আবারও অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের দেশ কঙ্গোয়। উত্তর-পশ্চিম কঙ্গোয় অজানা রোগে ৫৩ জন মারা গিয়েছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। হু-র দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ প্রকাশের পর থেকে মৃত্যুর সময় মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞেরা।
গত ২১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪১৯ জনের শরীরে থাবা বসিয়েছে প্রাণঘাতী এই অজ্ঞাত রোগটি। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই অসুস্থ বোধ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা গিয়েছেন। অজ্ঞাত রোগটি গত পাঁচ সপ্তাহে ৫০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
হু-র আফ্রিকাস্থিত দফতর জানিয়েছে, প্রথম ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে বলোকো শহরে। তিনটি শিশু বাদুড়ের মাংস খাওয়ার পরে অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে। দু’দিনের মধ্যেই মারা যায় তারা। ১৩ ফেব্রুয়ারি বুমায় একসঙ্গে ৪০০ জনের বেশি ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর। ইকুয়েটুর প্রদেশের দু’টি শহরের অধিবাসীরাই মূলত আক্রান্ত হচ্ছেন এই রহস্যময় অসুখে।
কঙ্গোর সংক্রমণে আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছে জ্বর, বমি ও শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রোগী ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। চিকিৎসার বিশেষ সময়টুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। আর এই বিষয়টিই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের।
রোগীদের দেহে উপসর্গ দেখার পরে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। বিকোরো হাসপাতালের চিকিৎসা অধিকর্তা সার্জ এনগালেবাটো জানিয়েছেন যে, লক্ষণ প্রকাশ এবং মৃত্যুর মধ্যে সংক্ষিপ্ত ব্যবধান বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক পরে এই রোগটির সঙ্গে আরও লক্ষণ যুক্ত করেছে যার মধ্যে রয়েছে ডায়েরিয়া, ব্যথা, তীব্র তৃষ্ণা এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা। রোগটি এখনও অজানা। তবুও লক্ষণ দেখে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘ক্রাইং ডিজ়িজ়’। কঙ্গোর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আক্রান্তদের প্রায় ৮০ শতাংশের জ্বর, ঠান্ডা লাগা, শরীর ব্যথা এবং ডায়েরিয়া হচ্ছে।
অসুস্থতার সঠিক উৎপত্তি এবং প্রকৃতি এখনও অজানা। গবেষকেরা রহস্যময় এই অসুস্থতার ‘হেমোরেজিক ফিভারে’র লক্ষণগুলি শনাক্ত করার পর ধারণা করেছিলেন, এর পিছনে মারাত্মক কোনও ভাইরাস দায়ী হতে পারে। সেই ভাইরাস যা সাধারণত ইবোলা, ডেঙ্গু এবং পীত জ্বরের মতো মারাত্মক রোগের ভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এক ডজনেরও বেশি নমুনার উপর পরীক্ষা চালানোর পর বিজ্ঞানীদের নজরে এসেছে পরিচিত ভাইরাসগুলি এই রোগের কারণ নয়। কোনও অজানা প্রকৃতির ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া এই রোগের জন্য দায়ী কি না তা জানার জন্য নিরন্তর গবেষণা চালাচ্ছেন তাঁরা। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে হু-ও। আন্তর্জাতিক এই স্বাস্থ্য সংস্থার এক জন মুখপাত্র জানিয়েছেন, জনস্বাস্থ্যের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এই রোগটি।
এর প্রধান কারণ আক্রান্ত গ্রামগুলোতে নজরদারির অভাব এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত পরিকাঠামো। যদি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না করা হয়, তা হলে ক্রমবর্ধমান রোগীর সংখ্যা জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে। মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তিনি জানান, বাদুড় থেকেই এই রোগটি ছড়িয়েছে কি না, তা এখনও সঠিক ভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
অন্য প্রাণীর দেহ থেকে লাফ দিয়ে ভাইরাস ও অন্যান্য সংক্রামক জীবাণুর মানুষের দেহে ঢুকে পড়াকে বলা হয় ‘জ়ুনোটিক ট্রান্সফার’। গত কয়েক বছরে যত ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে, তা এই কারণেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশুপাখিদের শরীর থেকে ভাইরাস বা জ়ুনোটিক ভাইরাস ছড়াচ্ছে বেশ কয়েকটি দেশে।
এমনও হতে পারে, কোনও নতুন ভাইরাস রোগ ছড়াচ্ছে, অথবা চেনা ভাইরাস তার রূপ বদলে সংক্রামক হয়ে উঠছে। কিন্তু তা কোন ভাইরাস বা কেমন হতে পারে সেই অজানা রোগ, এ ব্যাপারে এখনও অবধি কিছুই বলতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। অপরিচিত সেই ভাইরাস কতটা সংক্রামক তা-ও অজানা।
বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে জীবাণু সংক্রমণ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে উদ্বেগ রয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। বিশেষত যে সব অঞ্চলে বন্যপ্রাণী খাদ্য হিসাবে জনপ্রিয়, সেখানে এই আশঙ্কা বেশি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। হু জানিয়েছে, ২০২২ সাল থেকে আফ্রিকায় এ ধরনের রোগ দ্রুত বাড়ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসই এর জন্য দায়ী।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, গত এক দশকে আফ্রিকায় পশুপাখি খাওয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রোগের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা উদ্বেগের। ২০১৮ সালে হু চিহ্নিত সংক্রামক রোগের তালিকায় বলা হয়েছিল, পশুদের থেকে যে সমস্ত ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ হয়েছে, তেমনই কোনও ভাইরাস ফের তার জিনোমের গঠন দ্রুত বদলে ফিরে আসতে পারে।
কঙ্গোর ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রমণ হল ইবোলা। ভাইরাসটি প্রথম ধরা পড়েছিল ১৯৭৬ সালে কঙ্গো ও সুদানে। সে বার প্রায় ৭০০ লোক মারা গিয়েছিলেন ইবোলার ছোবলে।
ভাইরাসটির মূল বাহক এক প্রজাতির ফলখেকো বাদুড়। তারা ভাইরাসটি বহন করে, তবে নিজেরা আক্রান্ত হয় না। পরে ওই বাদুড় থেকে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে রোগ সংক্রামিত হয়। কোনও ভাবে আক্রান্ত প্রাণীদের মাংস খেয়ে ফেললে বা সংস্পর্শে এলেই ইবোলা ভাইরাসটি চুপিসাড়ে ঢুকে পড়ে মানবদেহে।
মাত্র কয়েক মাস আগে, ডিসেম্বরে কঙ্গোয় আরও একটি অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সেখানকার পাঞ্জি অঞ্চলে অজানা সংক্রমণে ৩৯৪ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র পক্ষ থেকে এই রোগ ছড়ানোর খবরে সিলমোহর দেওয়া হয়। হু জানিয়েছিল, এই রোগে ৩০ জন মারা যান।
তারও আগে কঙ্গোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোয়াঙ্গো প্রদেশে একটি অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়ে, যা ম্যালেরিয়ার একটি গুরুতর রূপ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, নাক দিয়ে জল পড়া এবং শরীরে ব্যথার কারণে এই রোগে নভেম্বরে ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে ১৯৬০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৩৩৫টি রোগে বিধ্বস্ত হয়েছে সভ্যতা, যার মধ্যে ৬০ শতাংশই বন্যপ্রাণীদের থেকে এসেছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই মুহূর্তে প্রতিকারের ব্যবস্থা যে হেতু নেই, তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই জোরদার করা হোক। এড়িয়ে চলা হোক বন্য পশুপাখির মাংস ভক্ষণ।