কিরীটী রায়

নিশুত রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসাডর। দরজা খুলে নেমে এল আগাপাস্তলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ।... সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের মানসপুত্রের রহস্যভেদের আনাচেকানাচে ঘুরলেন সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সর্বাণী মুখোপাধ্যায়নিশুত রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসাডর। দরজা খুলে নেমে এল আগাপাস্তলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ।... সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের মানসপুত্রের রহস্যভেদের আনাচেকানাচে ঘুরে দেখা

Advertisement

সহ প্রতিবেদক: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৩
Share:

রাত্রি তার ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে বিরাট এ কলকাতা মহানগরীর বুকে।

Advertisement

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।

জনহীন রাস্তা যেন ঘুমন্ত অজগরের মতো গা এলিয়ে পড়ে আছে। সাড়া নেই, শব্দ নেই।...

Advertisement

কিরীটী একা একা পথ অতিক্রম করে চলেছে। পকেটের মধ্যে কালো পাথরের ড্রাগনটি।

আশ্চর্য, কিরীটীর যেন মনে হয়, নিঃশব্দে কে বুঝি আসছে কিরীটির পিছু পিছু!

যে আসছে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, সে আসছে।

কিরীটী। কিরীটী রায়। নামটা বলা মাত্রই বইয়ের পাতা ফুঁড়ে উঠে আসে ‘ইরেজিস্টেবল’ এক পুরুষ। নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখনি-সন্তান। সত্যসন্ধানী।

চেহারার বর্ণনা— ‘‘প্রায় সাড়ে ছ-ফুট লম্বা। গৌরবর্ণ। মজবুত হাড়ের ফ্রেমে বলিষ্ঠ এক পৌরুষ। মাথা ভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা। নিখুঁতভাবে কামানো দাড়িগোঁফ। ঝকঝকে মুখ। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আমুদে, সদানন্দ। এবং প্রখর রসবোধ। অসাধারণ বাকচাতুর্য। কিন্তু মিতবাক।’’

এ-ই কিরীটী রায়। যে নামের সঙ্গে ওই চরিত্র এক অনিবার্য আকর্ষণে দুর্দান্ত শরীরী আর জীবন্ত। অসম্ভব উজ্জ্বল তার পুরুষালি উপস্থিতি। প্রত্যেকটা জায়গায়। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দার এমন হাজিরা বোধহয় সেই প্রথম বার।

বইয়ের কুচকুচে কালো প্রচ্ছদ। তাতে অদ্ভুত এক হলদেটে আঁচড়ে পুরুষমুখের সাইড ফেসের সিল্যুট। মাথায় সাহেবি টুপি একটু বাঁকানো। টুপির হুডে কপালের অর্ধেকটা ঢাকা। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট। তার থেকে ধোঁয়া উঠছে।

নিশুতি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসাডর। দরজা খুলে ততোধিক নিঃশব্দে নেমে আসে আগাপাস্তলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মার্জারি ক্ষিপ্রতা। দৃঢ় পা ফেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যায় নিশানার দিকে। অটল লক্ষ্যভেদ।

সত্তর-আশির দশকের সদ্য ফোটা কিশোরী থেকে প্রায় সব যুবতীর ‘হার্টথ্রব’ এই কিরীটী রায়। আর কিশোর-যুবকদের কাছে তিনি যেন লৌহমানব!

কিরীটী রায় বিবাহিত। তার স্ত্রী কৃষ্ণা। টালিগঞ্জের বাড়ির সংসারে আছে ড্রাইভার হীরা সিং, পরিচালক জংলী। প্রায় সব সময় সঙ্গে থাকে সহকারী সুব্রত।

ঘোরতর সংসারী। কিন্তু রক্তমাংসের ভেতরে ঢুকে প্রবলপ্রতাপান্বিত এই কিরীটী অবলীলায় শরীরমনের দখল নিয়েছে বছরের পর বছর। চুম্বক টানে আবিষ্ট করে তার পুরো অধিকার কায়েম করেছে। অলস সময়ে ক্যাজুয়াল ড্রেসে হয় ড্রেসিং-গাউন নয়তো, ‘‘কিমানো পরে পাইপে ধূমপান করতে করতে মাঝেমাঝেই তার টালিগঞ্জের বাড়ির পোর্টিকোতে এসে’’ দাঁড়ায় সে, আর কেজো সময়ের কিরীটী মানেই কালো অ্যাম্বাসাডর, হাভানা চুরুট আর কালো পানামা হ্যাট...!

সময়ের ফেরে দৃশ্যপট বদলে বদলে যেত শুধু। কিন্তু কিরীটীকে ঘিরে মৌতাত যেন কিছুতেই পাল্টানোর নয়।

কেমন করে ‘জন্ম’ হল এমন প্রবল পরাক্রম ‘পুরুষ’ কিরীটী রায়ের? কেনই’বা?

নীহাররঞ্জন বলছেন, ‘‘আমি অনেক রহস্যকাহিনি রচনা করেছি। এর মূলে আছে আমার জীবনে দেখা দুটি ঘটনা। যা, বিশেষ করে দ্বিতীয়টি, মনকে নাড়া দিয়েছিল সাঙ্ঘাতিক ভাবে। এবং সেটা আমার প্রথম যৌবনকাল।’’

পটভূমি তাঁরই পাড়ার এক পোড়ো জমিদারবাড়ি। যেখানে এক দুপুরে অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা বৌদিকে গুলি করে খুন করে যক্ষারোগ-আক্রান্ত তাঁর রুগ্ণ সুপুরুষ দেওর। সঙ্গে সঙ্গে ওই বন্দুকেই শেষ করে দেয় নিজেকে।

লেখক বলছেন, ‘‘ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে দুটি দেহ। রক্ত চাপ চাপ জমাট বেঁধে আছে। কে বুঝি সাদা পাথরের মেঝের ওপর মুঠো মুঠো রক্তগোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশে পড়ে দোনলা বন্দুকটা।

আর প্রথম ঘটনাটি তাঁর বাল্যকালের। তাঁরই বিচারে, ‘‘সেটি মর্মন্তুদ হলেও তার মধ্যে তেমন রহস্যের ইশারা ছিল না। সেটি ছিল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা।’’

দুটি ঘটনারই কেন্দ্রে অসামান্যা রপসী দুই যুবতী নারী, অবৈধ ত্রিকোণ প্রেম, পরিণতিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু। নীহাররঞ্জনের কথায়, ‘‘কেউ জানতেও পারল না মেয়েটি তার গোপন ভালবাসার জন্যই শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।’’

সকলের অজ্ঞাত সেই মৃত্যুর কারণ বহুদিন তাঁর মনের মধ্যে প্রকাশের তাগিদে তাঁকে পীড়ন করেছে। ‘‘এবং সেই তাগিদই পরবর্তী কালে আমার প্রথম যৌবনে জমিদারিবাড়ির নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘জোড়া খুন’ রহস্য কাহিনি রচনা করতে।’’

সেই যে বীজ পোঁতা হয়েছিল, তার থেকেই মগজের কোষে জন্ম নিয়েছিল কিরীটী রায়ের ভ্রূণ।

কিরীটী-জন্মের পূর্বশর্ত হিসেবে যদি কাজ করে থাকে এ দু’টি কাহিনি, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই গোয়েন্দা কাহিনি-লেখক পাঁচকড়ি দে।

নীহাররঞ্জন নিজে জানিয়েছেন, ‘‘ইতিপূর্বে পাঁচকড়ি দে’র খানকয়েক রহস্য উপন্যাস পড়েও ক্রাইমজগতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল। কেবল পরিচয়ই নয়, মনের মধ্যে কিছুটা রোমাঞ্চও সৃষ্টি করেছিল। ... গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে রীতিমতো যেন একটা রোমাঞ্চকর আকর্ষণ অনুভব করতাম।’’

পাঁচকড়ি দে। ঊনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিক জুড়ে গোয়েন্দাকাহিনি রচনায় দাপটে আধিপত্য করে গেছেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম রহস্য উপন্যাস লেখক হিসেবে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের নাম করা হয়। পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন, অপরাধ জগৎ নিয়ে জানাবোঝা ছিল তাঁর অগাধ। তবু বাংলায় রহস্যরোমাঞ্চ লেখার গোড়ার পর্বে তাঁকে টেক্কা দিয়েছেন পাঁচকড়ি। তাঁর ‘হত্যাকারী কে?’, ‘নীলবসনা’ সেই সময়ে ঘোরতর আলোড়ন ফেলে দেওয়া কাহিনি।

পাঁচকড়ি দে’র যে গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে নীহাররঞ্জন ‘রীতিমতো আকর্ষণ’ অনুভব করতেন, সেই ডিটেকটিভ-চরিত্র দেবেন্দ্রবিজয়— ধূতিপাঞ্জাবি, পাম্পশ্যু, অ্যালবা়ট কাটা চুলের শক্ত শারীরিক কাঠামোর এক নিপাট বাঙালি। যে আড়ি পেতে অপরাধীদের কথা শোনে। ছ্যাকরা গাড়িতে করে তাদের তাড়া করে। তার চরম প্রতিপক্ষ পাপিষ্ঠা জুলিয়া। আর তার গুরু অরিন্দমবাবু। যে অনেকটা শার্লক হোমস-এর দাদার মতো। রাস্তাঘাটে বেশি বেরোয় না। বাড়িতে বসে রহস্যের ‘ডিটেকশন’ করে।

এই পাঁচকড়ি দে’র দেবেন্দ্রবিজয় এক ইউনিক বৈশিষ্ট্য রাখে তাঁর ‘বিষম বৈসূচন’ কাহিনিতে। বৈসূচন— অর্থাৎ নারীবেশে ছলনাকারী পুরুষ।

সেই সময় এমনই জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর গোয়েন্দাকাহিনি, যে তখনকার এক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, যোগেশচন্দ্র বাগলদের মতন দিকপালদের সঙ্গে পাঁচকড়ি দে নামটি বড় ‘পয়েন্ট সাইজ’-এ ‘বিশেষ আকর্ষণ’ হিসেবে বিজ্ঞাপন করা হয়েছিল।

পাঁচকড়িতে প্রচণ্ড আকর্ষিত হলেও কিন্তু নীহাররঞ্জনের কিরীটী এই ঘরানা থেকে একেবারেই আলাদা। দেবেন্দ্রবিজয়ের নিপাট বাঙালি চেহারা বা স্বভাবের সঙ্গে কোথাও কিরীটীর অণুমাত্র মিল নেই।

তেমন মিল নেই অন্য কোনও গোয়েন্দাজুটির সঙ্গে। সে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জয়ন্ত-মানিক, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-তোপসে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ-অজিত— যেই হোন না কেন!

এদের সক্কলের থেকে এক্কেবারে অন্যরকম কিরীটি-সুব্রত। মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপের বাইরে বাঁচা দু’জন মানুষ। এদের আছে সব সময়ের গাড়ি, আছে হোটেল-বিলাস। অ্যাসিসটেন্ট সুব্রত তো এক-এক সময় প্রায় নায়কোচিত।

এ প্রসঙ্গে পরে ফিরছি। তার আগে কিরীটী-কাহিনির অন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলে নিই। —গোয়েন্দাকাহিনির ভেতরে যৌন-আবেগ, রিরংসা, প্রচণ্ডতা মিশিয়ে নীহাররঞ্জন একেবারেই দলছুট করে দিয়েছিলেন কিরীটী-রহস্যরোমাঞ্চর কাহিনিগুলোক। বলা যেতে পারে, বাংলার এই কাহিনি-ধারাকে অনেকটা ‘এ’ মার্কা করেছেন নীহাররঞ্জনই।

কেমন? নমুনা দেওয়া যাক।

‘আলোক আঁধারে’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পিকনিক। তার মাঝেই খুন হল দলের মক্ষিরানি মিত্রাণী। পোস্টমর্টেম করে পুলিশ জানতে পারল, কেবল খুন নয়, তার আগে তাকে ধর্ষণও করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে নেমে কিরীটীর প্রাথমিক অনুমান, হত্যাকারী এমনই একজন, যে মেয়েটিকে দীর্ঘদিন ধরে চিনত। গভীরভাবেই আসক্ত ছিল তার প্রতি। আর এই দৈহিক লালসাই খুনের কারণ।

‘‘নগরনটী’’। এখানেও গল্প দানা বাঁধছে যাদের নিয়ে, তাদের পরিচয়গুলো একবার দেখুন। এক সুন্দরী নারী, তার অক্ষম স্বামী, তিন জন পুরুষ-মক্ষিকা, এক চিত্রাভিনেত্রী।

এর পর ‘অহল্যা ঘুম’, ‘হীরকাঙ্গুরীয়’, ‘ঘুম ভাঙার রাত’, ‘নীলকুঠি’ এই চারটি গল্পর কথায় আসুন। প্রতিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে যৌনবোধের বিকৃতি। এ ভাবে মাঝে মাঝেই যৌনতা বিভিন্নভাবে কাহিনির মূল উপজীব্য হয়ে ধরা পড়েছে নীহাররঞ্জনের কাহিনিতে।

আরেকটি ব্যাপারও আছে। পেশায় ডাক্তার নীহাররঞ্জন চিকিৎসাশাস্ত্রের কিছু জ্ঞান তাঁর কাহিনির মধ্যে এনেছেন প্রায়ই। ‘ক্যাকটাসের বিষ’, ‘মরফিন’, ‘একিমোসিস’ ‘হাইপোডার্মিক নীডল’-এর মতো গল্পে তার নমুনা মিলেছে। নীহাররঞ্জনের কাহিনিতে প্রায়ই প্রাধান্য পেয়েছে অবচেতন মনের দুঃস্বপ্ন, মৃত্যুভয়, আত্মহত্যা প্রবণতার মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।

একটি কাহিনিতে উনি দেখাচ্ছেন, ভয় থেকে কী ভাবে মানুষের স্মৃতিভ্রংশ বা অ্যামনেসিয়া হয়। এ ধরনের উপাদান বাংলা রহস্যকাহিনিতে হয়তো’বা তাঁরই সংযোজন। হিচকক-এর গল্পে যার ছায়া আছে, কিন্তু বাংলায় কিরীটীর আগে এ ধরনের বিষয় কেউ দেখেছেন কি?

তৃতীয় যে বিষয়টি কিরীটীকে একটু হলেও আলাদা করে তা হল, জীবনদর্শন নিয়ে সে খুব স্পষ্টবাদী। সোচ্চার। স্বচ্ছও।

এ নিয়ে কিরীটী অমনিবাসের এক খণ্ডের ভূমিকায় বার্ণিক রায়ের কথা শোনা যাক— ‘‘কিরীটীর ধর্মবোধ লেখকেরও, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে যার মিল প্রচণ্ড। কেননা: ‘প্রৌঢ় বয়েসে পৌঁছে বুঝতে পারছি— সব কিছুর ওপরে একজন আছেন। — তিনি পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তাঁর এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও। ভুলে যাও সব ব্যাপারটা।’’’

‘রহস্যভেদী’ গল্পের উদাহরণ দিচ্ছেন তিনি। —‘‘বন্ধুর পিসিমা যখন তাঁর বখা ছেলের ত্রাণের জন্য জমির দলিল চুরি করে পুত্র শম্ভুকে রাত্রে হাতে তুলে দিতে গিয়ে কিরীটীর কাছে ধরা পড়েছে, তখন পিসিমার মাতৃহৃদয়ের কান্নার কাছে তার সত্যানুসন্ধানকে সে প্রকাশ করতে পারেনি, দলিল ফিরিয়ে দিয়েছে বটে বন্ধুর পিতাকে, কিন্তু কী ভাবে কার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তা সে ... প্রকাশ করতে পারে নি। সে বলছে: কাকাবাবু, পৃথিবীতে সব অপরাধেরই কি শাস্তি হয়? আপনার দলিলের প্রয়োজন, দলিল পেয়েছেন। আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে— এ বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্চ্য করতে পারবেন না আপনি।’’’

আরেকটি জায়গার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেখানে কিরীটী বলছেন— ‘‘এ সংসারে পাপ-পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পুরস্কার, পাপের তিরস্কার— এটাই নিয়ম। আজ পর্যন্ত পাপ করে কেউ রেহাই পায়নি। দৈহিক শাস্তি বা দশ বছরের জেল হওয়া অথবা দ্বীপান্তরে যাওয়াটাই একজন পাপীর শাস্তিভোগের একমাত্র নিদর্শন নয়। ভগবানের মার এমন ভীষণ যে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরও তার কাছে একান্তই তুচ্ছ।’’

গোয়েন্দা হয়ে এমন দার্শনিক কথা আর কাকে বলতে শুনেছি!

ক্ষুরধার বুদ্ধি। কিন্তু ঘরে বাইরে নির্ভেজাল বাঙালি। কথাতেও ছুরি বসাতে পারেন, কিন্তু গাড়িটা, বাড়িটা নিজের নয়। জ্ঞানে ঋদ্ধ, কিন্তু শখ-আহ্লাদের বিশেষ বহর নেই। সাজেও যে বাহার আছে, তাও নয়।

কিরীটী-পূর্ব তো বটেই, কিরীটীর সময়েরও প্রায় সব রহস্য-সন্ধানীর পরিচয়ই তাই। সবারই একটা ঘরেলু ভাব।

যে-কারণে সিনেমায় ব্যোমকেশ চরিত্র করার জন্য উত্তমকুমার পর্যন্ত নিজেকে ‘ডিগ্ল্যামারাইজ’ করেছিলেন।

নীহাররঞ্জনের কিরীটী কিন্তু প্রথম থেকেই স্টার। বাঙালি হয়েও নিখুঁত তার সাহেবিয়ানা। অসম্ভব স্টাইলিশ। দুর্দান্ত গ্ল্যামারাস। অমোঘ তার স্টার আকর্ষণ। কেন? আলাদা করে কোনও ব্যাখ্যা নেই। নেই কোনও বিশদ বর্ণনাও।

কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস বা আগাথা ক্রিস্টির হারকিউল প্যয়রো জন্মগতভাবে ওয়েষ্টার্ন, তবু বিনা আয়াসে, সহজাত দক্ষতায় তার দারুণ সাহেবিয়ানায় কিরীটী কোথায় যেন ওঁদেরও পাল্লা দেন। সেটা শুধু তাঁর হ্যাট-কোট, স্যুট-বুট, হাভানা চুরুট বা কেতা দুরস্ত ইংরেজি কথার জন্য নয়! বারবার মনে হয়, তার এই নিখুঁত ওয়েস্টার্ন ইমেজ, স্টাইল এবং গ্ল্যামার এক্কেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা— ‘কামিং ফ্রম উইদিন’। এবং এখানেই নীহাররঞ্জনের অসাধারণ মুন্সিয়ানা।

এমন এক গোয়েন্দাপ্রবরের কথা নীহাররঞ্জন ভেবেছিলেন, নির্ঘাত অনেক অঙ্ক কষেই, নইলে ‘স্টার্টিং পয়েন্টে’ই ফারাকটা এ ভাবে চোখে পড়ত না। অথচ এই নায়কোচিত সত্যসন্ধানীর জন্মটা হয়েছিল একেবারেই আকস্মিক! বড়ই আচমকা। আলটপকা।

সে কেমন?

‘কালো ভ্রমর’ কিশোর ক্রাইম-থ্রিলার–এর সাত বছর কেটে গেছে। মেডিকেল কলেজের ফিফথ ইয়ারের ডাক্তারি-ছাত্র তখন নীহাররঞ্জন। সে সময়ই তিনি হঠাৎই লিখলেন দ্বিতীয় পর্বের ‘কালোভ্রমর’। তাতেই আবির্ভাব কিরীটী রায়ের।

নীহাররঞ্জন নিজে স্বীকার করেছেন, ‘‘... আজ মনে হয় ভাগ্যিস ‘কালোভ্রমর’ দ্বিতীয় পর্ব রচনায় হাত দিয়েছিলাম, নচেৎ ‘কিরীটী’ হয়তো কোনও দিনই জন্মাত না।’’

সত্যিই, কালো ভ্রমরের মতো দুর্দান্ত খলনায়কের জন্য দরকার হয়েছিল তেমনই একজন প্রোটাগনিস্ট— নায়ক। শুধু নায়ক নয়, অধিনায়ক— ক্যাপটেন!

ওইরকম দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালের সঙ্গে সমান তালে মোকাবিলা করার জন্য। জন্ম হল কিরীটী রায়ের মতো সত্যসন্ধানীর। যে যুদ্ধ জয় করবে ক্ষুরধার মগজ দিয়ে। তার অসম্ভব শরীরী আকর্ষণের উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি দিয়ে। এবং শেষমেশ নিশ্চিতভাবে হারিয়ে দেবে তার ‘সুপিরিয়র হিউম্যানিটি’ দিয়ে।

মনে করুন, শেষ পর্যন্ত কিরীটী রায় অসীম করুণায় ফাঁসির দড়ি না পরিয়ে নিজের জীবন নিজেকেই শেষ করার সুযোগ দিয়ে সম্মান দেখায় কালো ভ্রমরের মতো ‘গুণী’ দুর্বৃত্তকে।

এই মানবিকতা, এই মহত্ত্ব কিরীটী রায়কে সুপার হিরো করেছে। এ ব্যাপারে নীহাররঞ্জন বলছেন, ‘‘সে এমন একটা মানুষ— এমন একটা চরিত্র— যার প্রথম প্রকাশই হবে বিশেষ একটা আবির্ভাব। একটা ক্যারেকটার... চরিত্রও চিন্তা করে নিলাম, কিন্তু কী দেব তার নাম?’’

এ নিয়েও কম ফাঁপরে পড়েননি তিনি। ভাবেন, ভাবেন আর ভাবেন। কত নাম লেখেন, আর কাটেন।

শেষে পথ দেখাল কিনা দার্জিলিঙে কাঞ্চনজঙ্ঘা!

বিশাল পাহাড়ের সামনে দাঁড়ানো অসহায় জনক। কুয়াশা আর মেঘে সব ঢাকা। হঠাৎই সরে গেল মেঘ। মিলিয়ে গেল কুয়াশা। কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারচুড়ো ঝলমল করে উঠল। সূর্যের সোনালি আলোয়। লেখক মুগ্ধ চোখে দেখলেন সোনার কিরীট পরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। ধবল চুড়োয় অপূর্ব সোনার মুকুট। মুহূর্তে ঝলসে উঠল সঠিক নাম। সোনার মুকুট— সোনার কিরীট যে ধারণ করে সে-ই তো কিরীটী! পুরো নাম ‘কিরীটী রায়’।

জোর করে সাহেব বানানো ‘রে’ নয়’ অথচ পুরোদস্তুর সাহেবি কেতার টিপটপ দুর্দান্ত চরিত্র তার ব্যক্তি পরিচয়ে নিখাদ বাঙালি।

অনেকটাই মনে করায় জেমস্ বন্ড-কে। গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা ব্লন্ড চুলের লাস্যময়ী সুন্দরী নিয়ে শন কনারি বা রজার মুরের দারুণ ম্যাসকুলিন জেমস বন্ড। সিনেমার পরদায় চোখে দেখা তাঁদের অ্যাপিলের সঙ্গে কোথায় যেন মিলে যায় চোখে না-দেখা পৌরষের বাঙালি কিরীটী রায়!

কিরীটীর এই গ্ল্যামার নড়িয়ে দিয়েছিল খোদ মহানায়ককেও! এতটুকু বাড়িয়ে বলা নয়, বাঙালির চূড়ান্ত ‘গ্ল্যামারগন’ এই পুরুষ একেবারে মোহাচ্ছন্ন, আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন কিরীটীতে।

এতটাই সে প্রবল আকর্ষণ যে, ‘কিরীটী রায়’ করার আর্জি নিয়ে উত্তমকুমার নিজে একবার গিয়েছিলেন নীহাররঞ্জনের কাছে। ঘটনাটি শোনা লেখকের সেজ মেয়ে করবী সেন ও নাতনি চন্দ্রিকার কাছে।

তারপর? সটান ‘না’ করে দিয়েছিলেন কিরীটীর ‘জনক’।

কারণ? তাঁর কাছে সেলুলয়েডের একমাত্র কিরীটী রায় ছিলেন অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অজিতেশ অবশ্য কোনওদিনই জানতে পারেননি সে-কথা। কেননা তাঁকে জানাননি লেখক। তিনি নাকি ছিলেন নীরব-অপেক্ষায়! তাই’বা কেন, সে-রহস্যের অবশ্য সমাধান হয়নি আজও।

অনুমান একটা করা যায় বটে।

মানসপুত্রের স্নেহে ভালবাসায় নীহাররঞ্জন ছিলেন অসম্ভব জারিত। হয়তো’বা অতিরিক্ত স্পর্শকাতরও। যে কারণে কিরীটীকে নিয়ে একের পর এক অভিযানে নামা তাঁর পক্ষে যতটা সহজ ছিল, তাঁর ‘অবয়বকে’ বাস্তবে রূপ দেওয়ার পেছনে তিনি ছিলেন ততটাই দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়াকীর্ণ। কে বলতে পারে, হয়তো আতঙ্কিতও!

প্রৌঢ়ত্বের শেষে এসে তিনি একবার বলেন, ‘‘অনেক কথা আজ আর আমার মনেও পড়ে না— কেবল মনে আছে আমি পেয়েছিলাম ‘আমার কিরীটী’-কে... অনেক কাহিনি রচনা করেছি কিরীটীকে কেন্দ্র করে এবং সে সব ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছে আমার ওই ‘কিরীটীই’। আমার সৃষ্ট বহু চরিত্রের মধ্যে যে একক— অনন্য।’’ ... এও বলছেন তিনি, ‘‘আমি জানি ‘কিরীটী’ শুধু একা আমার নয়— বহু বহু জনার প্রিয়— আমার লেখক জীবনের সে এক বিশেষ প্রাপ্তি— স্বীকৃতি। ...প্রৌঢ়ত্বের সীমা অতিক্রম করতে বসে আজ তাই বারবার মনে হয় ওকে খুঁজে না পেলে আমার কিছুই পাওয়া হত না।’’ মানসিক ভাবেও তিনি কিরীটীর সঙ্গে কতটা সংযুক্ত ছিলেন, এ ক’টা কথাতে বোধহয় তার জোরালো ছায়া মেলে।

কিরীটী রহস্য গোগ্রাসে গিলতে গিলতে বড় হয়েছেন বা প্রাপ্ত বয়েসেও কিরীটী-আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারেননি, এমন মানুষ আজও অগুনতি। পরের পর কাহিনিগুচ্ছের বিশাল ব্যাপ্তিতে অসম্ভব রকম জীবন্ত, বিভিন্ন এবং অনন্য কিরীটী রায়। কখনও তার দেখা মিলেছে ‘রহস্যভেদী চক্রী’ বা ‘হলুদ শয়তান’-এ, কখনও ‘ডাইনীর বাঁশী’ থেকে ‘বিষকুম্ভ’, ‘মৃত্যুবাণ’, ‘আদিম রিপু’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘পদ্মদহের পিশাচ’-এ অথবা কখনও ‘অবগুণ্ঠিতা’র মতো কাহিনিতে। প্রত্যেকটি কাহিনির এমনই পরিণতি, অন্তিম শব্দটা পড়ার পরও কেবলই যেন গুনগুন করে ভেসে ওঠে একটিই বাক্য— শেষ হইয়াও হইল না শেষ!

‘কিরীটী তত্ত্বে’ আবিষ্ট প্রমথনাথ বিশীর দরাজ সার্টিফিকেট— ‘‘কাহিনী শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কাহিনীর ঊর্ধ্বে জেগে থাকে পাঠকমনে রহস্যকাহিনীর রহস্যভেদী নায়ক কিরীটী রায়ের ব্যক্তিত্ব, তার তীব্রতীক্ষ্ণ যুক্তিবোধ, পরিমিতিবোধ, ক্ষুরধার বুদ্ধির মালিন্যমুক্ত ঔজ্জ্বল্য নিয়ে। যা কিরীটী রায়কে সমসাময়িক ডিটেকটিভ কাহিনীর নায়কদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছে এবং তার স্রষ্টাকে দিয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রত্যক্ষ সাফল্য।’’

নীহাররঞ্জন গুপ্তকে আমি প্রথম দেখি তাঁর ধর্মতলার ডাক্তারি চেম্বারে। বড় ঘর, মস্ত টেবিলের ও ধারে বসা। এক মাথা ব্যাকব্রাশ চুল, কালচে-তামাটে গায়ের রং, চওড়া মজবুত কাঠামো। মোটা চশমার কাচের ভেতর ঝকঝকে চোখ। ব্যক্তিত্বময় সম্ভ্রান্ত চেহারা।

সে দিনের কথা একটু বলতেই হয়। নইলে কিরীটীকে ঘিরে তাঁর কিছু উচ্চারণ হয়তো গোপন করা হবে।

বাবাকে ডেকেছিলেন। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমি তখন বেশ ছোট। আমায় দেখে বললেন, ‘‘এতটুকু মেয়েকে এর মধ্যে এনেছ কেন?’’

‘এর মধ্যে’ মানে, মারণরোগ ধরা পড়া একমাত্র ছেলের ব্যাপারে কথাবার্তায়। বাবা বলেছিলেন, ‘‘ও সব জানে।’’ তারপর আমাকে বললেন, ‘‘জেঠু হন, প্রণাম করো।’’

কাছে যাওয়ার আগেই হাঁ হাঁ করে বাধা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, টান টান ঋজু, মাঝারি লম্বা। বললেন, ‘‘প্রণাম করতে হবে না। বোসো, বোসো,’’ বলে নিজে আবার বসে পড়লেন। একটু চুপ করে থেকে বাবাকে বললেন, ‘‘তুমি লিখছ না কেন? এ রোগের চিকিৎসার এলাহি খরচ। টাকার জন্যও তো লেখা দরকার।’’

অনুজ সাহিত্যিক খানিক চুপ থেকে বললেন, ‘‘পারছি না দাদা। লেখা আসছে না।’’

এর পর যে কথাগুলি বলেছিলেন এত দিন বাদেও সেগুলি যেন কানে বাজে।

বিষণ্ণ দরদি অগ্রজ বললেন, ‘‘জানি, তবু লিখতে তোমাকে হবেই। এখন রোম্যান্টিক লেখা, প্রেমের গল্প তোমার কলমে আসবে না। তুমি রহস্যকাহিনি লিখতে চেষ্টা করো। এটা একটা নেশার মতো।’’

বাবা বলেছিলেন, ‘‘ও আপনি পারেন, আমার দ্বারা হবে না।’’

উনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘খুব হবে। কলম ধরতে জানো যখন ঠিক পারবে। ডিসেকশন— মনে মনে ডিসেকশন করে আগে নিজেকে দু’ভাগে কাটো। প্রথম ভাগে নিজে ক্রিমিনাল হয়ে ক্রাইম-রহস্য-রোমাঞ্চ হোয়াটেভার স্টোরি তৈরি করো। তারপর তোমারই দ্বিতীয় ভাগটা দিয়ে একজন ডিটেকটিভ চরিত্র হয়ে যাও। ভাবো একজন গোয়েন্দা হলে কী করত। পুরো ঘটনাকে আবার চিরে চিরে ডিসেকশন করতে থাকো। আমরা যেমন মানুষের ফিজিকাল অ্যানাটমি জানতে ডেডবডিকে করি। ঠিক সেই রকম করে ডিসেকশন করতে করতে ঘটনার একেবারে ভেতরে ঢুকে যাও। দেখবে, তখন নিজে নিজেই বেরিয়ে আসবে সমাধান।’’

নিজের মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে দেখিয়েছিলেন, ‘‘এই ইনটেলেকচুয়াল ডিসেকশন এইখান থেকে হয়। এ ভাবেই আমি আমার সমস্ত রহস্যকাহিনি লিখি, কিরীটী লিখেছি।’’

তারপর বললেন দুটি শব্দ, ‘‘মগ্ন হও। ... সব একপাশে সরিয়ে রেখে নিজের সাধনায় মগ্ন হও। এ ছাড়া কোনও পথ নেই।’’

কে ভুলতে পারে, এই মগ্নতাই যে তাকে কিরীটী দিয়েছিল— কিরীট মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা!

ঋণ স্বীকার: দেশ সাহিত্য সংখ্যা (১৩৮২) কিরীটী অমনিবাস (মিত্র ও ঘোষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement