IC 814 - The Kandahar Hijack

ভারতের অনুরোধ সত্ত্বেও জঙ্গিদের ছেড়ে দেয় পাকিস্তান! কী ভাবে হাইজ্যাক করা হয় আইসি ৮১৪?

আইসি ৮১৪ বিমানটিকে হাইজ্যাক করে রাখা হয়েছিল সাত দিন ধরে। সেই সময়ে মানুষের হাতে হাতে ফোন ছিল না, সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রায় ছিলই না ইন্টারনেট পরিষেবা। হাইজ্যাকিংয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই খবর পেতে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখছিল গোটা ভারত।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:২৫
Share:
০১ ২৬

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘আইসি ৮১৪: দ্য কন্দহর হাইজ্যাক’। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা নিয়ে তৈরি এই সিরিজ় ইতিমধ্যেই হইচই ফেলেছে। জড়িয়েছে বিতর্কেও। বিতর্ক জঙ্গিদের কোড নাম ব্যবহার করা নিয়ে। এই বিষয়ে নেটফ্লিক্সের কাছে জবাব তলব করেছে কেন্দ্র। নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, তারা ওই হাইজ্যাকারদের আসল নাম এবং কোড নাম সিরিজ়ে যোগ করবে।

০২ ২৬

এ তো গেল সিরিজ় নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু এটা অনেকেই জানেন না, আইসি ৮১৪ হাইজ্যাক করার ঘটনা ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায়, যা ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে উৎকন্ঠায় ফেলে দিয়েছিল সারা দেশকে। অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিল ভারত।

Advertisement
০৩ ২৬

আইসি ৮১৪ বিমানটিকে হাইজ্যাক করে রাখা হয়েছিল সাত দিন ধরে। সেই সময়ে মানুষের হাতে হাতে ফোন ছিল না, সাধারণের ব্যবহারের জন্য প্রায় ছিলই না ইন্টারনেট পরিষেবা। হাইজ্যাকিংয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই খবর পেতে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখছিল গোটা ভারত।

০৪ ২৬

সাত দিন পর জঙ্গিদের হাত থেকে ওই বিমানের যাত্রীরা মুক্তি পেলেও ভারতকে যে মূল্য দিতে হয়েছিল তা ছিল চরম। বিমানযাত্রীদের বদলে তিন বিপজ্জনক জঙ্গিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওই তিন জঙ্গির মধ্যে ছিলেন কুখ্যাত জঙ্গি তথা পাক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদের প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহারও। সেই ঘটনার স্মৃতি এখনও তাড়া করে অনেক ভারতীয়কে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কন্দহর বিমান ছিনতাইকাণ্ডের সেই সাত দিন।

০৫ ২৬

১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বিকাল ৪টে নাগাদ ১৭৯ জন যাত্রী এবং ১১ জন বিমানকর্মীকে নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে আইসি ৮১৪। সাড়ে ৪টের কিছু ক্ষণ পরে সেই বিমান ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে। যাত্রীদের জলখাবার দেওয়া শুরু করেন বিমানকর্মীরা।

০৬ ২৬

৫টা নাগাদ হঠাৎ যাত্রীদের পাঁচ জন আসন থেকে উঠে রিভলভার এবং গ্রেনেড হাতে নিয়ে চিৎকার শুরু করেন। এক জন সটান ঢুকে পড়েন ককপিটে। ক্যাপ্টেনের আসনের সামনে থেকেই ঘোষণা করেন যে, বিমানটিকে ছিনতাই করা হয়েছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মতে, পাঁচ জঙ্গিকেই পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন— ইব্রাহিম আতহার, আখতার সঈদ, সানি আহমেদ কাজি, জহুর মিস্ত্রি এবং শাকির।

০৭ ২৬

হকচকিয়ে যান যাত্রীরা। অনেকে আতঙ্কে কান্নাকাটিও শুরু করেন। এর পরেই আইসি ৮১৪-এর ক্যাপ্টেন দেবী শরণ দিল্লি এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-কে বিমান ছিনতাইয়ের কথা জানান।

০৮ ২৬

তড়িঘড়ি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে হাইজ্যাকের বিষয়ে ‌অবহিত করা হয়। সঙ্কট মোকাবিলায় ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ (সিএমজি)’-কে ডেকে পাঠানো হয়। কাজ শুরু করে এনএসজিও।

০৯ ২৬

দিল্লি এটিসিকে ক্যাপ্টেন জানান যে, বিমানটিতে মাত্র এক ঘণ্টার জ্বালানি অবশিষ্ট রয়েছে। পাকিস্তানে অবতরণের অনুরোধও তত ক্ষণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

১০ ২৬

সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বিমানটিকে অমৃতসর বিমানবন্দরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তত ক্ষণে সশস্ত্র হাইজ্যাকারেরা যাত্রীদের খুনের হুমকি দিতে শুরু করেছে।

১১ ২৬

ওই দিন সন্ধ্যায় অমৃতসরে অবতরণ করে বিমানটি। সেই সময়ে জঙ্গিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা শুরু হয় কেন্দ্রের তরফে। কেন্দ্রের লক্ষ্য ছিল বিমানটিকে অমৃতসর বিমানবন্দরেই আটকে রাখা। সিএমজির তরফে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়, কোনও ভাবেই যেন বিমানটি উড়তে না পারে। বিমানের চারপাশে পঞ্জাব পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

১২ ২৬

জঙ্গিদের ক্রমাগত হুমকির কারণে জ্বালানি ভর্তি একটি ট্যাঙ্কার বিমানটির দিকে পাঠানো হয়। কিন্তু গোলমালের আঁচ পেয়ে জঙ্গিরা তড়িঘড়ি বিমানটিকে ওড়ানোর নির্দেশ দেয়। ছাড়পত্র না পাওয়া সত্ত্বেও প্রাণের ভয়ে বিমানটি অমৃতসর থেকে উড়িয়ে নিয়ে যান ক্যাপ্টেন। রানওয়েতে থাকা জ্বালানির ট্যাঙ্কারে ধাক্কা দিতে দিতে বাঁচে বিমানটি।

১৩ ২৬

ক্যাপ্টেন শরণ ভারতীয় এটিসিকে বলেন, ‘‘আমরা সবাই মরতে চলেছি।’’ এনএসজি হিন্দন এয়ারফোর্স বেস থেকে অমৃতসরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু তার আগেই বিমানটি অমৃতসর বিমানবন্দর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

১৪ ২৬

অমৃতসর থেকে পাকিস্তানের লাহোরে এসে অবতরণ করে ওই বিমান। পাকিস্তানি এটিসি প্রাথমিক ভাবে লাহোর বিমানবন্দরে বিমানটিকে অবতরণের অনুমতি দেয়নি। বিমানবন্দরের সমস্ত আলোও নিভিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বালানি কম থাকায় বিমানটির আছড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে রাত ৮টা নাগাদ বিমানটিকে লাহোরে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়।

১৫ ২৬

লাহোরে অবতরণের পর বিমানটি যাতে আর কোথাও না যেতে পারে, তা নিয়ে পাকিস্তানকে অনুরোধ করে ভারত। পাকিস্তানি বাহিনী বিমানটিকে ঘিরে ফেলে এবং নারী ও শিশুদের মুক্তির জন্য জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৬ ২৬

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ পাকিস্তানে থাকা ভারতীয় হাইকমিশনার লাহোর বিমানবন্দরে পৌঁছন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার আগেই বিমানটিতে জ্বালানি ভরে লাহোর ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ভারতের কাছে খবর আসে, বিমানের এক যাত্রী জঙ্গিদের হাতে খুন হয়েছেন। কিন্তু জঙ্গিদের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া আসেনি।

১৭ ২৬

লাহোর থেকে রওনা হওয়ার পর জঙ্গিরা ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেয় বিমান কাবুলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু রাতে অবতরণের অসুবিধার কারণে বিমানটি দুবাইয়ের দিকে উড়ে যায়।

১৮ ২৬

রাত দেড়টা নাগাদ দুবাইয়ের আল মিনহাদ বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে আইসি ৮১৪। অনেক আলাপ-আলোচনার পরে ২৭ জন যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জঙ্গিরা। দুবাইয়ে ২৭ জন যাত্রীর পাশাপাশি রুপিন কাতিয়াল নামে এক যাত্রীর দেহও পাঠানো হয়। আশঙ্কা সত্যি হয় ভারতের। জঙ্গিদের ছুরির আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল রুপিনের।

১৯ ২৬

২৫ ডিসেম্বর সকালে বিমানটি তালিবান নিয়ন্ত্রিত কন্দহর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারত এবং জঙ্গিদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয় তালিব সরকার। তবে তালিবানি শাসনকে ভারতের তরফে স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণে ভারতীয় হাই কমিশনের এক কর্তাকে কন্দহরে পাঠানো হয়।

২০ ২৬

অন্য দিকে, সশস্ত্র তালিব বাহিনী আইসি ৮১৪ বিমানটিকে ঘিরে ফেলে। তাদের দাবি ছিল, যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য ওই ব্যবস্থা করেছিল তারা। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের সামরিক বাহিনীকে ঠেকাতে ওই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

২১ ২৬

যা-ই হোক, ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত এবং বিমান ছিনতাইকারীদের মধ্যে আলোচনা চলে। ওই হাইজ্যাক নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রকে। অনিয়মিত খাবার, সীমিত জল এবং অসহ্য কষ্ট করে আটকে থাকা যাত্রীদের ভারত কেন ঘরে ফেরাতে দেরি করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

২২ ২৬

এ দিকে জঙ্গিরা নিজেদের দাবিদাওয়া জানাতে শুরু করে। প্রাথমিক ভাবে জঙ্গিরা কয়েক জন যাত্রীর বিনিময়ে মাসুদকে মুক্তির দাবি করলেও ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে জঙ্গিরা ৩৬ জন বন্দির মুক্তি, ১৯৯৯ সালে উচ্চ নিরাপত্তাযুক্ত কোট ভালওয়াল জেল থেকে পালানোর চেষ্টার সময়ে নিহত জঙ্গি সজ্জাদ আফগানির মৃতদেহ ফেরত এবং ২০ কোটি ডলার নগদের দাবি জানায়।

২৩ ২৬

শেষ পর্যন্ত, মাসুদ আজহার, ওমর শেখ এবং মুশতাক জারগার নামে তিন জঙ্গিকে মুক্তির পরিবর্তে যাত্রীদের ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় জঙ্গিরা। এই নিয়ে সরকারের মধ্যেও ভিন্ন মত উঠে আসে।

২৪ ২৬

ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আডবাণী বন্দিদের মুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। অন্য দিকে, তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ পরিস্থিতি সমাধানের জন্য তালিবানের সঙ্গে আলোচনা করার সপক্ষে যুক্তি দেন।

২৫ ২৬

১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিন বন্দিকে মুক্তি দিতে রাজি হয় ভারত সরকার। তিন বন্দিকে কন্দহরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর ছিনতাইকারীরা আইসি ৮১৪ বিমানের যাত্রীদের মুক্তি দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র তালিবানের হাতে তুলে দেয়। ভারতকে চমকে দিয়ে বিমান ছিনতাইকারী এবং মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের পাকিস্তানে পালানোর অনুমতি দেয়।

২৬ ২৬

যাত্রী এবং বিমানকর্মী মিলিয়ে ১৮৯ জনকে নিয়ে ভারতে ফিরে আসে আইসি ৮১৪। আবার ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে কাজ শুরু করে বিমানটি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিমানটি বাতিল করা হয়েছিল।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement