ভেনেজুয়েলায় আবারও ক্ষমতায় নিকোলাস মাদুরো। প্রেসিডেন্টের পদ ধরে রাখলেন তিনিই। এই নিয়ে টানা তিন বার ভেনেজ়ুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন মাদুরো। তবে তাঁর ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে উত্তাল দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ।
এক দিকে মাদুরোর প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিবাদে যেমন বিরোধী দলগুলি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেছে, তেমনই অন্য অনেক দেশ এই নির্বাচনের জেরে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে।
মাদুরোর জয় স্বীকার করতে রাজি নয় আমেরিকা। আমেরিকার দাবি, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এবং আসলে জিতেছেন বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেস উরুশিয়া।
অন্য দিকে, মাদুরোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া, চিন, কিউবার মতো দেশ। ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে মাদুরোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মাদুরোকে শুভেচ্ছাবার্তা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার সব সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক ও নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা বজায় রাখতে ভেনেজুয়েলার মতো আমরাও সমান আগ্রহী। আপনাকে রাশিয়ায় স্বাগত জানাচ্ছি, প্রেসিডেন্ট।’’
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। এ বারের নির্বাচনের আগে জনমত সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে, মাদুরোর গদি উল্টোতে পারে। ভোটে হারতে পারেন তিনি।
প্রাথমিক পর্বের ফলাফল নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তোলায় পুনরায় ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তবে রবিবার রাতে সে দেশের ইলেক্টোরাল কাউন্সিল ঘোষণা করেছে, ৬১ বছরের মাদুরো পেয়েছেন ৫১.২ শতাংশ ভোট। উরুশিয়া পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট।
বিরোধীদের দাবি, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আমেরিকাও একই সুর তুলেছে। আমেরিকার দাবি, জিতেছেন উরুশিয়া। এমনকি, জো বাইডেনের সরকার এই নির্বাচনকে মান্যতা দিতেই রাজি নয়। এর মধ্যে আবার আমেরিকার ধনকুবের ইলন মাস্ক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসেছেন মাদুরোকে।
পৃথিবীর সব থেকে বড় খনিজ তেলের ভান্ডার এবং একসময়ের অন্যতম ধনী দেশ ভেনেজুয়েলায় পরিস্থিতি কেন এমন হল?
ভেনেজুয়ালা সব থেকে বড় তেলের ভান্ডার হওয়া সত্ত্বেও সেই তেল এখন বার করতে পারে না সে দেশ। কারণ, সেই তেল বার করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষমতা যেমন তাদের নেই, তেমনই সেই তেল বার করার জন্য কোনও বেসরকারি সংস্থাও সে দেশে নেই।
ভেনেজুয়েলা এক সময় তেল বিক্রি করে এত আয় করেছিল যে, জনতার জন্য বিদ্যুৎ এবং জল বিনামূল্যে দেওয়া শুরু করে উগো চাভেসের সরকার। আমজনতাকে অনেক রকম ভাতা দেওয়াও শুরু হয়। এমনকি বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও ধীরে ধীরে সরকারের আওতায় নিয়ে আসা শুরু হয়। উগোর সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করলেও বিপদ ঘনাচ্ছিল অন্য জায়গায়।
ভেনেজুয়েলার মানুষের হাতে টাকা বেড়ে যায়। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। উগোর পর ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসেন মাদুরো।
উগো ছিলেন মাদুরোর রাজনৈতিক গুরু। মাদুরো এসে বেসরকারি তেল সংস্থা এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থাকে সরকারের আওতায় আনার কথা বললে অনেক শিল্প সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। ধীরে ধীরে আয় কমতে থাকে ভেনেজুয়েলার।
ক্ষমতায় আসার পর সে দেশের মুদ্রার দামও কমিয়ে দেন মাদুরো। সামাজিক এবং আর্থিক অবনতি হতে থাকে সে দেশের। তেলের দাম কমতে থাকে হু হু করে।
মাদুরো ক্ষমতায় থাকাকালীন ভেনেজুয়েলায় অনাহার বৃদ্ধি পায়। বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান। ২০১৮ নাগাদ মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ৮০০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশ ছাড়েন। অপরাধও বাড়তে থাকে দেশে।
ভেনেজুয়েলার আর্থিক পরিস্থিতিও তলানিতে ঠেকে। চাভেস যখন মারা যান, তখন ১১০ ডলারে তেল বিক্রি করত সে দেশ। ২০১৮ সাল নাগাদ তা নেমে দাঁড়িয়েছিল ৫০ ডলারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে গিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল রাজস্বহানি ঘটে ভেনেজুয়েলা সরকারের। দেশের অভ্যন্তরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তাঁর আমলে লিমা (দক্ষিণ আমেরিকার ১৪টি দেশের গোষ্ঠী) থেকেও ছিটকে যায় ভেনেজুয়েলা।
সেই সময়ই ভেনেজুয়েলা নিয়ে সক্রিয় হয় আমেরিকা। অভিযোগ তোলা হয়, সরকারি যন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনে বিপুল রিগিং করেছেন মাদুরো। আর্থিক ক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলার মাথার উপরে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া ঝোলানো হয়। জোর করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট— এই অভিযোগে সেই সময় সেনা পাঠানোর হুমকিও দেয় হোয়াইট হাউস।
অন্য দিকে, ২০১৯-এর নির্বাচনের আগে ভেনেজুয়েলা থেকে আমেরিকার আধিকারিকদের বেরিয়ে যেতে বলা হয়। আমেরিকাতে তখন ক্ষমতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভেনেজুয়েলা নিয়ে কঠোর হয় তাঁর সরকার।
তবে ২০১৯ সালেও মাদুরোই ক্ষমতায় আসেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনের সময় বিরোধী দলনেতা হিসাবে মাদুরোর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সে দেশের আইনসভার প্রাক্তন সদস্য মারিয়া কোরিনা মাকাদো। আমেরিকা তাঁর পাশে দাঁড়ায়।
কিন্তু পরবর্তী কালে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মাকাদোকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই থেকে বাতিল করা হয়। নির্বাচন লড়ার ক্ষেত্রে ১৫ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞাও চাপে তাঁর উপর। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তাতে সিলমোহর লাগায় ভেনেজুয়েলার সুপ্রিম কোর্ট।
মাকাদোর বদলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন উরুশিয়া। জনমত সমীক্ষায় দেখা যায়, মাদুরোকে আর ক্ষমতায় বহাল রাখতে রাজি নয় মানুষ। কিন্তু ফল বেরোতে দেখা যায় জিতেছেন মাদুরোই।
এর পরেই উত্তাল হয় সে দেশের পরিস্থিতি। বিরোধী-সহ ভেনেজুয়েলার সাধারণ নাগরিকের একাংশ দুর্নীতিতে কারচুপির অভিযোগ এনে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। আমেরিকাও মাদুরোকে প্রেসিডেন্ট মানতে অস্বীকার করেছে।
এই পরিস্থিতিতেই গত শুক্রবার বিরোধী দল ভেন্তে ভেনেজুয়েলার সদর দফতরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে মুখোশধারী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে। মাকাদোর দলের দাবি, ভোর ৩টে নাগাদ তাঁদের সদর দফতরে হামলা চালানো হয়। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর চালানোর পর গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং সরঞ্জাম চুরি করে পালিয়েছে। এর পর সে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে।
বর্তমানে মাকাদো আত্মগোপনে রয়েছেন। মাকাদোর দাবি তাঁর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে মাদুরো হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যেনতেনপ্রকারেণ মাকাদোকে গ্রেফতার করবে তাঁর সরকার।
সব মিলিয়ে সে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বেশ উত্তপ্ত। এখন সেই উত্তাপ কী ভাবে ছড়ায়, তা-ই এখন দেখার।