হঠাৎ করে আমার কিছু হয়ে গেলেও পরিবার যেন একেবারে ভেসে না-যায়, সাধারণত সেই চিন্তা থেকেই জীবনবিমা করি আমরা। শখ করে কেনা গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে যেন দুম করে বিরাট অঙ্কের খরচ ঘাড়ে এসে না-পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই গাড়ি-বিমা। রিটার্নের আশা না-করে স্বাস্থ্যবিমায় বিনিয়োগও অনেকটা ওই একই রকম কারণে। যাতে একবারের হাসপাতাল যাত্রা সব সঞ্চয়কে নিঃশেষ না করে ফেলে।
অথচ এমনটা হামেশাই শোনা যায় যে, বাড়ির কর্তা হঠাৎ চলে যাওয়ার পরে অকূলে পড়েছে তাঁর পরিবার। মোটা অঙ্কের বিমা যে-আছে, তা হয়তো তাঁরা জানেন। কিন্তু তার কাগজ কোথায়, তা জানা নেই। এ রকম আকছার ঘটে বলেই না জীবনবিমা সংস্থাগুলির তহবিলে বহু টাকা দাবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে!
শুধু কি তাই? হয়তো প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার তারিখ সেই কবেই পেরিয়েছে। আর তার বহু দিন পরে তা মনে পড়লে আমরা বলি, “এই যাঃ।” যত্ন করে বছরের পর বছর প্রিমিয়াম দিয়েও কত সময় হারিয়ে ফেলি বিমার মূল নথি। ফলে মেয়াদ শেষে টাকা হাতে পাওয়াই তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধান ই-অ্যাকাউন্ট
এ ধরনের হাজারো সমস্যার জাল কেটে বেরোতেই সমস্ত বিমা গ্রাহকের ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট (ইআইএ বা eIA) খোলার পথে পা বাড়িয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ। সমস্ত বিমা সংস্থাকে এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে তারা। পাইলট প্রকল্পে ভাল সাড়া মেলার পরে এখন সারা দেশে এই প্রকল্প দ্রুত কার্যকর করতে চাইছে আইআরডিএ।
প্রথমে সমস্ত জীবনবিমাকে ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্টের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই কাজ শুরুও হয়েছে ইতিমধ্যে। আগামী দিনে ধাপে ধাপে এর আওতায় আসার কথা সমস্ত সাধারণ বিমা, স্বাস্থ্যবিমা এবং গোষ্ঠী বিমারও।
ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট
• প্রত্যেক বিমা গ্রাহকের একটি করে ইউনিক অনলাইন অ্যাকাউন্ট থাকবে। যার নাম ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট।
• আপনি এই অ্যাকাউন্ট খুললে, তার ইউজার আইডি এবং পিন নম্বর থাকবে শুধু আপনারই হাতে। ফলে অন্য কাউকে পিন না-জানালে, ওই অ্যাকাউন্ট খুলে ঢুকতে পারবেন শুধু আপনি।
• ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্টে এক জায়গাতেই থাকবে আপনার বিমা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ও নথি। বিমার মূল কাগজ, রসিদ থেকে শুরু করে আগামী প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার তারিখ— সবই দেখা যাবে সেখানে।
• এক অ্যাকাউন্টেই নিজের যাবতীয় বিমা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পেয়ে যাবেন।
• চাইলে প্রিমিয়াম জমা দেওয়া কিংবা নতুন পলিসি কেনার মতো কাজ সেরে ফেলা যাবে সেখান থেকে।
• অ্যাকাউন্ট খোলার সময়েই বাধ্যতামূলক ভাবে অথরাইজড রিপ্রেজেন্টেটিভ (অনুমোদিত প্রতিনিধি)-এর নাম জানাতে হবে। তাঁর কাজ অনেকটা নমিনির মতো। গ্রাহকের অবর্তমানে তাঁর ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন তিনি।
ডি-ম্যাট মানে?
এখন কোনও পলিসি কিনলে, তার মূল নথি যত্ন করে রাখতে হয় আমাদের। গুছিয়ে রাখতে হয় প্রিমিয়ামের প্রতিটি রসিদ। কিন্তু ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্টে বিমা ডি-ম্যাট হয়ে যাওয়া মানে সেই সমস্ত কাগজ আলাদা ভাবে রাখার আর প্রয়োজন পড়বে না। তা থাকবে অনলাইনে, আপনার অ্যাকাউন্টেই। ঠিক শেয়ারের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে।
মনে রাখবেন, এই অ্যাকাউন্টটি কিন্তু ইউনিক। তার মানে, সারা জীবনের সমস্ত বিমার জন্য একবারই এই অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে আপনাকে। কেওয়াইসি-ও জমা দিতে হবে একবারই। যদি না ঠিকানা বা কোনও কিছু সেখানকার রেকর্ডে বদলাতে চান।
করবে কারা?
আইআরডিএ এই ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য নিয়োগ করেছে পাঁচটি ইনশিওরেন্স রিপোজিটরি সংস্থাকে। এগুলি হল—
(১) এনএসডিএল (NSDL) ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড
(২) সিআইআরএল (CIRL)
(৩) এসএইচসিআইএল (SHCIL) প্রোজেক্টস লিমিটেড
(৪) কেএআরভিওয়াই (KARVY) ইনশিওরেন্স রিপোজিটরি লিমিটেড
(৫) সিএএমএস (CAMS) রিপোজিটরি লিমিটেড
এর মধ্যে যেটিতে খুশি সেটিতেই নিজের ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন আপনি। এর জন্য সরাসরি আবেদন জমা দিতে পারেন সেই রিপোজিটরি সংস্থার কাছে। কিংবা যে-বিমা সংস্থার কাছে আপনি পলিসি কিনেছেন, তাদের কাছে ফর্ম জমা দিলেও তারা তা পাঠিয়ে দেবে আপনার বাছাই করা রিপোজিটরি সংস্থার কাছে। সাহায্য নিতে পারেন অ্যাপ্রুভড পার্সনেরও। কী ভাবে অ্যাকাউন্ট খুলবেন, তা বিশদে জানতে চার্ট-১ এবং চার্ট ২-তে চোখ রাখুন।
অ্যাপ্রুভড পার্সন
দেশের বিপুল সংখ্যক বিমা গ্রাহকের অনেকেই নেট ব্যবহারে এখনও তেমন স্বচ্ছন্দ নন। অনেকের হয়তো আবার অনলাইনে ফর্ম ভর্তি করা এবং তার সঙ্গে নথিপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় নেই। তাই সমস্ত বিমা গ্রাহকের দরজায় পৌঁছতে অ্যাপ্রুভড পার্সন নিয়োগ করছে রিপোজিটরি সংস্থাগুলি। তবে তার জন্য আগে প্রয়োজন আইআরডিএ-র অনুমতি।
এই অ্যাপ্রুভড পার্সন কোনও ব্যক্তি অথবা পার্টনাররশিপ (অংশীদারি) সংস্থা হলে চলবে না। তা হতে হবে কোম্পানি আইনে নথিভুক্ত কোনও সংস্থা। তার পর তাঁরা আবার গ্রাহকের দরজায় পৌঁছে ফর্ম ভর্তি করা এবং নথি সংগ্রহের জন্য লোক নিয়োগ করবে। দরকার মতো প্রশিক্ষণও দেবে তাঁদের।
তবে কেউ নিজেকে অ্যাপ্রুভড পাসর্নের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিলে, আগে তাঁর পরিচয়পত্র দেখুন। সেখানে সংশ্লিষ্ট অ্যাপ্রুভড পার্সন এবং রিপোজিটরি সংস্থা— দু’য়েরই নাম ও লোগো থাকার কথা।
সুবিধার খতিয়ান
অ্যাপ্রুভড পার্সনের নিয়োগ করা কর্মীদের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিষেবা পাবেন গ্রাহক। যেমন—
• ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খোলা ও বিমা ডি-ম্যাট করার বন্দোবস্ত— দু’ক্ষেত্রেই গ্রাহকের ফর্ম ভর্তি করে দেওয়া।
• গ্রাহকের কাছ থেকে সচিত্র পরিচয়পত্র, ঠিকানার প্রমাণ ইত্যাদি সংগ্রহ করা। এবং তা আসলের (অরিজিনাল) সঙ্গে মিলিয়ে দেখা।
• সব মিলিয়ে ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং বিমা ডি-ম্যাট করতে গ্রাহককে সহায়তা করা।
• বিমা কেনার পর গ্রাহক হয়তো ঠিকানা বদলেছেন। এখন তা নথিতে তুলতে চান। বিয়ের পরে হয়তো কারও পদবী বদলেছে। ফলে পলিসির ক্রেতা হিসেবে তা বদলাতে চান তিনি। কোনও গ্রাহক হয়তো আগে বছরে এক বার প্রিমিয়াম দিতেন। এখন তা দিতে চান দু’বারে ভেঙে। এ রকম বিভিন্ন বদল করে দেওয়ার কথাও অ্যাকাউন্ট খোলার সময়েই অ্যাপ্রুভড পার্সনের পাঠানো কর্মীদের বলতে পারবেন গ্রাহকেরা।
কোনও খরচ নেই
ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং বিমা ডি-ম্যাট করতে কোনও খরচ আপনাকে বইতে হবে না। তা বইবে বিমা সংস্থাই। ফলে বিমার কাগজপত্তর সামলানোর ঝঞ্ঝাট থেকে নিখরচায় রেহাই পেতে পারেন আপনি।
কাগজপত্তর যা লাগবে
অ্যাকাউন্ট খুলতে
• সচিত্র পরিচয়পত্র
হয় প্যান কার্ড কিংবা আধার কার্ডের ফোটোকপি। মনে রাখবেন, এই দু’টির মধ্যে একটি আপনাকে দিতেই হবে। যেহেতু এটি একটি ইউনিক অ্যাকাউন্ট, তাই এই দু’টির একটি লাগবেই।
• ঠিকানার প্রমাণ
নীচের তালিকা থেকে যে-কোনও একটি আপনাকে কিন্তু জমা
দিতেই হবে—
(১) রেশন কার্ড
(২) পাসপোর্ট (৩) ভোটার কার্ড
(৪) ড্রাইভিং লাইসেন্স
(৫) ব্যাঙ্কের পাসবই স্টেটমেন্ট (ছ’মাসের পুরনো নয়)
(৬) বিদ্যুতের বিল (ছ’মাসের পুরনো নয়)/ ল্যান্ডলাইন ফোনের বিল (ছ’মাসের পুরনো নয়)/ বাড়ি কেনা বা ভাড়া নেওয়ার চুক্তিপত্র
(৭) কেন্দ্র/ রাজ্য সরকার/ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইআরডিএ, সেবি ইত্যাদি)/ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা/ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক/ রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক সংস্থা ইত্যাদির ইস্যু করা পরিচয়পত্র (আইডেন্টিটি কার্ড) বা ঠিকানার প্রমাণ সম্বলিত নথি।
(এই সাতটি ছাড়াও আরও কিছু নথি নিজের ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা যাবে। প্রয়োজনে বিমা সংস্থা/ ইনশিওরেন্স রিপোজিটরি/ অ্যাপ্রুভড পার্সনের কাছে সে বিষয়ে খবর নিন।)
• ক্যান্সেলড চেক
বিমা ডি-ম্যাট করতে
ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলার পরে বিমা ডি-ম্যাট করার জন্য আবেদন করতে হবে। সেই সময় জানাতে হবে—
(১) নিজের নাম
(২) হাতে আসা ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট নম্বর
(৩) প্যান নম্বর বা আধার নম্বর
(৪) যে-সব সংস্থার বিমা আপনার আছে, সেগুলির নাম এবং পলিসিগুলির নম্বর।
(মনে রাখবেন, কোনও পলিসির নথি বা রসিদের ফোটোকপি সঙ্গে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু পলিসি নম্বর দিলেই হল।)
এক নজরে পদ্ধতি
অ্যাকাউন্ট খোলা (নিজে)
• বিমা সংস্থা (যেখানে আপনার পলিসি আছে) অথবা ইনশিওরেন্স রিপোজিটরি সংস্থা— এদের মধ্যে যে কারও কাছেই অনলাইনে নিজের ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন।
• বিমা সংস্থা অথবা পাঁচটি রিপোজিটরি সংস্থার যে কোনও একটির ওয়েবসাইটে যান।
• সেখানে ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য ফর্ম পাবেন।
• ওই ফর্ম ভর্তি করুন।
• সঙ্গে দিন প্রয়োজনীয় নথি (চার্ট ১-এ দেখুন)।
• বিমা সংস্থা/ রিপোজিটরি সংস্থার কাছে নথি সমেত ভর্তি করা ফর্ম জমা দিন।
• সেই নথি ও তথ্য যাচাইয়ের পরে অ্যাকাউন্ট খুলে যাবে আপনার বাছাই করা (ফর্ম ভর্তির সময়) রিপোজিটরি সংস্থায়।
• অ্যকাউন্ট খুললেই তা জানিয়ে মেসেজ (এসএমএস) আসবে মোবাইলে। মেল-আইডিতে আসবে ই-মেলও।
• এর পর ই-মেল আসবে অ্যাকাউন্টের ইউজার আইডি এবং পিন নম্বর জানিয়ে।
• কী ভাবে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে, তা-ও আপনাকে মেল মারফত জানিয়ে দেবে সংস্থা। ‘ওয়েলকাম কিট’ও আসবে সেই ই-মেলেই।
অ্যাকাউন্ট খোলা (অ্যাপ্রুভড পার্সন মারফত)
• রিপোজিটরি সংস্থার ওয়েবসাইট দেখে নিজে কোনও অ্যাপ্রুভড পার্সনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন কিংবা চাইলে আপনার কাছে প্রতিনিধি পাঠানোর কথা অ্যাপ্রুভড পার্সনকে বলে দেবে রিপোজিটরি সংস্থাই।
• এ ক্ষেত্রে ফর্ম ভর্তি করা, সঙ্গের নথি আপনার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে জমা দেওয়া ইত্যাদি সমস্ত দায়িত্বই তাঁর।
• ফর্ম, নথি ইত্যাদি জমা হয়ে যাওয়ার পরে বাকি ধাপগুলি অবশ্য একই।
বিমা ডি-ম্যাট (নিজে)
• অ্যাকাউন্ট খোলার পালা শেষ হলে ফের আবেদন করতে হবে বিমা ডি-ম্যাট করার জন্য।
• এ ক্ষেত্রেও ফর্ম মিলবে বিমা সংস্থা (যেখানে আপনার পলিসি আছে) এবং রিপোজিটরি সংস্থার কাছে।
• সেই ফর্ম ভর্তি করুন। সঙ্গে দিন প্রয়োজনীয় নথি (বিশদে জানতে চার্ট-১ দেখুন)।
• ই-ইনশিওরেন্স অ্যাকাউন্ট নম্বর এবং পলিসি নম্বরগুলি পাওয়ার পরে আপনার বিমা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ওই অ্যাকাউন্টে তুলে দেবে রিপোজিটরি সংস্থা।
বিমা ডি-ম্যাট (অ্যাপ্রুভড পার্সন মারফত)
• এ ক্ষেত্রেও বিমা ডি-ম্যাট করার জন্য আপনার হয়ে আবেদন করে দেবে অ্যাপ্রুভড পার্সনই।
• আপনার হয়ে নথি জমা দেওয়ার দায়িত্বও তাঁর।
• তবে আপনার পলিসি সংক্রান্ত কোনও তথ্য তার নজরে আসবে না।