মুখোমুখি...

না জানিয়ে সত্যজিৎ রায় রেকর্ড থেকে আমার গান ব্যবহার করেছিলেন

বললেন গিরিজা দেবী। এখনও ভালবাসেন পুতুল খেলা। শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়াও। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণা। পঁচাশি বছরের জন্মদিনের ঠিক পাঁচ দিন আগে মন উজাড় করা আলাপ তাঁর। সামনে সংযুক্তা বসুমনে তো পড়েইদশাশ্বমেধ ঘাট, আরতির গান, কাঁসর-ঘণ্টার ধ্বনি, পুরোহিতদের মন্ত্রপাঠ, গঙ্গার বাতাস, মানুষজনের মেলামেশা আসলে বেনারস মানে পুরোটাই সঙ্গীত-ভক্তি-শান্তি-প্রেম। ওখানেই আমার জন্ম, সঙ্গীতসাধনা শুরু, সংসার। আমার খেয়াল, ঠুমরি, কাজরি, দাদরা, ভজন গানের সুনামও প্রথম ছড়ায় ওই শহরেই। মাঝে মাঝে যাই। বাড়ি আছে তো নিজের। খুব আপন মনে হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ০০:০০
Share:

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

পত্রিকা: আপনার বাড়ি তো বেনারস। মনে পড়ে সেই শহরের কথা?
গিরিজা: মনে তো পড়েইদশাশ্বমেধ ঘাট, আরতির গান, কাঁসর-ঘণ্টার ধ্বনি, পুরোহিতদের মন্ত্রপাঠ, গঙ্গার বাতাস, মানুষজনের মেলামেশা আসলে বেনারস মানে পুরোটাই সঙ্গীত-ভক্তি-শান্তি-প্রেম। ওখানেই আমার জন্ম, সঙ্গীতসাধনা শুরু, সংসার। আমার খেয়াল, ঠুমরি, কাজরি, দাদরা, ভজন গানের সুনামও প্রথম ছড়ায় ওই শহরেই। মাঝে মাঝে যাই। বাড়ি আছে তো নিজের। খুব আপন মনে হয়।

পত্রিকা: ৮ মে আপনার পঁচাশি বছর বয়স হবে। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের এক দিন আগে আপনার জন্ম। কোনও দিন কিন্তু আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন না...
গিরিজা: না গাইনি। তার কারণ যখন যে রাজ্যে যাই, সেখানকার ভাষায় গান গাওয়ার অনুরোধ থাকে। এত গান গাইব কখন? আর এটাও মনে হয়েছে, আমার গান গাওয়ার যে স্টাইল তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতা হয়ে থাকাই ভাল। আমার মেয়ে মুন্নির মাসিশাশুড়ির কাছে অসংখ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি। একেকটা গান বার বার শুনেছি। কী ভাব! যেমন, ‘সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে’ কিংবা ‘কবে তুমি আসবে বলে রইব না আর বসে’ আমার দারুণ প্রিয়। কিন্তু গাইব ভাবি না। নজরুলগীতিও আমার খুব পছন্দের। যে গান গুরুজি দিয়ে গিয়েছেন তাই গেয়েই শেষ করে ওঠার সময় পাই না। এক আধটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে তো আর শ্রোতাদের খুশি করা যাবে না। তবে সম্প্রতি জোড়াসাঁকোয় গিয়েছিলাম। গুরুদেবের বাড়িতে গান গেয়ে মন যেন ভরে গেল! মনে হল কবিগুরু যেন সত্যিই আমার গান শুনছিলেন। ইচ্ছে ছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, লোকগীতি, ভজনের একটা ভাণ্ডার তৈরি করব। হল না এখনও। গুরু পণ্ডিত শ্রীচন্দ্র মিশ্র কিছু গান গোপনে দিয়ে গিয়েছেন। নিজে বসেই গাই। কাউকে শেখাতে পারব না সে যদি যোগ্য না হয়। প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল গুরুজিকে।

পত্রিকা: এত কাল বাংলায় রইলেন, অথচ বাংলা ছবিতে একবারও গান গাইলেন না। যেখানে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ বিলায়েৎ খান, বাহাদুর খান সকলেই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন।
গিরিজা: হ্যাঁ ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি। রবিদার সুর। অসাধারণ। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ বার বার দেখেছি। নিজে গান গাওয়ার কথা ভাবিইনি। প্রথম যৌবনেই ভি শান্তারামজি ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ ছবিতে গান গাওয়ার অফার দিয়েছিলেন। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বসন্ত দেশাই। কিন্তু গাইনি। কারণ আমার স্বামী মধুসূদন দাস চাননি যে সিনেমায় গান গাই। বাবারও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি তো রাখা গেল না। সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-য়ে আমার ‘বরসন লাগি বদরিয়া’ গানখানা রেকর্ড থেকে নিয়ে এক লাইন ব্যবহার করেছিলেন আমাকে না বলেই, জানেন তো! (হাসতে হাসতে)

Advertisement


তাঁর রবিদা’র সঙ্গে

পত্রিকা: তাই?
গিরিজা: আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের। দিল্লি এয়ারপোর্টে। বলেওছিলাম কেন আপনি এক লাইন গান রাখলেন? উনি হেসে বললেন, “কী করব খুব ভাল লাগল যে। আপনাকে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু গানটা খুব দরকার ছিল। আাপনি আসবেন আমাদের বাড়ি।” কী আর বলব, এই সব বলার পর! (হাসি) যা হওয়ার তা হল।

Advertisement


পত্রিকা: শুনেছি উস্তাদ আলি আকবর খানকে আপনি ভাই ডাকতেন...
গিরিজা: হ্যাঁ। বলতাম। রাখি পরাতাম। ভাইফোঁটা দিতাম। কিষেণ মহারাজজিকেও তাই। বাড়িতে এলে ওঁদের তিলক পরিয়ে দিতাম। উত্তরপ্রদেশের মেয়েরা বাড়িতে ভাই এলে তিলক পরান তো। সেই রীতি মেনে চলতাম। ওঁরা আমাকে বহেন বলতেন। কেবল রবিদা (রবিশঙ্কর) বলতেন গিরিজা। উস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবকে আমি বাবা বলেই ডাকতাম। সেই সূত্রে ওঁর শিষ্য হিসেবে ‘রবিদা’ বলতাম। কিন্তু ওঁর স্ত্রী অন্নপূর্ণাদিদি বলতেন আমায় বহেন। আমিও ওঁকে ভাবি না বলে বোন বলেই ডাকতাম। আসলে রবিদার জন্মও তো বেনারসে। একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ে। বাবা (আলাউদ্দিন) আর কণ্ঠেমহারাজজি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। আমার স্বামীর খুব ইচ্ছে ছিল ওঁর সরোদ শোনার। গানবাজনা অনেক হল। অনুষ্ঠান শেষে স্বামী বললেন, ‘‘ওঁকে খেতে দাও। রাতের খাবার খেয়ে যান ওঁরা।’’ শুনে বাবার কী রাগ!

পত্রিকা: কেন?
গিরিজা: বাবা বললেন, “সেটা আবার হয় নাকি? আমরা মেয়ের বাড়িতে কিছু খাই না। কিছু খেতে পারব না।” অনেক জোরাজুরিতে সামান্য কিছু উপহার গ্রহণ করলেন। কিন্তু জলস্পর্শ করলেন না। সে দিনের কথা ভাবলে মনে হয় কত পর যে আপন হয়েছে জীবনে, তার কোনও শেষ নেই। ঈশ্বরের সংসারে সবাই আপন। রক্তের সম্পর্ক সেখানে কিছুই নয়। তার পর আর এক দিনের কথা। আমার মেয়ে মুন্নি উস্তাদ আলাউদ্দিনকে প্রণাম করায় উনি আশীর্বাদ করে বললেন, “মুন্নি তুইও আশীর্বাদ কর আমি য্যান ঢাকায় গিয়াই মরতে পারি।’’ এই বলে মুন্নির হাত নিজের মাথায় রাখলেন। কিন্তু বাবার আর ঢাকা গিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা হল না। মানুষ যা চায় তা কি সব সময় পায়?

পত্রিকা: রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণা দু’জনকেই দেখেছেন। কী কারণে ওঁদের বিয়েটা টিকল না বলে মনে হয়?
গিরিজা: জানি না। বলতে পারব না। দু’জনেই খুব ভালমানুষ। তবে রবিদাকে দেখতে যত সুন্দর ছিল অন্নপূর্ণাদিদি তা নন। যদিও সৌন্দর্যটা বড় কথা নয়। ...আমার মনে হয় স্বামী-স্ত্রী-র বেশি দূরে দূরে থাকতে নেই। তা হলেই বিপদ। রবিদা প্রোগ্রাম করতে মাসের পর মাস বিদেশে থাকতেন। আর অমন রূপ, অমন গুণ....গোপিনীরা তো আসবেই (খিলখিলিয়ে হাসি)।

পত্রিকা: আপনার কি মনে হয় যে স্বামী-স্ত্রীর দু’জনেই শিল্পী হলে বিয়ে টেকার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়?
গিরিজা: আমি আমার শিষ্যশিষ্যাদের বলি, দু’জনে আর্টিস্ট না হলেই ভাল। নামযশ, সম্পর্ককে সময় না দেওয়া— এই সব নিয়ে একটা ইগো সমস্যা হতেই পারে। হয়ে থাকে। জিন্দেগি বহত দেখি হ্যয় ম্যয়নে!

পত্রিকা: কিন্তু আপনার স্বামী তো আপনার সঙ্গীতের প্রেরণা ছিলেন...
গিরিজা: হ্যাঁ। ছিলেন। কিন্তু সংসারটাও করিয়ে নিতেন। আমার হাতের রান্না ছাড়া মুখে রুচত না। সংসার, সন্তান, সঙ্গীত সব রাখতে গিয়ে ঘুমটাই চলে গেল জীবন থেকে। রাত সাড়ে এগারোটা থেকে ভোর তিনটে অবধি ঘুমোতাম। তার পরই শুরু হত রেওয়াজ। তা নিয়ে অবশ্য স্বামীর কোনও আপত্তি ছিল না।

পত্রিকা: আচ্ছা সব সময় কেন মেয়েদেরই স্যাক্রিফাইস করতে হয়? শিল্পের দিকটা ছেড়ে দিতে হয় মেয়েদেরই?
গিরিজা: যেহেতু সংসারের দায়িত্বটা এখনও আমাদের দেশে মেয়েরাই নেন। এবং পরিবারের মাথা বলতে স্বামী, শ্বশুরবাড়ি। সেইজন্যই হয়। এই নিয়মের বদল হওয়া উচিত। আমি গান গাইতাম। আমার স্বামী ছিলেন ব্যবসায়ী। আমার গান শুনেই আমাকে তাঁর পছন্দ হয়েছিল। দু’জনের জগৎটা আলাদা ছিল। এবং কোনও দিন কেউ কারও কাজে নাক গলাইনি। উনি শুধু বলতেন পারিশ্রমিক নিয়ে গান গেয়ো না। এটা আমি মানিনি।

পত্রিকা: কেন?
গিরিজা: টাকার প্রয়োজন আমার ছিল না। কিন্তু বিনা পয়সায় গান গাইলে শ্রোতারা আমার সঙ্গীতের মূল্য বুঝতেন কিনা সন্দেহ। অর্থটা একটা সম্মানও। সেই জন্যই তো এখন বেশি অনুষ্ঠানে গান গাই না। আমার ছাত্রছাত্রীরা এবং অন্য অল্পবয়েসি শিল্পীরা এখন গান গেয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়। আমি সেখানে কত টাকা চাইব? কত টাকা আমার চাওয়া উচিত? ভাবুন একবার অঙ্কটা! যাঁরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়ে যান তাঁদের আমন্ত্রণে নিশ্চয়ই যাই। কিন্তু সবার ডাকে নয়।

পত্রিকা: আচ্ছা, এই যে লোকে বলে অন্নপূর্ণা দেবী যদি সেতার না ছাড়তেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের এই খ্যাতি নাকি হত না! আপনার কী মনে হয়?
গিরিজা: না, আমার মনে হয় না। রবিদার জানকারী, লয়কারী, তৈয়ারি, মেজাজ একেবারে অন্য স্তরের। আমি অন্নপূর্ণাদিদির বাজনাও শুনেছি একবার। দিল্লির তালকাটোরা গার্ডেনে। খুব মিষ্টি স্নিগ্ধ বাজনা। আমার ধারণা অন্নপূর্ণাদিদি বাজনা ছেড়ে দিয়েছেন দাদাকে ভালবেসে। দাদারই নাম-যশ হোক এই ভেবে হয়তো। রবিদার কথায় অন্নপূর্ণা বাজনা ছেড়ে দিয়েছিলেন এমনটাও নয়। এটা রবিদা করতে পারেন বলে আমার মনেই হয় না। যেমন ধরা যাক শুভলক্ষ্মী বড়ুয়া নাচ ছেড়ে দেন উস্তাদ আমজাদ আলিকে খানকে বিয়ে করার পর। হয়তো দু’ জনে মিলে অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকলে সংসার-সন্তান সব কিছুর ঠিকঠাক যত্ন হবে না এই ভেবেই। ওঁদের সঙ্গেও আমার খুব আত্মীয়তা। আমজাদকে আমি ভাই বলি। রাখি পরাই। ওদের দুই নাতি হওয়ার পর গিয়েছিলাম। আমাকে বুয়াদাদি বলে সে কী আদর!

পত্রিকা: উস্তাদ বিলায়েৎ খান আর পণ্ডিত রবিশঙ্কর, এঁদের দু’জনের মধ্যে শিল্পী হিসেবে কে বড় মাপের তা নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন ভারতের তামাম শ্রোতার মনে। আজও। আপনার কাকে বড় মনে হয়?
গিরিজা: দ্যাখো, সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হয়েছিল। ঐশ্বর্যা রাই মিস ওয়ার্ল্ড। দু’জনেই সমান সুন্দরী আমার চোখে। কম বেশির কোনও ব্যাপার নেই। রবিদা-বিলায়েৎ ভাইয়ের তর্কটারও কোনও মানেই নেই। দু’জনের বাজনা দু’রকম ভাবে শ্রুতিমধুর। একটা কথা ঠিক, রবিদা যে ভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন সেটায় হয়তো বিলায়েৎভাই ততটা উদ্যোগী ছিলেন না। কিন্তু এই দিয়ে কে বড় শিল্পী সেটা মাপা যায় না। মাপার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। দু’জন শিল্পীকেই খুব কাছ থেকে দেখেছি। রবিদা ছিলেন শান্ত মানুষ। আর বিলায়েৎভাই খুব হইহই করতে পারতেন। তফাত আমার চোখে এইটুকুই।


কখনও নিজেকে ভাবেন
রাধিকা, তো কখনও মীরা


ভাইফোঁটা দিতেন উস্তাদ
আলি আকবর খানকে


পত্রিকা: আচ্ছা আপনার গলা যে একই সঙ্গে এত মধুঝরা, তার পাশাপাশি আবার লাস্যময় এবং ভক্তিবিভোর। এই এতগুলো মিশেল হল কী করে?
গিরিজা: গুরুরা আমার গলায় সুরের বীজ বপন করেছেন আমাকে চিনতে পেরেই। এবং আমার গান গাওয়ার স্টাইলটা কেমন হতে পারে সেটা বুঝেই বিভিন্ন গান দিয়েছেন। আমি যখন শ্যামের ভজন গাই, কিংবা ঠুমরিতে গাই ‘মদ সে ভরে তোরে ন্যায়ন’তখন আমার চোখে দেবদেবী, প্রেমিক-প্রেমিকা ভেসে ওঠে। কখনও যশোদার সঙ্গে নটখট করছেন বালগোপাল, কখনও দেখি গোপিনীদের সঙ্গে শ্যামের লীলা। দেখতে পাই কিষেণজি যেন পেছন থেকে রাধার আঁচল টেনে ধরলেন এই সব অনুভূতি ঠিক এই ভাবেই গানে আসে। কিন্তু আজকের গুরুরা শিষ্যদের ঠিক চিনতে পারেন বলে মনে হয় না। বাবার কথাও মনে পড়ে। ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠিয়ে আমাকে গান গাইতে বলতেন, ঘোড়ায় চড়া শেখাতে নিয়ে যেতেন। মেজাজই ছিল আলাদা। দশ ভাইবোনের মধ্যে আমাকে দেখেই কেন জানি না ওঁর মনে হয়েছিল গান আমার হবে। এই সবই আসলে জাদু। কে কখন যে কী ভাবে জাদুস্পর্শ দিয়েছেন তা বলা কঠিন।


পত্রিকা: আপনার গানে এত কৃষ্ণরাধার কথা। এত প্রেম। এত ভক্তি মীরার ভজনে। নিজেকে কোন ভূমিকায় ভাবেন? শ্রীমতী রাধিকা না মীরাবাঈ?
গিরিজা: কখনও রাধিকা ভাবি নিজেকে। কখনও মীরা। মনে হয় গানের ভেতর দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছই। আবার কখনও আমি গিরিজাই। পর্বতরাজ দক্ষের কন্যা। যাঁর স্বামী শ্মশানবাসী মহাজ্ঞানী শিব। সবই আছে তো আমার গানের মধ্যে।

পত্রিকা: একটা অসম্ভব জনপ্রিয় ভজন আপনি কিন্তু কখনও গাইলেন না। যা কিনা লতা মঙ্গেশকর থেকে অনুপ জলোটা অনেকেই গেয়েছেন। সুরদাসের ভজন। ‘মইয়া মোরি ম্যায় নহি মাখন খায়ো’...
গিরিজা: আমি তো গাইতাম গানটা। কিন্তু যে দিন পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের গলায় ওই গান শুনলাম আমার জগৎ-চেতনা লোপ পেল। চোখ জলে ভেসে গেল। অত আবেগ দিয়ে, অত কাতর অনুনয় দিয়ে যশোদার উদ্দেশে ‘তু জননী’ ‘তু জননী’ করতে পারতাম না। বালগোপালের কী লীলা! এ যেন ভগবান এসে ভক্তের কাছে কাতর প্রার্থনা করছেন। সেই দিনই ঠিক করেছিলাম, না আর ওই গান গাইব না। গাইনি আর। কোনও রেকর্ডও পাবেন না। তবে আরও একটা গান আছে যেটা দারুণ প্রিয়। ‘বাবুল মোরা নইহার ছুট হি যায়’। এ গানে এক দিকে এক মেয়ের বাপের ঘর ছাড়ার যন্ত্রণা, অন্য দিকে জীবন থেকে মৃত্যু যাবার বেদনা। একই গানে কত অর্থ। আবার এটা দেশপ্রেমের গান। ক্রান্তিকারীর গান।

পত্রিকা: আপনার ঘরে এত পুতুল। পুতুল ভাল লাগে বুঝি?
গিরিজা: পুতুলের বিয়ে দিতে গিয়েই তো প্রথম বিয়ের গান গেয়েছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে। যা শুনে বাবা বুঝেছিলেন এ মেয়ের গানটা হবে। আসলে পুতুলেরা তখন ছিল আমার গানের শ্রোতা। আর কেউ তো শুনত না আমার গান। ভাল গান গাইলে বা বাবার যদি মনে হত আমাকে কোনও ব্যাপারে তারিফ করবেন পুরস্কার হিসেবে পুতুল দিতেন। সেই থেকে পুতুলের নেশা।

পত্রিকা: মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন যারা খুব পুতুল খেলে, এবং বড় হয়েও পুতুল ভালবাসেন তাঁরা কোথাও খুব একা।
গিরিজা: এক সুনাপন হর কলাকারো মেঁ রহতা হ্যায় বেটি! একাকীত্ব সব শিল্পীরই আছে। আর একাকীত্ব আছে বলেই সে শিল্পী। আমারও হয়তো সেই একাকীত্ব আছে।

পত্রিকা: আপনার মেয়ে তো ওড়িশি নাচেন। পরিবারে আপনার গান কাউকে দিয়ে যেতে পারলেন না বলেই কি এই একাকীত্ব?
গিরিজা: আমার ছাত্রছাত্রীরাই তো আমার সন্তান। সঙ্গীতের জগতে অত আপন-পর নেই, বললাম না! শুধু একটা কারণেই খেদ হয়। ভেবেছিলাম একটা সঙ্গীতের আশ্রম গড়ে তুলব। গুরুকুল শিক্ষায় শিষ্যরা গান শিখবেন। রাজ্য কী কেন্দ্র সরকার, কারও সাহায্য পাইনি। হোমড়াচোমড়াদের দরজায় গিয়ে ধরনা দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে হল না। সব কিছু এক জীবনে তো হওয়ার না। আমি তো তাই বলি শিল্পীদের জন্মান্তর থাকা উচিত। অনেক স্বপ্ন অনেক কাজ বাকি থেকে যায়। মনে হয় গানটাই ভাল করে শেখা হল না। আরও অনেক শিখতে হবে।

পত্রিকা: পরজন্মে যদি ফিরে আসেন তা হলে কেমন ভাবে ফিরবেন?
গিরিজা: গিরিজা হয়েই। যা গান শেখা হল না সব শিখব। যা অন্যদের জন্য করে যেতে পারলাম না করব। এ জন্মে যাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে যেন আগামী জন্মে আবারও দেখা হয়। ফির মিলেঙ্গে। আবার ফিরে আসতে চাই। ভগবানকে পাস ব্যস ইয়ে এক হি বিন্তি হ্যায়। ফির ভেজনা মুঝে....

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement