বিদেশে নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে ডিগ্রি লাভের স্বপ্ন অনেক পড়ুয়াই দেখেন। পছন্দের দেশগুলির মধ্যে অন্যতম কানাডা। বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের সময় অনেকেরই ঝোঁক থাকে কানাডার দিকে।
প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ ভারতীয় ছাত্র উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করতে কানাডায় পাড়ি দেন। কেন্দ্রীয় সরকারের গত অগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ভারতীয় পড়ুয়া বর্তমানে বিদেশে পাঠরত। তার মধ্যে শুধু কানাডাতেই ৪ লাখের উপরে।
২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কানাডায় পড়তে যাওয়া ভারতীয় পড়ুয়াদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬০ শতাংশ। গত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সে দেশে যাওয়া বিদেশি পড়ুয়াদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই ভারতীয়। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, সে দেশের মোট বিদেশি পড়ুয়ার অন্তত ৩৭ শতাংশই ভারতীয়।
২০২৫ সাল থেকে স্টুডেন্ট ভিসা ১০ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাস্টিন ট্রুডোর সরকার। এরই মাঝে আরও এক সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গিয়েছে, কানাডায় আসার পর প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থীর কোনও খোঁজ নাকি পায়নি সে দেশের সরকার। এই শিক্ষার্থীরা কোথায় আছেন তার কোনও রেকর্ড কানাডা সরকারের কাছে নেই।
কানাডা এবং ভারত, উভয় দেশকেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এই ঘটনা। কানাডার ‘ইমিগ্রেশন নিউজ়’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ‘ইমিগ্রেশন, রিফিউজ়ি অ্যান্ড সিটিজ়েনশিপ কানাডা’ বা ‘আইআরসিসি’ জানিয়েছে ৩৫৯,৭৮১ জন ভারতীয় শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯,৫৮২ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য কানাডায় পৌঁছোনোর পর তাঁরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করাননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব ‘নিখোঁজ’ ছাত্রদের অনেকেই আইআরসিসি-কে না জানিয়েই কলেজ পরিবর্তন করেছেন। অনেকে আবার পড়াশোনা ছেড়ে কানাডাতেই কাজ করা শুরু করেছেন। তাই তাঁদের তথ্য দিতে পারেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি। আর আইআরসিসি-র পরিসংখ্যান পুরোপুরি নির্ভর করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির দেওয়া তথ্যের উপরেই।
টাইম্স অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডায় থাকার খরচ বহন করার জন্য বেশির ভাগ শিক্ষার্থী স্টুডেন্ট ভিসার অপব্যবহার করে অদ্ভুত সব চাকরি বেছে নিয়েছেন। আর এঁদের মধ্যে যাঁরা সত্যিই পড়াশোনা করার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে এ দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন তাঁরা পড়েছেন বিপদে।
সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আসনসংখ্যা সীমিত হয়ে যাওয়ায় ভর্তি হতে পারেননি অনেক ভারতীয় পড়ুয়াই। তাঁরাই বিদেশি ডিগ্রি লাভের আশায় স্বল্পপরিচিত কলেজগুলির ভর্তির প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। আর এখানেই ঘটেছে বিপত্তি। কানাডায় গিয়ে ভর্তির সময় তাঁরা কলেজে যোগাযোগ করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন এই কলেজগুলির অধিকাংশই ভুয়ো। আবার কিছু কলেজে সমস্ত আসন ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
এই ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় ভুক্তভোগী হরিয়ানার পঞ্চকুলার ২৪ বছর বয়সি এক ছাত্র। তিনি কানাডায় পৌঁছোনোর পর ব্র্যাম্পটনের একটি কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান। তাঁর ভর্তির চিঠিতে যে ঠিকানা লেখা ছিল সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন সেটি কোনও কলেজ নয়, একটি ছোট অফিস মাত্র।
সেখানে তাঁকে বলা হয় সমস্ত আসন ভর্তি। তাঁকে অপেক্ষা করতেও বলা হয়। এক সপ্তাহ কেটে গেলেও সেখান থেকে ভর্তির ডাক আসেনি। তখন ওই ছাত্র বুঝতে পারেন কলেজটি জাল। বছরের মোট ১২ লক্ষ টাকার টিউশন ফি থেকে ৪.২ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছিলেন। তাঁর হাতে বিশেষ টাকা না থাকায় নিজের খরচ চালানোর জন্য স্থানীয় একটি পেট্রল পাম্পে কাজ শুরু করেন।
গুজরাতের বলসাডের ২৭ বছর বয়সি যুবক স্বীকার করেছেন যে, তিনি দু’বছরের জন্য সাড়ে সাত লক্ষ টাকা ফি দিয়ে একটি কমিউনিটি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। কানাডায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করতে যে খরচ লাগে, কমিউনিটি কলেজে খরচ তার চেয়ে কম। তবে এটি বিদেশের ছাত্রদের জন্য অবৈধ।
কানাডায় বহু ছাত্র রয়েছেন যাঁদের মাথার উপর ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা চেপে রয়েছে। সেই ঋণ শোধ করার জন্য বেআইনি ভাবে উপার্জন করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। অনেক ভারতীয় শিক্ষার্থীই কানাডায় আসার পর বুঝতে পেরেছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার পর তাঁরা সেখানে ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বা চাকরির ছাড়পত্র পাবেন না। কানাডায় ওয়ার্ক পারমিট না থাকলে বৈধ ভাবে কোথাও কাজ করা সম্ভব নয়।
মূলত গুজরাত, পঞ্জাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা এবং মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলি থেকে সে দেশে যাওয়া ছাত্রদের অধিকাংশই অন্তত দু’টি শিফ্টে চাকরি করেন। কেউ রেস্তরাঁ, কেউ ডেলিভারি সংস্থার কর্মী হিসাবে কাজ করে থাকেন ও ঘণ্টায় ডলারের হিসাবে রোজগার করেন।
কিছু শিক্ষার্থী কলেজের দ্বারা প্রতারিত হলেও, অনেকেই ইচ্ছাকৃত ভাবে কানাডায় পাড়ি জমান মোটা রোজগারের আশায়। আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার পড়তে হলে পড়ার খরচ পুরোপুরি জমা দিলে তবেই সে দেশের কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়।
কানাডায় বিদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের আগে থেকে পুরো টিউশন ফি জমা দিতে হয় না। এই নীতির কারণে পড়তে আসার নাম করে শিক্ষার্থীরা বড় বড় শহরে অবৈধ ভাবে বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করেন। বেশ কিছু ছাত্র অবৈধ ভাবে আমেরিকায় প্রবেশের জন্য কানাডাকে প্রবেশদ্বার হিসাবে ব্যবহার করেন। ভিসা ছাড়া বেআইনি ভাবে ভারতীয়দের আমেরিকায় পাঠানোর কাজে জড়িত একাধিক চক্র।
কানাডা সীমান্ত হয়ে ভারতীয়দের অবৈধ ভাবে আমেরিকায় প্রবেশ করানোর চক্রের কথা অতীতেও বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। ইডির দাবি, এই চক্রের সঙ্গে কানাডার কিছু কলেজ এবং ভারতের বেশ কয়েকটি সংস্থা জড়িত।
যাঁরা অবৈধ ভাবে আমেরিকায় প্রবেশ করতে চাইতেন, তাঁদের আগে কানাডার কিছু কলেজে ভর্তি করানোর ‘ব্যবস্থা’ করা হত। তাঁদের জন্য করা হত কানাডার স্টুডেন্ট ভিসাও।
কিন্তু কানাডায় পৌঁছনোর পর কলেজে ভর্তি করানোর বদলে কানাডা সীমান্ত দিয়ে বেআইনি ভাবে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হত আমেরিকায়। এই চক্রে এক এক জন ভারতীয়ের থেকে ৫৫-৬০ লাখ টাকা করে নেওয়া হত বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের।
অর্থনীতিবিদ এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হেনরি লটিন সংবাদমাধ্যমে জানান, তাঁর ধারণা নিখোঁজ ভারতীয় ছাত্রদের বেশির ভাগই সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারেননি। তাঁরা এখনও কানাডায় কাজ করছেন এবং স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন।