অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকেও ২৭ কোটি ৯০ লক্ষের মতো টাকা উদ্ধার হয়েছে। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে ৪.৩১ কোটি টাকার সোনা। বুধবার দুপুরে বেলঘরিয়ার ওই ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে ঢোকেন ইডির তদন্তকারী অফিসারেরা। এর পর টাকা উদ্ধার করে গুনতে গুনতে পার ১৯ ঘণ্টা। বুধবার দুপুর থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টে পর্যন্ত চলে তল্লাশি অভিযান।
বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বার করে আনা হয় রাজ্যের নিয়োগ ‘দুর্নীতি’ মামলায় ধৃত শিল্পমন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ঘেরাটোপে দু’জনকে আলাদা আলাদা গাড়িতে নিয়ে গিয়ে জোকার ইএসআই হাসপাতালে স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য ভর্তি করানো হয়। এর কিছু পরেই সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরোয় ইডি আধিকারিকদের তিনটি দল।
সে সময় প্রশ্ন দানা বাঁধছিল পার্থ-অর্পিতাকে বার করে আবার কোথায় যাচ্ছে ইডি?
বুধবার বেলা ১২টার কিছু ক্ষণ আগে অর্পিতার বেলঘরিয়ায় ফ্ল্যাটে পৌঁছন ইডির আধিকারিকরা। রথতলা এলাকার ওই অভিজাত আবাসনে অভিযান চালানোর সময় সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ থাকায় ঢুকতে পারেননি তদন্তকারীরা। চাবির খোঁজ করতে শুরু করেন তাঁরা।
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ফ্ল্যাট খোলা যায় কি না, তারও চিন্তাভাবনা শুরু করেন ইডি আধিকারিকরা। ওই একই আবাসনের অন্য একটি ব্লকে অর্পিতার আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে ইডির কাছে খবর ছিল।
এরই মধ্যে কসবায় অর্পিতার রাজডাঙার বিনোদন সংস্থার অফিস ‘ইচ্ছে এন্টারটেইনমেন্ট’-এ যায় ইডির একটি দল। অর্পিতা ওই সংস্থার ডিরেক্টর বলেও দাবি ইডির। তবে রঞ্জিত কর নামে কসবার এক স্থানীয় কেব্ল ব্যবসায়ীর দাবি, ৯৫ রাজডাঙা রোড ঠিকানাটি তাঁর। অর্পিতার অফিসটির ঠিকানা আসলে ভুয়ো বলেও তিনি দাবি করেন। ইডি সূত্রে আরও খবর, অর্পিতার সংস্থার তথ্য এবং ঠিকানা পাওয়া যায় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতেই। যদিও সেই তথ্যের সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি।
ইডির অন্য একটি দল পৌঁছয় বেলঘরিয়ায় অর্পিতার মায়ের বাড়িতে। সেখানেও চলে তল্লাশি।
ইতিমধ্যে বেলঘরিয়ায় অর্পিতার ফ্ল্যাট খোলার জন্য চাবিওয়ালাকে ডেকে আনা হয়। কাজের কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওই ফ্ল্যাটে ইডি আধিকারিকরা ঢোকেন তালা ভেঙে। কিন্তু বিশেষ কিছু না পাওয়া যাওয়ায় সেই ফ্ল্যাটটিকে ‘সিল’ করে দেন আধিকারিকরা।
হানা দেওয়া হয় ওই আবাসনে থাকা অর্পিতার দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে। ভিতরে ঢুকে তল্লাশি অভিযান শুরু করেন আধিকারিকরা।
দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে ঢোকার কিছু ক্ষণ পরই ইডি আধিকারিকদের আরও একটি দল চলে আসে বেলঘরিয়ায়। আবাসন চত্বরে বাড়তে থাকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সংখ্যাও। গ্রেফতার হওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগেও অর্পিতা এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন বলে দাবি করেন আবাসনের অন্য আবাসিকরা।
এর পর সন্ধ্যা সওয়া ৬টা নাগাদ ইডি আধিকারিকরা অর্পিতার বেলঘরিয়ার আবাসনে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা গোনার মেশিন চেয়ে পাঠানোতেই তৈরি হয়েছে জল্পনা। ব্যাঙ্ককর্মীদের একটি দল নোট গোনার মেশিন নিয়ে পৌঁছন সেই ফ্ল্যাটে।
ওই অভিজাত আবাসন থেকে আবারও টাকার খোঁজ পান তদন্তকারী আধিকারিকরা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয় নোট গোনা।
চারটি নোট গোনার যন্ত্র দিয়ে প্রথম রাউন্ড শেষে ২০ কোটি টাকা গোনা শেষ করেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। উদ্ধার হয় প্রচুর সোনার বাট ও গয়নাও। টাকা গোনা শেষ হতে রাত কাবার হয়ে যাবে বলেও মনে করা হয়। পাশাপাশি, ওই ফ্ল্যাট থেকে বেশ কিছু দলিল পাওয়া গিয়েছে বলেও ইডি সূত্রে খবর।
বুধবার রাত ১১টা নাগাদ টাকা নিয়ে যেতে বেলঘরিয়ার ক্লাব টাউন হাইটস আবাসনে নিয়ে আসা হয় ট্রাক। সেই ট্রাকে থাকা ২০টি ট্রাঙ্কে উদ্ধার হওয়া টাকা ভরে নিয়ে যাওয়ার কথায় চিন্তা করেন ইডি আধিকারিকেরা।
ট্রাক আসার কিছু পর অর্পিতার ফ্ল্যাটে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার আরও দু’জন কর্মী আসেন। ইডি দাবি করে, অর্পিতার বাড়িতে আরও নগদ অর্থ রয়েছে। আর তা গোনার জন্যই আরও দু’জন ব্যাঙ্ককর্মীকে ডেকে আনা হয়েছে বলেও জল্পনা শুরু হয়।
ইডি সূত্রে জানা যায়, শুধু ওয়াড্রোব থেকে নয় টাকা উদ্ধার হয়েছে ওই ফ্ল্যাটের শৌচাগার থেকেও। সেখানে ব্যাগে, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রাখা ছিল ওই টাকা। একই সঙ্গে জানা গিয়েছে, ওই ফ্ল্যাট থেকে যা সোনা উদ্ধার হয়েছে, তাতে গয়নার থেকে বাট বেশি।
অবশেষে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টে নাগাদ নোট গণনা শেষ হয়। প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে বেলঘরিয়ায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে চলে উদ্ধার হওয়া টাকা গোনার কাজ। তবে তখন রাজ্যবাসীর মনে উঁকিঝুঁকি মারছিল একটাই প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত কত টাকা উদ্ধার হল ওই ফ্ল্যাট থেকে?
ইডির একটি সূত্র জানায়, উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ অর্পিতার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া ২২ কোটিকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ইডি-র কোনও কোনও সূত্র জানায়, বেলঘরিয়ায় উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২৫ থেকে ২৯ কোটির মধ্যে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী আবাসন কমিটির সম্পাদক অঙ্কিতের মতে, উদ্ধার হওয়া নগদ টাকার পরিমাণ ২৭.৯০ কোটি। পরে ইডি সূত্রে জানা যায়, উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২৭.৯০ কোটিই। ৪.৩১ কোটি টাকার সোনা (বাট বেশি, গয়না কম) উদ্ধার হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৩২ কোটির সম্পত্তি। তবে, এ ক্ষেত্রেও বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত ইডির তরফে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি বা ‘সিজার লিস্ট’ দেওয়া হয়নি। তত ক্ষণে সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে টাকার স্তূপের ছবি-ভিডিয়ো।
এর আগে অর্পিতার টালিগঞ্জের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয়েছে ২১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। সেই সঙ্গে বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা, সোনাদানা। তার মূল্যও কোটির অধিক। তার পর থেকেই ইডির তদন্তকারীদের নজর ছিল অর্পিতার বেলঘরিয়ার ক্লাব টাউন হাইটসের ফ্ল্যাটের দিকে।
অর্পিতার টালিগঞ্জ এবং বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট মিলিয়ে উদ্ধার হওয়া নগদের পরিমাণ ৪৯.৮ কোটি। তা-ও আবার নগদে উদ্ধার করা হয়েছে। নিজেকে অভিনেতা বলে দাবি করা অর্পিতার কাছে কী এত টাকা থাকা সম্ভব, এই প্রশ্ন নিয়ে জোর চর্চা।