। কিন্তু কৈশোরে পা দেওয়ার পর বদমেজাজি হয়ে পড়েন তিনি।
এক দিন মাইকেলের মা তাঁর ঘরে গিয়ে দেখেন যে, টেবিলের উপর প্রচুর পেনসিল, রাবার এবং খাতা ছড়ানো। এত কিছু মাইকেলের কাছে কী করে এল তা নিয়ে প্রশ্ন করায় মাইকেল তাঁর মাকে জানান যে, এগুলো কেনার সামর্থ্য নেই তাই চুরি করে নিয়ে এসেছেন। ১৩ বছর বয়সে চার জন ডাকাতের সঙ্গে চুরির অপরাধে গ্রেফতার করা হয় মাইকেলকে। জুভেনাইল আদালতে হাজিরাও দিতে হয় তাঁকে।
মাঝেমধ্যেই স্কুল থেকে পালিয়ে যেতেন মাইকেল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রায়শই মারপিট করতেন। স্কুলে পড়াকালীন একটি দোকানে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। দিন কয়েক পরে ওই দোকানের ম্যানেজারকে মারধর করার জন্য চাকরি খোয়ান মাইকেল। তার পর বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করলেও কোনও চাকরিই স্থায়ী হয়নি তাঁর।
মাইকেল প্রথম বার গ্রেফতার হন গাড়ির ক্ষতি করার অভিযোগে। প্রেমিকার বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ায় পার্কিংয়ে রাখা গাড়িগুলিতে ঘুষি মারছিলেন তিনি। তার ফলে গাড়িগুলির ক্ষতি হয়। জরিমানা দিয়ে ছাড়া পান মাইকেল।
তার পর বাড়ি বাড়ি আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ করতেন মাইকেল। কিন্তু প্রতি রাতেই কোনও না কোনও ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন তিনি। লরি চুরি করে নিয়ে পালানোর সময় একটি চলন্ত গাড়িতে ধাক্কা মারেন তিনি। ধাক্কা মারার পর ঘটনাস্থলে লরি ফেলে পালিয়ে যান মাইকেল। ধাক্কা লাগার ফলে গাড়ির চালকের কোনও ক্ষতি না হলেও তাঁর গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার গ্রেফতার করা হয় মাইকেলকে।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৭১ সালে ইরেন কেলসির সঙ্গে সম্পর্কে আসেন মাইকেল। সম্পর্কে আসার ৪ মাসের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ইরেন। ১৯৭২ সালে ইরেনকে বিয়ে করেন তিনি। এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন ইরেন।
বিয়ের দু’বছর পর অস্ত্র পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হন ২২ বছরের মাইকেল। ৭ বছর জেলের শাস্তি দেওয়া হয় তাঁকে। হেফাজতে থাকাকালীন দু’জন অপরাধীকে মারধর করেন মাইকেল। তাঁকে অন্য জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তিনি।
জেলে কোনও রকম কাজ করবেন না বলে জেলের ওয়ার্কশপে ভাঙচুর চালান মাইকেল। তাঁকে শান্ত রাখার জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়া হত। সেই সময় ইরেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় মাইকেলের।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত মাইকেলকে নিয়ে অতিষ্ঠ ছিল স্থানীয় পুলিশ। একের পর এক জেলে তাঁকে সরানো হয়েছিল। কিন্তু সব জায়গায় গিয়েই সেখানকার কর্মী বা অন্য অপরাধীদের মারধর করতেন তিনি।
কখনও কাউকে কাচের বোতল ছুড়ে মারতেন, আবার কখনও কারও খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতেন মাইকেল। মানসিক হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলে বহু দিন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে জেলে সকলের থেকে আলাদা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন জেলে বসে আঁকতে শুরু করেন তিনি। সেই আঁকা আবার কোটি কোটি টাকায় বিক্রিও হয়েছিল।
প্যারোলে ছাড়া পেয়ে তিনি কুস্তির আখড়ায় নামেন। পেশার খাতিরে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন চার্লস ব্রনসন। আবার ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হন চার্লস। এ বার জেলে গিয়ে শরীরচর্চা নিয়ে একটি বই লিখে ফেলেন তিনি। চার্লসের কর্মকাণ্ড ব্রিটেনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পত্রিকা থেকে সংবাদপত্র— সব জায়গায় তাঁকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়।
কোনও এক পত্রিকায় চার্লসের ছবি দেখে তাঁকে নিয়ে লেখালেখি করতে চান বাংলাদেশের ফতেমা সাইরা রহমান। কাজের সূত্রে চার্লসের সঙ্গে দেখা করা শুরু করেন তিনি। মাত্র ১০ বার দেখা করার পর চার্লসের প্রেমে পড়ে যান তিনি। ২০০১ সালে দু’জনে বিয়ে করে ফেলেন। বিয়ের খবর জানার পর ফতেমার চাকরি চলে যায়।
বিয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে চার্লস নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন চার্লস আলি আহমেদ। কিন্তু আইনি পদ্ধতিতে নাম বদলায়নি। ৪ বছর পর ফতেমার সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং নিজের নামও বদলে ফেলেন তিনি।
জেলে থাকাকালীন সারা শরীরে মাখন লাগিয়ে নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন চার্লস। এই কাণ্ড ঘটিয়েও শিরোনামে আসেন তিনি। ২০১৭ সালে পলা উইলিয়ামসন নামে এক অভিনেত্রীকে প্রেম নিবেদন করেন তিনি। অভিনেত্রী তাঁর প্রস্তাবে রাজিও হন। কিন্তু ২০১৯ সালে পলাকে তাঁর বাড়ি থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। অভিনেত্রীর মৃত্যু এখনও রহস্য থেকে গিয়েছে।
চ্যানেল ৪ থেকে চার্লসের উপর একটি তথ্যচিত্র বানানো হয়। জানা যায়, চার্লসের পুত্রই নাকি তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ৭০ বছর বয়সি চার্লস দাবি করেন, তিনি মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। চার্লস বলেন, ‘‘দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি ২৩ ঘণ্টা কোনও মানুষকে কফিনবন্দি করে রাখা হয়, সে-ও পাগল হয়ে যাবে।’’
চার্লসের মা সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ওর এ বার ছাড়া পাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ওর কর্মের ফল এত দিনে পেয়ে গিয়েছে।’’ ৬ এবং ৮ মার্চ ‘পাবলিক প্যারোল হিয়ারিং’-এর মাধ্যমে চার্লসের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনিই ব্রিটেনের প্রথম অপরাধী যাঁর ‘পাবলিক প্যারোল হিয়ারিং’ হবে।