ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
উস্তাদ আমজাদ আলি খান তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, স্টেজে উনি যদি চান, মেশিনগানের মতো হতে পারেন। আবার যদি মনে হয়, তা হলে রসগোল্লার মতো মিষ্টি বাজনাও বাজিয়ে দিতে পারেন।
ইহুদি মেনুইন তাঁকে ভারতের অ্যাসেট হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
জর্জ হ্যারিসন তাঁর তবলা শুনে বলেছিলেন, তিনি সঙ্গীতের জন্য একনিষ্ঠ ভাবে ‘পারকাসিভ’ আর ‘হারমোনিক’ সেবা করে চলেছেন।
পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
নিজের এ সব প্রশংসা শুনলে চোখের কোণে জল আসে তাঁর।
৪৫ বছরের সঙ্গীত জীবনের নানা ওঠাপড়ার গল্প করতে গিয়ে উঠে আসে ভাল লাগার কথা। তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে জমে থাকা কিছু ক্ষোভ। দেশ-বিদেশে এত কনসার্ট, এত গুণিজনের প্রশংসা— তবু কেন সরকারি পুরস্কারের ঝুলিটা প্রায় শূন্যই থেকে গিয়েছে?
পত্রিকা: মার্সিডিজ গাড়ি, ৫ হাজার স্কোয়্যার ফুটের বাড়ি, কনসার্ট করতে গেলে বিজনেস ক্লাস ছাড়া যাতায়াত করেন না। আয়নার সামনে আজ দাঁড়ালে দত্তপুকুর লোকালের ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া সেই অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে?
অনিন্দ্য: একটা সময় ছিল যখন দত্তপুকুর লোকাল ট্রেনের ভেতরে ঢুকতে পারিনি। স্টেশন থেকে দু’মাইল সাইকেলে করে গেলে তারপর আমাদের গ্রাম। যতই মার্সিডিজ চড়ি না কেন, সে সব স্মৃতিগুলো ভুলব কী করে?
পত্রিকা: সাইকেল থেকে মার্সিডিজ চড়তে কত বছর লেগে গেল আপনার?
অনিন্দ্য: তিরিশ বছর। গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে তালিম নেওয়া, গুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসা— এ সবের জন্যই তো আজকে আমি এই জায়গায় পৌঁছেছি। আজ আমার ৬১ বছর বয়স। জীবনটাকে যদি কোনও রাগ হিসেবে দেখি, তা’হলে তার আলাপটা তো শুরু হয়েছিল ৭০-এর দশকে। তখন সদারং, তানসেন সঙ্গীত সম্মেলন-এ বাজানোর সুযোগ পেলে কনসার্ট সেরে শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরতাম...
পত্রিকা: ফিরে দেখলে এমন কোনও ঘটনা মনে পড়ে যা এখন ভাবলে আশ্চর্য লাগে?
অনিন্দ্য: দুর্গাপুরের একটা কনসার্ট। ’৭২ সাল নাগাদ হবে। সন্ধেবেলা আমার আইটেম ছিল এক স্থানীয় বাঁশুরিয়ার সঙ্গে। মাঝখানে অন্য একটা ডুয়েট ছিল। তাতে জাকির ভাইয়ের তবলা। লাস্ট আইটেম ছিল যোগ সাহেবের ভায়োলিন। সঙ্গে আমার তবলা। শেষ রাতে যখন বাজাতে উঠছি, শুনি দর্শক চিৎকার করে বলছে, ‘জাকির হুসেন চাই! জাকির হুসেন চাই!’ আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম, সেই সন্ধে থেকে বাজালাম আর তা’ও শ্রোতারা এই রকম করছে? তবে আজ ওদের দোষ দিই না। আমি তখন অনামী শিল্পী। তাই ‘জাকিরকে চাই’ বলাটা ওদের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। শুধু দর্শক নয়, এমনও হয়েছে যে, অর্গানাইজাররা আমাকে চাননি। পরের বছর সেই দুর্গাপুরে আমার নামে হাউসফুল হয়েছিল। স্ট্যান্ডিং ওভেশন-ও ছিল।
পত্রিকা: এ রকম প্রতিকূল পরিবেশে বাজিয়েছেন কী করে? আত্মসম্মানবোধে চরম আঘাত হত নিশ্চয়!
অনিন্দ্য: জাকিরের একটা অন্য ব্যাপার ছিল। এবং আজও আছে। কিন্তু শিল্পী হিসেবে এটা শুনলে কনফিডেন্স তো কমে যাবেই। আমি এমনিতেই নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম সে দিন। তখন মনে পড়েছিল গুরুজির কথা। উনি বলতেন, স্টেজে বসলে মনে করবে তুমি রাজা।
পত্রিকা: মনে যত ভয়ই থাকুক না কেন, ভাবতে হবে যে আপনি বাঘ!
অনিন্দ্য: একদম তাই। গুরুজি বলতেন, ‘তোমার সামনে যদি সামতাপ্রসাদও বসে থাকেন, তুমি ভয় পাবে না। না হলে একদম জিরো হয়ে যাবে!’ যে দর্শক অন্য কাউকে চাইছে, সেখানে বাজানো খুব টাফ ঠিকই। সামনে সঙ্গীতরসিক শ্রোতা থাকলে তো কথাই নেই। একটা ত্রুটিও ওঁদের নজর এড়াবে না। এঁদের মন জয় করার একটাই উপায়। তা হল, ভাল বাজানোর জেদ, দর্শককে বাজনা দিয়ে জয় করার মনের অদম্য ইচ্ছে আর রেওয়াজ। মনে করতে হবে, এটাই আমার সেরা কনসার্ট হবে। মাঝে মধ্যে সুযোগ না পেলে মন খারাপ হত। নিজেকে বোঝাতাম যে সিনিয়রদের তো ডাকা হবেই। ভাল বাজাতে পারলে আমারও সময় আসবে। মন খারাপের ওষুধ আমার কাছে একটাই। তা হল যন্ত্র। এত বছর স্ট্রাগল, রেওয়াজ করে করে তাই বোধ হয় আমি এখন এমন একটা জায়গা করেছি যেখানে শ্রোতারা বলবেন, আমাদের জাকিরকেও চাই, অনিন্দ্যকেও চাই। সে দিন কলকাতায় এসে একটা কনসার্টে জাকিরভাই নিজে মুখে বলল, ওকে যেন উস্তাদ না বলা হয়, কারণ ওর থেকেও বড় তবলা-প্লেয়ার দর্শকাসনে রয়েছেন। বলেই আমার নাম করল!
পত্রিকা: আপনার থেকে একটু সিনিয়র পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী বিদেশে পাকাপাকি ভাবে থাকেন। শীতকালে কয়েক মাস দেশে এসে কনসার্ট করেন। কখনও মনে হয়নি ওঁর মতো বিদেশে সেট্ল করার কথা?
অনিন্দ্য: অনেক বার অফার এসেছে। ১৯৭৭-এ নিখিলকাকা (পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাকে বলেছিল যে আলি আকবর কলেজ অব মিউজিক-এ একজন ভাল তবলা-প্লেয়ার দরকার। সে সময় আমি সদ্য গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে সেট্ল করেছি, বাড়িতে কথা বললাম। সব্বাই বলল বিদেশে গিয়ে কিছু মাস কনসার্ট করা ভাল। কিন্তু আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে সেট্ল করা ঠিক হবে না।
পত্রিকা: উত্তর ২৪ পরগনার কাশিমপুর গ্রাম থেকে কলকাতা হয়ে সোজা আমেরিকা— চলে যাওয়ার প্রলোভনটা কম ছিল না। না যেতে পেরে ঝগড়া করেননি?
অনিন্দ্য: হ্যাঁ, করেছিলাম তো। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল ওখানে গেলে জেদটা থাকবে না। ওখানে গিয়ে মেমসাহেবকে বিয়ে করব। দুশ্চরিত্র হয়ে যাব!
পত্রিকা: এখন আক্ষেপ হয়?
অনিন্দ্য: না। না গিয়ে ভালই করেছি। হয়তো গেলে একটা মেমসাহেবের পাল্লায় পড়ে গলেও যেতে পারতাম (হাসি)। রসিকতা না করেও বলছি, আজ মনে হয় ওটা করলে ভারতে আমার অ্যাপিয়ারেন্সটা অনেক কম হয়ে যেত। এক বছরের জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে থেকেছিলাম। তখন কথা হয়েছিল থাকাটা এক্সটেন্ড করার। সে সময় পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা বলেছিলেন, ‘অনিন্দ্য, ওখানে পাকাপাকি ভাবে থেকো না। যে রকম যাতায়াত করছ, তাই করো। কারণ ওখানে থেকে গেলে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে দেশের শ্রোতারা ভুলে যেতে পারে।’ পাঁচ বছর হল, নিউ ইয়র্কে আমার স্কুল রয়েছে। বছরে চার মাসের জন্য ওখানে যাই, তারপর ফিরে আসি। এখন মনে হয় যে ভাবে আছি, সেটাই বেস্ট থাকা।
পত্রিকা: আপনার মিউজিশিয়ানশিপ-এর তুলনা মেলা ভার। কিন্তু অনেকেই বলেন যে আপনার যা নেই তা হল শোম্যানশিপ...
অনিন্দ্য: এটা নিয়ে শিবজি আর রবিশঙ্করজিও বলতেন। রবিশঙ্করজি বলতেন, তোমার যদি একটু এক্সপ্রেশনটা থাকত তা হলে যা বাজনাটা বেরচ্ছে তোমার হাত দিয়ে তার ইমপ্যাক্টটা দশ গুণ বেশি হতে পারত। এখন আমি শ্রোতাদের সঙ্গে বেশি আদানপ্রদান করি।
পত্রিকা: শোম্যান হওয়ার জন্য কাউকে ফলো করেছেন?
অনিন্দ্য: ইচ্ছে করলে আমি কাঁধ আর মাথা ঝাঁকিয়ে বাজাতে পারি। কিন্তু করি না। রবিশঙ্করজি বলতেন, তিন ঘণ্টা কনসার্ট করলেও আমার কাঁধ থেকে শালটা পড়ে যায় না। শুধু রিস্টটা নড়ে। শোম্যানশিপের জন্য কাউকে ফলো করি না। নিজেই ভেবে ঠিক করি কী করতে হবে। যেমন ‘গধিগেনে’ যখন বাজাচ্ছি, তখন যদি তার সঙ্গে মিলিয়ে মুখের এক্সপ্রেশন দিই, তা হলে সেটার আরও বেশি ইমপ্যাক্ট হবে। হাততালি পড়বেই।
পত্রিকা: এত বছর সঙ্গীতচর্চা করলেন। কোনও ক্ষোভ জমেছে কি?
অনিন্দ্য: শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পীদের কদরটা, সরকার, উদ্যোক্তা এবং মিডিয়া কম দেয়। সারা পৃথিবী থেকে আমি পুরস্কার পেয়েছি। সব লেজেন্ডদের সঙ্গে আমি বাজিয়ে চলেছি। কিন্তু এত বছরে কেউ পদ্মশ্রীর জন্য আমাকে ভাবেনি। এমনটা নয়, যে পদ্মশ্রী পেলেই আমি আরও ভাল বাজাব। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে আমার থেকে ইনফিরিয়র কোয়ালিটির যারা বাজাচ্ছে বা আমার থেকে অনেক ছোট যারা, তারা আজকে এই সব অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাচ্ছে, যা আমি পেলাম না। সারা পৃথিবী আমাকে চিনল, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে কোনও স্বীকৃতি পেলাম না। আজ নয়, কোনও দিনই কোনও সরকারই তো আমাকে স্বীকৃতি দিল না। একটা সরকারি পুরস্কার পেয়েছি। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডটা আমাকে সঠিক সময় দেওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল ২০০২-এ। কিন্তু পদ্ম-অ্যাওয়ার্ডের যোগ্যতা আমি আজও অর্জন করতে পারলাম না।
পত্রিকা: কেন?
অনিন্দ্য: আমি হয়তো প্রয়োজনীয় লোকের সঙ্গে ঘোরাফেরা করিনি।
পত্রিকা: এ সবের জন্য ঘোরাফেরা করতে হয়? শুধু বাজনা দিয়ে হয় না?
অনিন্দ্য: না, হয় না। তাই তো দেখছি। এটার জন্য দহরম-মহরম করতে হয়। বলতে হয়, ‘ওহে আমায় চেনো।’ আমি সেটা করিনি। হাউস অব কমনস্, কার্নেগি হল, রয়েল অ্যালবার্ট হল— কোথায় বাজাইনি আমি? আর পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, উস্তাদ আমজাদ আলি খান, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা-র সঙ্গে তো আজ তিরিশ বছর অগুনতি কনসার্ট বাজিয়েছি। ভেবেছি আমার বাজনা দিয়ে লোকে আমায় চিনবে। কিন্তু দেখলাম বাজনা দিয়ে আমার বাংলা আমাকে আজও চিনল না। সঙ্গীতরসিকদের কাছ থেকে আমি সব সময় ভালবাসা পেয়েছি। স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছি। সেটা পদ্মভূষণ-এর থেকেও কম নয়। কিন্তু মনে দুঃখ তো হয়, সেটা আজ অস্বীকার করব না। আমারই হয়তো ত্রুটি রয়ে গেছে।
পত্রিকা: আপনার বিরুদ্ধে কি কোনও লবি কাজ করে?
অনিন্দ্য: হতে পারে। মনে হয় আমার কথাটা পৌঁছচ্ছে না। কোনও দিন দেখব আমার ছেলেও হয়তো স্বীকৃতি পেয়ে গেল, কিন্তু আমি পেলাম না। যারা পেয়েছে তাদের সঙ্গে আমি কমপিট করছি না। অল্পবয়েসিরা ভাল কাজ করলে সেটা আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করি। এতে আমার আনন্দ হয়। কিন্তু ভাবি যে কোয়ালিটির কদর কি শুধু শ্রোতারাই করবেন? স্টেজে যখন বাজাই তখন আমি রাজা। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ বছরের কাজকে উপেক্ষা করলে খারাপ লাগবেই।
পত্রিকা: কাদের পুরস্কার পেতে দেখলে আপনার মনে হয়েছে এরাও পেয়ে গেল আর আমি আড়ালেই থেকে গেলাম?
অনিন্দ্য: নাম করতে চাই না। জাকির ভাই ওর ছাত্রদের বলে ‘ধেরে ধেরে কেটে তাক’ শিখতে গেলে অনিন্দ্যভাইয়ের কাছে যাও, আমার কাছে নয়। ও খুব হাম্বল্ বলেই এই কথাটা এ ভাবে বলে। কিন্তু আজ বলতে অসুবিধে নেই যে বছরের পর বছর এই উপেক্ষা দেখে খারাপ তো লাগেই। শুধু নিজের কথা বলছি তা নয়, আমার কনটেম্পোরারি আরও অনেক যোগ্য শিল্পী আছেন, যাঁরা আমার মতোই উপেক্ষিত। আমি তাঁদের কথাও বলছি। তবে শান্তি এটাতেই যে তবলার ইতিহাসে আমার নাম থেকে যাবে।
পত্রিকা: কলকাতার মানুষ যে ভাবে নৈহাটি বেড়াতে যায়, ঠিক সে ভাবে আপনি নিউ ইয়র্কে যান প্রোগ্রাম করতে। কোনও ফিল্মস্টার এটা করলে সেটা খবর হত, কিন্তু আপনি বা আপনার মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীরা তা করলে তার তো কোনও প্রচার হয় না...
অনিন্দ্য: হয় না তো। তবলাবাদকেরা তো সঙ্গত করে থাকেন। প্রধান শিল্পীদের নিয়ে লেখা হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে লেখা হয়, সঙ্গতটা ‘যথাযথ’। এত খেটে একটা কনসার্টে বাজাই, অন্তত দশ লাইন তো এক্সপেক্ট করতে পারি। কিন্তু তা হয় না। এটা আমাদের কাছে একটা অপমান।
পত্রিকা: প্রোটেস্ট করেন না কেন?
অনিন্দ্য: সব তবলাবাদকের উচিত এটা করা। কিন্তু করে না। কারণ আমাদের মধ্যে ইউনিটি নেই।
পত্রিকা: শুধু মিডিয়া করে না বলছেন। কিন্তু আপনাদের এই বৈষম্য নিয়ে কি অন্য শিল্পীরাও প্রোটেস্ট করেন?
অনিন্দ্য: করে না। শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আজ তবলাবাদকদের জন্য অন্য কোনও মিউজিশিয়ান সে ভাবে ফিল করে না। বা করলেও সেটা বলে না। যদি কোনও তবলাবাদকের ছবি একটু বড় ছাপা হয় বা তবলাবাদক যদি দুটো বেশি হাততালি পায় বা পারিশ্রমিক পায়, বেশিরভাগ সময় কিছু কিছু শিল্পীর মনটা খুব যে খুশি হয়, তা নয়। মেন আর্টিস্টরা আমাদের জন্য অনেক করেছেন। সব্বাই তো এক হন না। যেমন উস্তাদ আমজাদ আলি খান সাব। শুধু সঙ্গীত চর্চা নয়, আমার বড় দাদা হিসেবে এত সাহায্য করেছেন, সদুপদেশ দিয়েছেন, তা ভোলার নয়। তবে সবাই তো উস্তাদজির মতো নয়। কারও-কারও ক্ষেত্রে ইগো প্রবলেম থাকে। ইন্ডিয়ার যে কোনও মিউজিক ফেস্টিভ্যাল-এ আজ দুটো করে তবলা সোলো হয়। এটা নিয়ে কথা উঠলে একটু ঠাট্টা-তামাশা করে থাকেন তাঁরা।
পত্রিকা: তবলাবাদকদের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তা হয়?
অনিন্দ্য: হয় তো। কিষেন মহারাজ এক সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘অনিন্দ্যবেটা শুনো, মেন আর্টিস্ট কোনও দিন তোমার বন্ধু হতে পারবে না। পায়েস থেকে মাছির মতো তুলে ফেলে দেবে!’
পত্রিকা: এই কারণেই কি অনেক তবলাপ্লেয়ার নিজেদের ব্যান্ড তৈরি করছেন?
অনিন্দ্য: হয় তো তাই। আর্থিক দিক থেকেও তো একটা বৈষম্য থেকে যায়। তুমি আমার সঙ্গে বাজিয়ে ধন্য হয়েছ গোছের একটা হাবভাব। তিরিশ বছর আগে মেন আর্টিস্টের পাঁচ পার্সেন্ট রেমিউনারেশন দেওয়া হত তবলাবাদককে। এখন আমি ডিপেন্ডেন্ট নই কারও ওপর...
পত্রিকা: আজ তো অনেকেই ভ্রু কুঁচকে আপনাকে নিয়ে বলেন যে তবলাবাদক হয়ে পাঁচ হাজার স্কোয়্যার ফুটের মার্বেলে মোড়ানো বাড়ি করলেন কী করে!
অনিন্দ্য: হ্যাঁ, করে তো! হাবভাবটা এমন যে আমি বাজিয়ে পাঁচ টাকা পাই!
পত্রিকা: আপনার পুত্র অনুব্রত, আজকাল নিয়মিত উস্তাদ আমজাদ আলি খানের সঙ্গে বাজাচ্ছেন। কিন্তু আপনার ছেলে হওয়ার দরুন অনেক ক্ষেত্রেই তো উনি বহু শিল্পীর সান্নিধ্য সহজেই পেয়ে এসেছেন, যা সাধারণ বাড়ির ছেলেরা আশা করতে পারে না। নবীনদেরকে কি আপনি তবলা বাজানোকে পেশা হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেবেন?
অনিন্দ্য: অনুব্রত নিজের চেষ্টাতেই সব করেছে। তবে নবীনদের আমি বলব, তবলা বাজাও, কিন্তু তার সঙ্গে নিজের একটা কিছু করো। ব্যান্ড করো। বা ইন্সটিটিউট করো। প্যাকেজিং শেখো। তবে এটা ঠিক, পৃথিবীতে তবলা বাজানোর মান অনেক বেড়েছে। তার জন্য আল্লারাখা খান সাব, কিষেন মহারাজ, সামতা প্রসাদ আর জাকির ভাই অনেক করেছে।
পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন, এত দিন দেশবিদেশে চুটিয়ে প্রোগ্রাম করেছেন। আপনার হিন্দিটা কি একটুও শুধরেছেন?
অনিন্দ্য: (হাসি) ওটা নিয়ে কম রসিকতা হয় না। একবার আল্লা রাখা খান সাব এসেছিলেন মুম্বইতে আমার একটা কনসার্ট শুনতে। প্রোগ্রামের আগে অনুমতি চেয়ে নিয়ে শুরু করতে হয়। কিন্তু আমার এমন হিন্দি যে আমি বললাম, ‘ইজয়াত দেকে শুরু কর রাহা হুঁ!’ মানে অনুমতি দিয়ে শুরু করছি। উনি শুনে হেসে লুটোপুটি খেয়ে গিয়েছিলেন। আরে, সে দিনও তো জাকিরভাই গ্রিনরুমে বসে হেসে বললেন, ‘আপনার হিন্দিটা একটু শোনাবেন?’ আর এই করেই তো এত দিন চলে গেল। বেশ ভালই তো কাটছে!