১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিক। দু’চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন এক ভারতীয় তরুণ। কেরিয়ার গড়তে আমেরিকায় গেলেও ওই সময় জীবনের আরও এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, প্রেমপর্বের সূচনা হয় তাঁর। কথা হচ্ছে সদ্যপ্রয়াত ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটার।
সম্প্রতি প্রকাশিত জীবনীমূলক বই ‘রতন টাটা: এ লাইফ’ অনুযায়ী, আমেরিকায় গিয়ে ১৯ বছর বয়সি কলেজপড়ুয়া ক্যারোলিন এমন্সের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন রতন টাটা।
ক্যারোলিন ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত স্থপতি ফ্রেডরিক আর্ল এমন্সের কন্যা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁর সূত্র ধরেই ক্যারোলিনের সঙ্গে পরিচয় হয় রতনের।
প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চলেছিলেন। কিন্তু ভারত-চিন যুদ্ধ সেই প্রেমকে পরিণতি পেতে দেয়নি। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর ঠাকুমার কাছে বেড়ে ওঠা রতনের। তার পর আমেরিকা যাত্রা, সেখানেই প্রেমপর্ব।
রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাঁর বাবা নাভাল ও মা সুনি টাটার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরে সুনি আবার বিয়ে করেন। যা নিয়ে রতনকে বেশ কিছু ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যের মুখে পড়তে হয় ছোটবেলায়। ঠাকুমা নাভাজবাই টাটার কাছে বেড়ে ওঠেন রতন।
স্কুল পাশ করে আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করতে যান রতন। কিন্তু পড়াশোনা, বাদ্যযন্ত্র শেখার মতো নানান বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বাবার বিস্তর মতপার্থক্য ছিল। তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে ব্রিটেনে পড়াশোনা করুক । কিন্তু রতন চাইতেন আমেরিকায় পড়াশোনা করতে।
বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে পিয়ানো শিখুক আর রতনের ভালবাসা ছিল ভায়োলিন। বাবা চাইতেন ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করুক, আর রতনের টান ছিল আর্কিটেকচারের দিকে। শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকায় পড়াশোনা করেন ঠিকই, তবে ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, তাঁর পছন্দের বিষয় আর্কিটেকচার নিয়েই।
নিউ ইয়র্কে অবস্থিত এই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচারে ডিগ্রি পাওয়ার পর লস অ্যাঞ্জেলসে একটি সংস্থায় চাকরি করেন রতন টাটা। সেখানে নিজের পয়সায় গাড়ি কেনেন। নিজের কাজ, লস অঞ্জেলসের আবহাওয়া— সবই তাঁর বেশ পছন্দের ছিল।
বেশ ভালই কাটছিল তাঁর দিন। দু’বছর ওই সংস্থায় চাকরি করেন। সেই সময়ই তিনি প্রেমে পড়েন ক্যারোলিনের। তাঁকে বিয়ে করতেও চেয়েছিলেন।
টমাস ম্যাথুর লেখা রতন টাটার ওই জীবনী অনুযায়ী, যুবা রতনকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন ক্যারোলিন। টাটাকে তাঁর ‘প্রথম সত্যিকারের প্রেম’ হিসাবেও বর্ণনা করেছিলেন।
রতনকে দেখে ভাল লেগে গিয়েছিল ক্যারোলিনের বাবা-মায়েরও। ম্যাথু লিখেছেন, উভয় পরিবারের সমর্থন ছিল রতন-ক্যারোলিনের সম্পর্কে।
ইতিমধ্যে ঠাকুমার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। রতন টাটা ফিরে আসেন দেশে। আশা করেছিলেন, যাঁকে তিনি ভালবাসেন, সারা জীবন যাঁর সঙ্গে কাটাতে চান, সেই মহিলাও তাঁর সঙ্গে ভারতে চলে আসবেন।
কিন্তু ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ক্যারোলিনের বাবা-মা চাননি তাঁদের মেয়ে ভারতে যান । এক মাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের জেরে ক্যারোলিনের পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ফলে ক্যারোলিনের ভারত সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত সেই প্রেমের সম্পর্ক ভেঙেই যায়। পরিণতি লাভ করেনি। ম্যাথু তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “মাত্র এক মাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলেও একজন আমেরিকা নিবাসীর কাছে পরিস্থিতি খুব জটিল বলে মনে হয়েছিল। তাই দু’জনে আলাদা হয়ে যান।”
ক্যারোলিন শেষ পর্যন্ত স্থপতি তথা বিমানচালক ওয়েন জোনসকে বিয়ে করেছিলেন। ম্যাথুর লেখা অনুযায়ী, ওয়েনের সঙ্গে রতনের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন ক্যারোলিন। আর সেই কারণেই ওয়েনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি।
বিয়ে না হলেও রতন-ক্যারোলিনের বন্ধুত্বের সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। ২০০৭ সালে ‘দ্য দার্জিলিং লিমিটেড’ নামে একটি হলিউডি ছবি দেখার সময় রতনের ভাবনা অপ্রত্যাশিত ভাবে ক্যারোলিনের মাথায় আসে।
এর পরেই রতনকে অনলাইনে খুঁজতে শুরু করেন ক্যারোলিন। রতন তখন টাটা সন্স এবং টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। ২০০৮ সালে ইমেল মারফত রতনের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয় ক্যারোলিনের। ভারত সফরের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন তিনি। ভারতে ঘুরতেও আসেন।
প্রথম বার ভারতে এসে পাঁচ সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন ক্যারোলিন। নতুন করে বন্ধুত্ব শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। এর পর নিয়মিত একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন রতন এবং ক্যারোলিন। ২০১৭ সালে টাটার ৮০তম জন্মদিন উদ্যাপন করতে ক্যারোলিন নাকি আবার ভারতে এসেছিলেন।
ম্যাথু উল্লেখ করেছেন, ক্যারোলিন এবং রতনের বন্ধুত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও গভীর হয়। ২০২১ সালে রতনের সঙ্গে দেখা করতে শেষ বার ভারতে এসেছিলেন ক্যারোলিন। রতন টাটাও যখনই আমেরিকা যেতেন, তখনই ক্যারোলিনের সঙ্গে দেখা করতেন।
টাটার সঙ্গে ক্যারোলিনের প্রেমের কাহিনি, যা ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে আকস্মিক ভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। গত ৯ অক্টোবর মৃত্যু হয় ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পপতি রতনের। তার আগে পর্যন্ত ক্যারোলিনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব অটুট ছিল।