স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রে হোক বা মুখ্য চরিত্র— ছোট বা বড় পর্দায় নিজের চরিত্রটি কী ভাবে জীবন্ত করে তুলতে হয়, তা ভালই জানেন শেফালি শাহ। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দিল্লি ক্রাইম’ ওয়েব সিরিজ়ের ডিএসপি ভর্তিকা চতুর্বেদির চরিত্র চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কোনও সংলাপ ছাড়াই শুধুমাত্র মুখের হাবভাব দিয়েই তিনি পর্দার সিংহভাগ কেড়ে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু বলিপাড়ায় নিজের কেরিয়ার শুরুর সময় বার বার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন শেফালি। অভিনেত্রীর প্রেমঘটিত সম্পর্ক নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি বলিপাড়ায়।
১৯৭৩ সালে ২২ মার্চ মুম্বইয়ে জন্ম শেফালির। তাঁর বাবা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় (আরবিআই) কর্মরত হওয়ায় পরিবার-সহ সান্তা ক্রুজ়ে আরবিআই-এর একটি কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। শেফালির মা ছিলেন হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক। পড়াশোনার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা এবং ভরতনাট্যমে দক্ষ ছিলেন তিনি। কিন্তু অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল না শেফালির।
শেফালি যে স্কুলে পড়তেন, সেই স্কুলের এক শিক্ষিকার স্বামী নাটক লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শেফালিকে পছন্দ করেছিলেন তিনি। তাই শেফালির মায়ের অনুমতি নিয়ে শেফালিকে থিয়েটারের জন্য তালিম দিতে শুরু করেন। ১০ বছর বয়সে প্রথম নাটকের মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন শেফালি। তবে তাঁর একটি শর্ত ছিল যে, এর পর আর কখনও অভিনয় করবেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে যে তাঁকে অভিনয় নিয়েই কেরিয়ার গড়তে হবে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি।
স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর মুম্বইয়ের একটি কলেজে ভর্তি হন শেফালি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বহু গুজরাতি নাটকে পর পর অভিনয় করছিলেন তিনি। তাঁর অভিনয়দক্ষতার জন্য থিয়েটারের মঞ্চ প্রশংসা এবং হাততালিতে ভরে উঠত।
থিয়েটারে একচেটিয়া কাজ করে ভাল পরিচিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল শেফালির। হঠাৎ তিনি খবর পান যে, পরিচালক রামগোপাল বর্মা তাঁর ছবির জন্য নতুন মুখের খোঁজে রয়েছেন। খবর পেয়েই পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন শেফালি। অভিনেত্রী জানতে পারেন যে, তাঁকে ‘রঙ্গীলা’ ছবির দ্বিতীয় নায়িকা হিসাবে কাজ দেওয়া হবে। শেফালির সহ-অভিনেত্রী হিসাবে থাকবেন ঊর্মিলা মাতন্ডকর। রামগোপালের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান শেফালি।
কিন্তু ‘রঙ্গীলা’র শুটিং শুরু হতেই অন্য ছবি প্রকাশ্যে আসে। শেফালিকে যে ভাবে তাঁর চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল, এই ছবিতে তার বিন্দুমাত্র আভাস নেই। বরং ছবির মূল কেন্দ্রবিন্দু যেন ঊর্মিলাই। শেফালির অভিনয়ের তেমন সুযোগ নেই। কিছু দিন এ ভাবে কাজ করার পর কাজ থামিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। বলিপাড়ায় কানাঘুষো শোনা যায় যে, ‘রঙ্গীলা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেননি শেফালি।
হিন্দি ছবিতে কাজ করার প্রথম অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না শেফালির। এমনকি, রামগোপালের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাই মন দিয়ে থিয়েটারের জন্যই অভিনয় করতে থাকেন শেফালি। পাশাপাশি ছোট পর্দার কয়েকটি ধারাবাহিকেও অভিনয়ের সুযোগ পান তিনি। ‘তারা’, ‘বনেগি অপনি বাত’, ‘নয়া নুক্কড়’ প্রভৃতি ধারাবাহিকে কাজ করে টেলিভিশন জগতে নিজের জায়গা তৈরি করছিলেন শেফালি।
তবে, শেফালির জীবন নতুন মোড় নেয় ১৯৯৬ সালে। ‘হসরতে’ ধারাবাহিকের জন্য অভিনেত্রী সীমা কপূরের পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয় শেফালিকে। এই ধারাবাহিকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। শেফালির অভিনয় দেখে দর্শক প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।
‘হসরতে’ ধারাবাহিকে অভিনেতা হর্ষ ছায়ার সঙ্গে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল শেফালিকে। যদিও হর্ষের সঙ্গে শেফালির পরিচয় থিয়েটারজগৎ থেকেই। তখনই তাঁদের বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণত হয়। ধারাবাহিকের কাজ শুরু হওয়ার আগেই হর্ষের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন শেফালি।
‘সত্য’ ছবিতে মনোজের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল শেফালিকে। স্বল্পদৈর্ঘ্যের জন্য হলেও তাঁর চরিত্র বেশ জোরদার ছিল। কিন্তু এই ছবিতেও শেফালির বাধা হয়ে এলেন ঊর্মিলা। মুখ্য চরিত্রের জন্য ঊর্মিলাকে পছন্দ করেছিলেন রামগোপাল। ঊর্মিলা যে ছবিতে কাজ করবেন, তা-ই হিট হবে বলে ধারণা ছিল রামগোপালের। ছবি হিট করানোর জন্য ঊর্মিলাকে মুখ্য চরিত্রের জন্য বেছেছিলেন রামগোপাল।
তবে, স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রে অভিনয় করলেও ‘সত্য’ ছবির জন্য বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন শেফালি। বহু পুরস্কারও জুটেছিল অভিনেত্রীর ঝুলিতে। এর পর কখনও ছোট পর্দায় ধারাবাহিকে, কখনও বা অন্নু কপূরের সঙ্গে সহ-সঞ্চালকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে শেফালিকে।
এক সময় শেফালি এবং হর্ষের জুটি নিয়ে বলিপাড়ায় আলোচনা হত। শোনা যায় যে, ‘সত্য’ ছবিতে শেফালি কোন কস্টিউম পরবেন তা বেছে রাখতে সাহায্য করতেন হর্ষ। এমনকি, কম সময়ের জন্য অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন বলে শেফালি যখন ভেঙে পড়েছিলেন, তখন হর্ষ বলেছিলেন, ‘‘তুমি যদি আর কোনও দিন অভিনয়ের সুযোগ না পাও, তা হলেও মনখারাপ করবে না। কম সময়ের জন্য অভিনয় করলেও তুমি সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছ যে তুমি কত ভাল অভিনেত্রী।’’
২০০১ সালে শেফালি এবং হর্ষের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। দু’জনে যদিও জানিয়েছিলেন যে, মতামতের ভেদাভেদ বাড়তে থাকায় তাঁরা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু বলিপাড়ার অধিকাংশের দাবি, বিপুল অম্রুতলাল শাহের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বলেই হর্ষের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় শেফালির। ২০০০ সালে বিপুলকে বিয়ে করেন অভিনেত্রী।
২০০০ সালে আদিত্য চোপড়ার ‘মহব্বতেঁ’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শেফালি। এ ছাড়া মীরা নায়ার পরিচালিত ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসাযোগ্য ছিল। ২০০৫ সালে বিপুল পরিচালিত ‘ওয়াক্ত’ ছবিতে অক্ষয় কুমারের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শেফালি। অক্ষয়ের চেয়ে শেফালি ৫ বছরের ছোট হয়েও তাঁর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
তার পর থেকে বেশির ভাগ ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করার জন্যই ডাক পেতেন শেফালি। ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’, ‘নীরজা’র মতো বহু ছবি শুধুমাত্র এই কারণে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলিপাড়া তাঁকে মায়ের চরিত্রের জন্যই চিনুক, তা চাইতেন না অভিনেত্রী। সব সময় অন্য রকম কোনও চরিত্রের খোঁজে থাকতেন তিনি।
কানাঘুষো শোনা যায় যে, প্রকাশ মেহরা ছবিতে কাজ দেবেন বলে ছবির সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য শুনিয়েছিলেন শেফালিকে। কিন্তু অভিনেত্রী পরে জানতে পারেন যে, তাঁর পরিবর্তে অন্য নায়িকা সেই ছবির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। শেফালিকে না জানিয়েই ছবি নির্মাতারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বিধু বিনোদ চোপড়াও। ‘মিশন কাশ্মীর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শেফালিকে প্রস্তাব দেওয়ার পরেও অভিনেত্রীকে না জানিয়ে তাঁকে বাতিল করে দেন বিধু।
কিন্তু শেফালি কখনও থেমে থাকেননি। ৩ বছর বিরতি নেওয়ার পর মোনালি ঠাকুরের সঙ্গে ‘লক্ষ্মী’ শর্টফিল্মে অভিনয় করেন তিনি। ‘কার্তিক কলিং কার্তিক’, ‘কুছ লভ জয়সা’ ছবিতে কাজ করেন শেফালি। তার পর ‘দিল ধড়কনে দো’ ছবিতে অনিল কপূরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে। তারকাখচিত এই ছবিতে শেফালির অভিনয় সকলের নজর কেড়েছিল।
অতিমারির সময় ‘সামডে’ এবং ‘হ্যাপি বার্থডে মাম্মিজি’ নামে দু’টি শর্টফিল্ম বানিয়েছিলেন শেফালি। ‘জুস’, ‘ওয়ান্স এগেন’ ছবিতে অভিনয় করার পর ২০১৯ সালে ‘দিল্লি ক্রাইম’ ওয়েব সিরিজ়ে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
২০২১ সালে ‘আজীব দাস্তানস’ ছবির একটি গল্পে অভিনয় করতে দেখা যায় শেফালিকে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য ‘হিউম্যান’ ওয়েব সিরিজ় এবং ‘জলসা’ এবং ‘ডার্লিংস’ ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। ২০২২ সালে ‘ডক্টর জি’ ছবিতে চিকিৎসকের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
শেফালি পুরনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ছবির জন্য সকলে সুন্দরীদের খোঁজে থাকেন, প্রতিভার নয়। যাঁরা থিয়েটারের মঞ্চে অভিনয় করেন, তাঁদের মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে।’’ অভিনেত্রীর দাবি, তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করলেও সব সময় অন্য রকম চরিত্র দেখেই অভিনয় করায় বিশ্বাসী।
‘মিটু’ আন্দোলন চলাকালীন শেফালির স্বামী বিপুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন ‘সেক্রেড গেমস’ ওয়েব সিরিজ়ের অভিনেত্রী এলনাজ নরৌজি। এলনাজের অভিযোগ, ‘নমস্তে লন্ডন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য এলনাজকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিপুল। এমনকি, তাঁর সঙ্গে ছবির লোকেশনও পছন্দ করতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এলনাজের সঙ্গে অভব্য আচরণ করতে শুরু করেন বিপুল। অশালীন কথাবার্তাও বলেন বলে বিপুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এলনাজ। কিন্তু কোনও প্রমাণ দিতে না পারায় বিপুল নির্দোষ প্রমাণিত হন।
শেফালি ‘মিটু’ আন্দোলনকে সমর্থন করে জানিয়েছিলেন, এই আন্দোলন মহিলাদের জন্য উপকারী। কিন্তু যাঁরা এর সুযোগ নিচ্ছেন, তাঁদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন বলে দাবি করেন অভিনেত্রী।
শেফালি এবং বিপুলের দুই পুত্রসন্তান স্পেনে পড়াশোনা করেন। শুটিংয়ের ফাঁকে ছুটি কাটাতে মাঝেমধ্যেই স্পেনে সময় কাটাতে চলে যান শেফালি। অবসর সময়ে আঁকতে ভালবাসেন অভিনেত্রী। তাঁর আঁকা বহু ছবি প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে। ইনস্টাগ্রামে শেফালির অনুরাগী সংখ্যাও কম নয়। এখনও পর্যন্ত অভিনেত্রীর অনুরাগী সংখ্যা ৭ লক্ষের গণ্ডি পার করে ফেলেছে।