স্কুলের গণ্ডি টপকেছি সেই কবে। কিন্তু বাংলার মাস্টার-মশাইয়ের গমগমে গলায় ভাব-সম্প্রসারণের সেই লাইন দু’খানি আজও ভুলিনি। ক্লাসে ঢুকে রুমালের কোণটুকু দিয়ে চশমার কাচ মুছতে-মুছতেই তিনি শুরু করতেন— ‘‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি...’’।
তখন পরীক্ষা পাশের জন্য মানেটুকু মুখস্থ করেছিলাম। কিন্তু এখন তার অর্থ হাড়েহাড়ে টের পাই। লাইন দু’খানার মোদ্দা কথা ছিল, আজ যে জিনিসের তেমন প্রয়োজন নেই, তা শুধুমাত্র শখের বশে বেশি কিনলে, কাল এমন দিন আসতে পারে, যখন সব থেকে বেশি দরকারি জিনিসও বিক্রি করতে হবে।
রুক্ষ বাস্তব
নিজের ফেলে আসা জীবনে এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি অনেক বার। হঠাৎ হাতে আসা টাকা হয়তো দেদার ওড়াতে শুরু করলেন কেউ। তাঁকেই কিছু দিন পরে দেখেছি ভাতের হাঁড়ি চড়ার চিন্তা করতে। দেখে বুঝেছি, এটাই রুক্ষ বাস্তব। বিশ্বম্ভর রায়ের জলসাঘরে বাতি এমনিই নেভেনি!
পিঁপড়ের পাঠশালা
অর্থকড়ির বিষয়ে সময় থাকতে সংযত না-হলে হঠাৎই যে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, সে কথা নতুন নয়। কিন্তু এখন এই বিশ্বায়িত অর্থনীতির জমানায় তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
খোলা অর্থনীতির কল্যাণে আমাদের অনেকের রোজগার বেড়েছে ঠিকই। তেমনই জীবনে অনিশ্চয়তাও বেড়েছে আরও। আজকের লাখ টাকা বেতনের চাকরি কালকেই ফুড়ুত। আমেরিকা বা ইউরোপে শেয়ার বাজারে ধস নামলে, এখানে কাজ যাই-যাই। এই পরিস্থিতিতে তাই যেন আরও বেশি করে পিঁপড়ের পাঠশালায় ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে আমাদের। দরকার পড়েছে আবহাওয়া ভাল থাকতে বর্ষার জন্য খাবার সঞ্চয় করে রাখার। আর সেই কারণেই অপ্রয়োজনীয় খরচে কাঁচি চালানো নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
গণ্ডি টানুন
একের পর এক আর্থিক সঙ্কটই এখন রুটিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির। ভবিষ্যৎ সব সময়েই যেন অনিশ্চিত। এবং তার ভাল রকম আঁচ পাওয়া যাচ্ছে ভারতেও। সেই কারণে সময় এসেছে অপচয় বন্ধ করার। এবং সেই টাকা সাশ্রয় করে নিয়মিত সঞ্চয়ের।
আর্থিক ভিত মজবুত থাকলে অনেক সমস্যা সামাল দেওয়া যায়। সংযত জীবন মানে এই নয় যে, সব শখ-আহ্লাদ শিকেয় উঠিয়ে রাখতে হবে। সিনেমায় যাওয়া থাকবে। রেস্তোরাঁয় এক-দু’বার খাওয়ার উপরেও ফতোয়া নেই। কিন্তু সব করেও খরচে কোথাও একটা গণ্ডি টানতে হবে। শুরুতেই ঠিক করে নিতে হবে যে, এর বেশি আমি এগোব না।
অপচয় কিন্তু অসুখ
এমনিতে শখের সঙ্গে সঞ্চয়ের কোনও ঝগড়া নেই। অনাবশ্যক খরচ ও অপচয় বন্ধ করে বরং সেই টাকায় সঞ্চয় এবং শখ মেটানো পাশাপাশি চলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সচ্ছলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তে থাকে অনাবশ্যক খরচ। নিজেদের অজান্তেই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে অপচয়ের স্বভাব। আধুনিক প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে তো এই বাজে খরচের প্রবণতা অনেকটাই বেশি। হাতেগরম প্রমাণ চান? এঁরা এক মোবাইল গড়ে কত দিন ব্যবহার করেন এক বার খবর নিয়ে দেখুন।
অনিশ্চিত বাজারে এঁদের বলুন বা আমাদের, সকলকে কিছুটা কমাতে হবে অনাবশ্যক খরচ। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে মন দিতে হবে ছোট করে হলেও নিয়মিত সঞ্চয়ে। আসুন দেখি, কী করে রাশ টানা যায় খরচে। বন্ধ করা যায় অপচয়। আর জমানো যায় রোজগার করা টাকা। বর্তমানের আনন্দ ছেঁটে না-ফেলেও ভবিষ্যতের দুঃখ এড়ানো যায় কী ভাবে?
মুষ্টিতোলা
আগেকার দিনে মা-ঠাকুরমাদের মধ্যে মুষ্টিতোলার রেওয়াজ ছিল খুব। প্রতি বেলায় রান্নার সময়ে কৌটো মেপে যখন চাল নেওয়া হত, তখন তা থেকে তাঁরা এক মুঠো চাল সরিয়ে রাখতেন অন্য একটি পাত্রে। এতে কারও ভাতে কম পড়ত না। কিন্তু একটু একটু করে জমে উঠত আর একটি চালের ভাণ্ডার। অজান্তে চাল ফুরিয়ে গেলে অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাজার যাওয়া না-হলে পরিস্থিতি সামাল দিত এই মুষ্টি বা মুঠোয় তোলা চাল। একই ভাবে, মাসের শুরুতে বেতন যখন আমাদের হাতে আসে, তখন তা থেকে একটা সামান্য অংশ অন্তত (ধরুন ১-২ শতাংশ) তুলে অন্যত্র সরিয়ে রাখতে ভুলবেন না। দেখবেন, তাতে আমাদের খরচে খুব বেশি কাটছাঁট করতে হচ্ছে না। কিন্তু সেই অল্প করে তুলে রাখা টাকা একটু একটু করে জমে আপনার অজান্তেই তৈরি করে ফেলবে একটি তহবিল। যা লগ্নি করা যাবে কোনও ভাল প্রকল্পে। দেখবেন, দীর্ঘ মেয়াদে বেড়ে ওঠা সেই টাকাই হয়তো বিপদের দিনে কাজে এল। কিংবা হয়তো পরে বিদেশ ভ্রমণের শখ পূরণ হল সেই মুষ্টিতোলা টাকায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা তহবিলেই।
পারলেই জমান
সুতরাং আমার পরামর্শ হল, সঞ্চয়ের কোনও সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। তা সে যত ছোটই হোক না কেন। এক টাকা হলেও জমান।
সব খরচের পরে যা থাকবে, সেটুকু সঞ্চয়— এই মানসিকতা পাল্টান। বরং ভাবুন উল্টোটা। আগে সঞ্চয়ের জন্য ন্যূনতম টাকা সরিয়ে রাখুন। তার পরে ঠিক করুন বাকি টাকায় মাস চালাবেন কী ভাবে।
ছোট ছোট আকারে নিয়মিত সঞ্চয় ছাড়াও যখন কোনও থোক টাকা হাতে আসবে (যেমন, বোনাস, বকেয়া বেতন ইত্যাদি), তা থেকে সঞ্চয়ের অংশ আগাম সরিয়ে রাখতে ভুলবেন না। সাবধান, এ ধরনের হঠাৎ হাতে আসা টাকাই কিন্তু আমরা বাজে খরচ করে ফেলি সব চেয়ে বেশি।
পুরনো কথা, নতুন শপথ
সত্যি বলতে কী কোথায় কোথায় বাজে খরচ করি, তার অনেকগুলি সম্পর্কেই আমরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু তবুও সেগুলি কাটছাঁট করতে আমরা কেমন জানি গাছাড়া। নতুন বছর তো সবে শুরু হয়েছে। আসুন সেই অপচয় বন্ধের শপথ নিই—
বিদ্যুৎ বিল: বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ করুন। খেতে যাওয়ার সময়ে আলো-পাখা বন্ধ করতে ভুলবেন না। এসি তো অপ্রয়োজনে চালিয়ে রাখবেনই না। একটু সচেতন হলে, ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ খরচ বাঁচানো যেতেই পারে। তা-ও আবার বিন্দুমাত্র কষ্ট না-করে। তাহলেই ভেবে দেখুন, শুধু এই খাতে কত টাকা বাঁচাতে পারেন আপনি।
লাগাতার মোবাইল: আজকাল পাশে বসা লোকের সঙ্গে অনেকে তেমন কথা বলেন না। অথচ মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তা করে যান অক্লেশে। বিল আসে বিপুল। সেই সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ইন্টারনেটের খরচ। সকাল থেকে হোয়াট্সঅ্যাপের ঠেলায় হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে রাখা দায়। সেই সঙ্গে রয়েছে ফেসবুকে বন্ধুর ছবিতে ‘লাইক’ দেওয়ার অলিখিত চুক্তি। সঙ্গে গাদাখানেক ভিডিও। ফলে অনেক টাকা গচ্চা সেখানেও।
এমন নয় যে, এগুলির প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার পরামর্শ হল, মোবাইলে অনাবশ্যক কথা না-বলা। আর কালকেই রাত জেগে দেখা মেসির খেলা আজ ফের ইউটিউবে দেখার দরকার আছে কি? তার বদলে ডেটার খরচ একটু বাঁচালে কেমন হয়?
গ্যাজেট প্রেম: শেষ তিন বছরে ক’বার মোবাইল পাল্টেছেন? প্রতি বারই তা করার দরকার ছিল কি? সেই টাকাটা তুলে রাখলে কত কিছু করা যেত। তাই প্রয়োজন না-হলে মোবাইল সেট না-পাল্টানোই ভাল।
একই কথা প্রযোজ্য ল্যাপটপ, টিভি, মিউজিক সিস্টেমের মতো বাকি গ্যাজেটের (বৈদ্যুতিন পণ্য) ক্ষেত্রেও।
হাল্কা ঠেলাগাড়ি: শপিং মলে গিয়ে ট্রলিতে খুশি মতো জিনিস তুলে নেওয়া কাজের কথা নয়। ভেবে দেখুন, যা কিনছেন, বাড়িতে তার প্রয়োজন আছে কি না। শুধু সাময়িক ভাললাগার বশে জিনিস কেনা হলে, তা অনেক সময়ে অব্যবহৃত থাকে। তাই মলে যাওয়ার আগে ঠিক করুন, কী কিনতে যাচ্ছেন এবং বাজেট কত। অযথা ডিসকাউন্টের ফাঁদে পা দেবেন না।
আরও যা:
• রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ‘অর্ডার’ দিয়ে লাভ কী? বাড়িতে বিয়ে, অন্নপ্রাশনের মতো অনুষ্ঠানেও লোক দেখানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত আয়োজন না-করাই ভাল। নিজের ক্ষমতা আগে বুঝুন। সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
• শুধু ব্র্যান্ডের পিছনে ছুটবেন না। বরং পণ্যের গুণমান দেখুন। নামী ব্র্যান্ডের পিছনে না-ছুটে একই মানের পণ্য যদি অন্যত্র কম দামে কেনা যায়, তো মন্দ কী?
• গাড়ির তেল-খরচ কমাতে যা যা করণীয়, তা করেছেন কি?
সাশ্রয়ের সাত-সতেরো
অপচয় কমানো ছাড়াও নানা উপায়ে সাশ্রয় করে সঞ্চয় বৃদ্ধি সম্ভব। যেমন:
• কোথাও যাওয়ার দিন আগে ঠিক করতে পারলে, ৩০ থেকে ৬০ দিন আগে বিমানের টিকিট কাটতে পারেন। দামে অনেকটাই সাশ্রয় হবে।
• বিদ্যুৎ-সহ কয়েক ধরনের বিল অনলাইনে মেটালে কিছু টাকা রিবেট মেলে। তা ছাড়বেন কেন?
• কিছু পণ্য নেটে (বিশেষত অ্যাপ মারফত) কিনলে, দামের দিক থেকে অনেকটাই সুবিধা পাওয়া যায়।
• প্রয়োজন থাকলে বড় প্যাকের জিনিস কিনুন। দাম কম পড়বে। অনেক বেশি লাগলে, ঢুঁ মারতে পারেন পাইকারি বাজারেও।
• সুদহীন কিস্তিতে পণ্য কেনা গেলে, তা নগদে না-কিনে কিস্তিতে কেনা লাভজনক হতে পারে।
• গৃহিণীদের হাতে মাসের শুরুতেই কিছু টাকা তুলে রাখা ভাল। যাতে তাঁরা মুষ্টি তুলে রাখতে পারেন।
• যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁরা যদি দিনে দু’টো সিগারেটও কম খান, তবে কত টাকা বাঁচে? স্বাস্থ্যের পক্ষেও তা ভাল।
• ইচ্ছে, শখ এবং সামর্থ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখুন। খুব দরকার না -হলে, সামর্থ্যের বাইরে না-যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিন্দুতে সিন্ধু
শুধু অপচয় ছেঁটে আপনার কাজ শেষ নয়। ছোট ছোট সঞ্চয়ের মাধ্যমে আয়ও বাড়াতে হবে। আসুন দেখি—
• সেভিংস অ্যাকাউন্টে অযথা বেশি টাকা ফেলে না-রেখে শুধু প্রয়োজনীয় টাকাটুকু রাখুন। বাকিটা বেশি আয়যুক্ত প্রকল্পে সরিয়ে নিন।
• ভবিষ্যতে সোনার প্রয়োজন থাকলে, সত্যিকারের সোনা না-কিনে সরকারের স্বর্ণবন্ড কিনুন। লকারের খরচ বাঁচবে। আবার পরে বন্ড ভাঙিয়ে সোনা কিনতে পারবেন। মিলবে সুদও।
• আয় করযোগ্য হলে, কর সাশ্রয়কারী প্রকল্পে লগ্নির মাধ্যমে যতটা সম্ভব সাশ্রয় করুন।
• ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট পরীক্ষা করে দেখুন, প্রাপ্য ডিভিডেন্ড, সুদ ইত্যাদি যথাসময়ে পাচ্ছেন কিনা। না-পেয়ে থাকলে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে চিঠি লিখুন। ভাঙানো হয়নি এমন ডিভিডেন্ড অথবা ইন্টারেস্ট ওয়ারেন্ট বাড়িতে পড়ে থাকলে, তা অবিলম্বে ব্যাঙ্কে জমা দিন। ওয়ারেন্ট তিন মাসের বেশি পুরনো হলে, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠিয়ে নতুন ওয়ারেন্ট আনাতে হবে।
• বাড়িতে বেশি নগদ টাকা না-রেখে তার একটা অংশ ব্যাঙ্কে জমা দিন। সুদ বাবদ কিছু আয় হবে।
• ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করলে, ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে টাকা শোধ করুন। সুদ গুনতে হবে না।
দেখুন চারপাশও
আপনি-আমি অপচয় বন্ধ করলে, শুধু নিজেরা লাভবান হই না। হয় সমাজ এবং দেশও। যে-দেশে বহু মানুষ অর্ধাহারে থাকেন, সে দেশে খাবার নষ্ট শোভা পায় না। একই কথা প্রযোজ্য গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে।
স্কুল-কলেজ-অফিসে ফাঁকা ঘরে আলো, পাখা, এসি চলতে দেখলে চোখ ফিরিয়ে নেবেন না। বন্ধ করুন। অনেক সময়েই দেখা যায়, রাস্তায় কলের জল পড়েই যাচ্ছে। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আমরা কল বন্ধের কথা ভাবি না। এই ভাবনার বদল দরকার।
শপথ নিন
সচ্ছলতা অপচয়ের পাসপোর্ট দেয় না। বরং তা আপনার কাছে আরও বেশি দায়িত্ববোধের দাবি করে। তাতে দেশের ভাল। দশের ভাল। ভাল নিজেরও। ২৬ জানুয়ারি সবে পেরিয়েছে। তেরঙার তলায় দাঁড়িয়ে আজ না-হয় অপচয় বন্ধের শপথ নিন।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
জমিই হোক বা সঞ্চয়। আপনার যে কোনও বিষয়-সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শের জন্য লিখুন। ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না। ‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১। ই-মেল: bishoy@abp.in