পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক আব্দুল কাদির খান। তাঁর হাত ধরেই পরমাণু শক্তিতে পাকিস্তান ভারতের সমতুল্য হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু পাকিস্তানে নায়ক হলেও বহির্বিশ্বের কাছে তিনি ছিলেন খলনায়ক।
বিশ্বের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন কাদির। সেই কারণে তাঁকে পাকিস্তানে জাতীয় বীরের সম্মান দেওয়া হয়।
১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের ভোপালে জন্ম কাদিরের। দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। তখন কাদিরের বয়স মাত্র ১১ বছর।
পাকিস্তানেই কাদিরের পড়াশোনা। ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে পাশ করেন তিনি। এর পর ধাতুবিদ্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বার্লিন চলে যান।
উচ্চশিক্ষার জন্য নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামেও গিয়েছিলেন কাদির। বিভিন্ন দেশ থেকে নানা ভাবে পরমাণুবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
পাকিস্তানের পরমাণু বোমা তৈরিতে কাদিরের প্রধান অবদান হল ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের ব্লু-প্রিন্ট সংগ্রহ করা। যার মাধ্যমে পরমাণু বোমার জন্য ইউরেনিয়ামের জ্বালানি তৈরি করা যায়।
৮৫ বছরের জীবনে কাদিরের নামের সঙ্গে সম্মানের পাশাপাশি জড়িয়ে ছিল বিতর্কও। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। দীর্ঘ সময় বন্দি হয়ে কাটাতে হয় তাঁকে।
অভিযোগ, ইউরেনিয়ামের ব্লু-প্রিন্টটি কাদির নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে চুরি করেছিলেন। সেখানে একটি প্রকল্পে কাজের সূত্রে সেটি তাঁর হাতে এসেছিল। ১৯৭৬ সালে যা তিনি পাকিস্তানে নিয়ে আসেন।
কাদির দেশে ফেরার পর পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের দায়িত্ব দেন। ১৯৭৮ সালের মধ্যে প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন কাদির।
পরবর্তী সময়ে সাক্ষাৎকারে কাদির জানিয়েছিলেন, ১৯৮৪ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে পরমাণু শক্তিধর হিসাবে তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সরকার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ চাননি।
অবশেষে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায়। আন্তর্জাতিক মহলে যার কড়া প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। পশ্চিমি দুনিয়া পাকিস্তানের উপর একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। যা দেশটির অর্থনীতিকে ধাক্কা দেয়।
কাদিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পরমাণু বোমা তৈরির প্রযুক্তি গোপনে অন্য দেশের হাতে তুলে দিয়েছেন। ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু বোমা তৈরির সূত্র দিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
পরমাণু প্রযুক্তি হস্তান্তরের অভিযোগে ২০০৪ সালে কাদিরকে গ্রেফতার করা হয়। পশ্চিমি দুনিয়ার চাপে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়েই তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছিল পাক সরকার।
কাদির পরে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে গৃহবন্দি দশা থেকে তাঁকে মুক্তি দেয় পাকিস্তানের আদালত।
কিন্তু মুক্তি পেলেও জীবনের বাকি সময়টুকু কড়া নজরদারিতে কাটিয়েছেন কাদির। তাঁর সঙ্গে সর্ব ক্ষণ নিরাপত্তারক্ষী থাকতেন। তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখা হত।
ভারতকে একাধিক বার পরমাণু বোমা সংক্রান্ত হুমকি দিয়েছেন কাদির। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণের স্মৃতিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময়ে তাঁর মন্তব্য বিতর্কের ঝড় তোলে।
কাদির বলেছিলেন, ‘‘পাঁচ মিনিটে দিল্লিতে পরমাণু হামলা চালাতে পারে পাকিস্তান। ভারতের রাজধানীকে ছাই করে দিতে সময় লাগবে মাত্র পাঁচ মিনিট।’’ ভারত অবশ্য তার উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিয়েছিল।
কাদির নিজেই স্বীকার করেছিলেন, পাকিস্তানকে পরমাণু শক্তিধর করে তুলতে অন্য দেশের সাহায্য নিতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে থেকে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব ছিল না। এর জন্য বিশ্বের বাজারে তাঁকে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল।
কাদির দাবি করেন, তিনিই পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা। এক বার নয়, একাধিক বার তিনি দেশকে রক্ষা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পাকিস্তানকে প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পরমাণু শক্তিধর করে তুলে আমি দেশকে প্রথম বার রক্ষা করেছিলাম। পরে চুরির দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে আমি আবার আমার দেশকে বাঁচাই।’’
কাদির বিশ্বাস করতেন, পরমাণু প্রযুক্তিই আধুনিক সময়ে আত্মরক্ষার প্রধান হাতিয়ার। পাকিস্তানকে বাধ্য হয়েই এই শক্তি অর্জন করতে হয়েছে। তবে পশ্চিমি দুনিয়ার চোখে তিনি ‘শত্রু’ হিসাবেই থেকে গিয়েছেন।
২০০৬ সালে কাদিরের শরীরে বাসা বেঁধেছিল মারণরোগ। মূত্রথলির ক্যানসার ধরা পড়েছিল তাঁর। যদিও অস্ত্রোপচারের পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
২০১২ সালে নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পা রাখার চেষ্টা করেছিলেন কাদির। নিজের একটি দল গড়েছিলেন। কিন্তু সফল হননি। দলটি নিজেই উঠিয়ে দেন।
২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ইসলামাবাদের হাসপাতালে মৃত্যু হয় কাদিরের। কোভিড সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল তাঁকে। ৮৫ বছর বয়সে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।