আমার সবচেয়ে ভাল লাগে একটা বাংলা শব্দ। ‘দাদা’। আমার জন্ম, বড় হওয়া, পড়াশোনা, ক্রিকেটে হাতেখড়ি, সবই তো দিল্লিতে। দিল্লির আড্ডা-কালচারে কিন্তু ‘দাদা’ শব্দটা কিছু অপরিচিত না। ছোটবেলা থেকেই পাড়ার বড়দের আসরেই বলুন বা আমার স্কুলের টিফিনে গুজগুজে, ‘দাদা’ শব্দটা কম শুনিনি। কিন্তু ‘দাদা’ শব্দের মানে ওখানে হল: গুন্ডা-বদমাশ। ডন। মস্তান। ‘দাদা’ বা ‘ভাই’, দুটো শব্দই মোটামুটি একই অর্থে ব্যবহার হয়। পরে যখন বড় হচ্ছি, বলিউডের অ্যাকশন-মারদাঙ্গা ভরপুর ছবিগুলোয় বড় বড় চোখে দেখেছি কলারতোলা, ঘাড়ে স্কার্ফ বা রুমাল গোঁজা, কথায় কথায় বন্দুক-পিস্তল চালানো ‘দাদা’দের কাণ্ডকারখানা। শুধু সেলুলয়েডেই না, রিয়েল লাইফেও যে এরা জ্বলজ্বল করত, তা টের পেয়েছি দিল্লির অলিতে-গলিতে। কিশোরবয়সে আমরাও ছদ্ম-মস্তানি দেখালে বড়রা বলতেন, দাদা বন গয়া হ্যায় কেয়া? বুঝতেই পারছেন, ‘দাদা’র কী নেগেটিভ এনার্জি!
কাট টু ২০০৩। ‘দাদা’ শব্দটার মানেই আমার কাছে পালটে গেল সারা জীবনের জন্য, থ্যাংক্স টু একটা মানুষ। ধরতেই পেরে গেছেন নামটা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ওয়ার্ল্ড কাপ-এর ফাইনালটা আমরা হারলাম ঠিকই, কিন্তু ‘দাদা’র নেতৃত্বে গোটা টুর্নামেন্টে কী ক্রিকেটটাই না খেলেছিল ভারত! সেই স্কোয়াডে আমি ছিলাম না, কিন্তু বাইরে থেকেই তত দিনে জেনে ফেলেছি ‘দাদা’র কামাল। ওয়ার্ল্ড কাপ শেষ হওয়ার উনিশ দিনের মাথায় শুরু হল টিভিএস কাপ। আমার ওয়ান-ডে’ ডেবিউ, ভারতের হয়ে ওপেনার হিসেবে ডেবিউ সেই টুর্নামেন্টেই, ‘দাদা’র ক্যাপ্টেন্সিতে। মজার কথা কী জানেন, প্রথম ওয়ান-ডে খেললাম যে মাঠটায়, সেটা ভরপুর বাংলা আর বাঙালির জায়গা। ইডেন নয় কিন্তু। ঢাকা। এত দিন জানা ছিল, এ বার নিজের চোখে দেখলাম ‘দাদা’ শব্দটায় কেমন মজে আছে বাংলাদেশও।
তার পর তো গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। ওয়ান-ডে’র পথ বেয়ে এসেছে টি-টোয়েন্টি, আইপিএল। আর এই ২০১৫ সালে আইপিএল-এইট টুর্নামেন্টের ফাঁকে, খোদ পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় বসে, বাংলা নববর্ষের ঠিক আগেটায় যখন আপনাদের জন্য লিখছি, আমার প্রথম আর প্রধান পরিচয়: আমি বাংলার, কলকাতার টিম কেকেআর-এর ক্যাপ্টেন। আর কী আশ্চর্য, আমাকে এখন টিমের সবাই ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করে! নেট প্র্যাকটিসে, ম্যাচে, মাঠের বাইরে টিম লাঞ্চে, নাইট রাই়ডার্স-এর অ্যাড-এর শুটিংয়ে, সব জায়গায় আমি ‘গোতি দাদা’ ডাকটা শুনতে পাই! জুনিয়র ক্রিকেটার থেকে সাপোর্ট স্টাফ অবধি সব্বার কাছে আমার ডাকনামের গায়ে জড়িয়ে ‘দাদা’। কী ভাল যে লাগে! ইডেনে হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে যখন কেকেআর ফিল্ডিং করছে, আমি হয়তো কভার বা মিড-অফে, শুনতে পাই দর্শকদের ডাক— ‘গৌতমদাদা’, ‘গম্ভীরদা’। খুব মজা লাগে, আবার গর্বও হয় খুব। ‘দাদা’ শব্দটা কত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সমীহের বহিঃপ্রকাশ, আমি তো জানি। আবার বেশ একটু ডাকাবুকোপনাও কি লুকিয়ে নেই ওই শব্দের গভীরে? বেশ একটা রবিনহুড-রবিনহুড ভাব, দুর্ধর্ষ দস্যু ঠিকই, কিন্তু উইথ আ হার্ট অব গোল্ড!