ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
পত্রিকা: কলকাতার সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক অনেক দিনের....
বিরজু মহারাজ: হ্যাঁ। অনেক কালের। আমার প্রথম স্টেজ শো কলকাতায়। মন্মথ নাথ ঘোষের বাড়িতে। ১৯৫২ সালে। তখন আমার বয়স চোদ্দ। বাবা মারা গিয়েছেন। জীবনে দাঁড়াবার জন্য প্রচণ্ড লড়াই করছি। সে সময়ই ডাক কলকাতার। কাকা লচ্ছু মহারাজ তখন মুম্বইতে কোরিওগ্রাফির কাজ করছেন। আর এক কাকা শম্ভূ মহারাজ ব্যস্ত ছিলেন লখনউতেই নিজের কাজে। মা এক পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন আমায়।
পত্রিকা: সত্তর দশকের মাঝামাঝি সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’-র কোরিওগ্রাফি করেছিলেন। মনে পড়ে সে সব স্মৃতি...
বিরজু মহারাজ: দাদার (সত্যজিৎ রায়) বাড়িতেও যেতাম তখন। ওঁর স্ত্রী বিজয়া রায়, ছেলে সন্দীপের সঙ্গে আমার খুবই আলাপ জমত। আর মনে আছে, দাদার সঙ্গে শু্যটিং করা মানেই প্রচুর মিষ্টি দই খাওয়া। ছবিতে দুটো গানের কোরিওগ্রাফি করেছিলাম। তার মধ্যে একটা ছিল ‘কানহা মে তোসে হারি’। গানটার সঙ্গে ছিল আমজাদ খানের অভিনয়।
পত্রিকা: উনিই তো ছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহের রোলে...
বিরজু মহারাজ: হ্যাঁ। লখনউয়ের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেটে। কী যে অসাধারণ! আমি লখনউয়ের মানুষ হয়েও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওই সেট দেখে। দাদা বলেছিলেন এমন একটা নাচের কোরিওগ্রাফি করতে, যাতে নবাব সাবের চেহারায় একটা খুশির ভাব ঝরে পরে। অভিনেতা আমজাদ আলি খান ভাই বলেছিলেন, “আপনি আমাকে এত সুন্দর গান দিলেন। কী করি এমন গান নিয়ে। আমাকে বরং একটা পিস্তল দিন, ভাল ডায়লগ বলব!” দিল্লির ছাত্রীরা এসেছিল ওই গানের সঙ্গে নাচবে বলে। আসলে সত্যজিৎ রায় তো জানতেন হম কিস খানদানকে হ্যায়। সেই রকমই সম্মান করতেন।
পত্রিকা: লখনউয়ের মানুষ আপনি। কখনও বেগম আখতারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?
বিরজু মহারাজ: কখনও মানে? আমি ওঁকে চাচি ডাকতাম। ওঁর বটুয়া থেকে সুপুরি-তামাক কত খেয়েছি! বাপ রে বাপ, কী পান খেতেন! জমকে একদম। একবার করাচি গিয়ে আমরা একটা অনুষ্ঠানও করেছিলাম। ওই রকম ঠুমরি-গজলের গলা খুব কম শিল্পীর কাছে পেয়েছি। চাচি আবার আমার কাকা শম্ভু মহারাজের খুব তারিফ করতেন। উনি বলতেন শম্ভুজির মতো ঠুমরি কেউ গাইতে পারে না। ফৈজাবাদের মেয়ে ছিলেন চাচি, কিন্তু লখনউ চলে আসেন গানবাজনার চর্চার জন্যই। লখনউয়ের মতো গানবাজনার পরিবেশ তো কোথাও ছিল না। আমার গান শুনে উনি খুব খুশি হতেন। রাশিয়াতেও গিয়েছিলাম আমরা অনুষ্ঠান করতে। ওঁর ‘হামারিয়া আটারিয়া পে আও সাবরিয়া’ এখনও কানে বাজে...
পত্রিকা: আপনারা তো নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। কিন্তু লখনউয়ের নবাবি পরিবেশে বড় হয়েছেন। বিরিয়ানি খেয়েছেন কখনও? কিংবা কাবাব?
বিরজু মহারাজ: আমার কাকা আমাকে জোরজার করে খাওযাতেন বিরিয়ানি। বা মাংসটাংসও। বলতেন, “খাওগে নহি তো নাচোগে ক্যায়সে?” আমার কাকি রান্না করতেন। কিন্তু আমার মা বা ঠাকুমা কখনও খাননি, রাঁধেনওনি। আমিও পরে আর খাইনি। কিন্তু খেলেও কোনও অপরাধবোধ যে আছে, তা কিন্তু নয়। পারিবারিক সম্মতি ছিল, হাজার হোক আমরা লখনউয়ের খানদানের লোক তো! (হাসি)
পত্রিকা: শুনেছি, বাবা অচ্ছন মহারাজ গত হওয়ার পর আপনার মা আপনাকে নাচ শিখিয়েছিলেন। এটা কী করে হল? ওই পরদানশিন যুগে তো মেয়েরা নাচ-গান শিখতেন না?
বিরজু মহারাজ: পরদানশিন যুগ বলছেন? তবে শুনুন, আমার আম্মা ঠাকুমার কাছে গান শিখেছিলেন। ঠাকুর্দা বিন্দাদিন মহারাজ, ঠাকুমাকে কিছু কিছু ঠুমরি শোনাতেন। সেইগুলো গুনগুন করে শিখে নিতেন মা। এখনও মনে পড়ে মায়ের গান, ‘ডগর চলত দেখো শ্যাম’।
পত্রিকা: আচ্ছা!
বিরজু মহারাজ: অথচ, একটা কথা বলি, অবাক হবেন শুনলে। জানেন, যে মা আমাকে এত ছায়া দিয়ে বড় করে নৃত্যশিল্পী তৈরি করলেন তিনি জন্মের প্রথম মুহূর্তে আমাকে চাননি?
পত্রিকা: মানে!
বিরজু মহারাজ: বারবার সন্তান হতে হতে ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে গিয়ে তিনি যখন আমাকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা, ভেবেছিলেন আমাকে পৃথিবীতে আনবেন না। তার পর আমি যখন দেশ বিদেশে নাম করলাম তখন মা আশসোস করে বলতেন, “এ সন্তানকে আমি রাখতে চাইনি। কী যে মতিভ্রম হয়েছিল আমার!”
পত্রিকা: মায়ের প্রেরণাতেই আপনার কলকাতায় আসা। প্রথম স্টেজ শো। তার পর...
বিরজু মহারাজ: আড়াই ঘণ্টা নেচেছিলাম কলকাতার সেই আসরে। অভিমন্যুর মতো অবস্থা তখন। চারদিকে রসিকজনের মাঝখানে নেচে চলেছি। গিজগিজ করছে দর্শক। পরদিন কাগজে কাগজে এত প্রশংসা বেরিয়েছিল যে আজও মনে পড়লে অভিভূত হয়ে যাই। প্রথম স্টেজ পারফর্ম্যান্সেই এতটা পেয়েছিলাম। আসরের বাইরেও মাইক লাগানো হয়েছিল। লোকে রাস্তায় খবরের কাগজ পেতে বসেছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, “বিরজুর নাচ না দেখতে পাই ক্ষতি নেই। ওর ঘুঙ্ুরের আওয়াজ শুনব।”
পত্রিকা: সেই আসরে আর কারা ছিলেন?
বিরজু মহারাজ: আরি বাব্বা! সব মেহসুর কলাকার। বিলায়েৎ খান, রবিশঙ্কর, আমির খান, ভীমসেন যোশী ... সবাই। রবিশঙ্করজি আমার নাচ দেখে বলেছিলেন, “তুম তো লয় কা পুতুল হো।” আসল কথা সাত পুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের কত্থক নাচের চর্চা। কাকাদের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে রবিশঙ্করজির পুরনো বন্ধুত্ব ছিল। রবিশঙ্করজি নিজেও তো উদয়শঙ্করজির গ্রুপে নাচ দিয়েই কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। দিল্লিতে যখন রবিশঙ্করজি এলেন তখন আমিও দিল্লিতে। নাচ শেখাই। বিকেলের দিকে ওঁর বাড়িতে চলে যেতাম। আম্মা বলতেন, ‘‘গুণী লোকজনের সঙ্গে বসলে তোমার নাচ-গানের উন্নতি হবে। ভাল সমঝদারের সঙ্গে থেকো।” আমি তবলা বাজাতাম, রবিশঙ্করজি সেতার বাজাতেন। বলতেন, “কী ভাল তবলার হাত তোমার!”
পত্রিকা: নাচ শিখতে শিখতে তবলা?
বিরজু মহারাজ: কেন নয়? লয়, ছন্দ আমার শরীরে আর মগজে এমনিতেই আছে। আমাদের পুরো বংশেই আছে। কাকা শম্ভু মহারাজ খুব ভাল তবলা বাজাতেন। সেই সময় শামতাপ্রসাদ, কিষেণ মহারাজের তবলা আমি শুনেছি। আমাদের বংশেরই কেউ একজন বেনারস গিয়ে নিজের মতো করে তবলা শিখেছিলেন। তার পর সেটা পুরো পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে।
গানবাজনা না জানলে নাচ হয় না। বাবা-কাকারাও ভাল তবলা বাজাতেন, ঠুমরি গাইতেন। সেই ধারাই আমি পেয়েছি। তবলা, পাখোয়াজ, ঢোলক, ওড়িশি পাখোয়াজ, শ্রীলঙ্কার ড্রাম, বঙ্গো, কঙ্গো সবই বাজাতে পারি। সেতার, সরোদ, বেহালাও পারি। সবটাই নিজের ইচ্ছায় দেখে দেখে, শুনে শুনে শিখেছি।
পত্রিকা: আর আপনার ছবি আঁকা? সেটাও কি পারিবারিক ঘরানায় ছিল?
বিরজু মহারাজ: না, না, না। সেটা ছিল না। তবে এখন আমার মেয়ে জামাই দু’জনেই শিল্পী। একদিন মেয়ে অনিতা বাড়িতে খেতে ডেকেছিল। সামনে একটা সাদা ক্যানভাস। বলল, “বাবা তুমি কিছু একটা আঁকো।” আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আমি আবার কী আঁকব?
তবু তুলি-রং নিয়ে যখন শুরু করলাম। মেয়ে বলল, “বাবা এ তো দারুণ হচ্ছে! এই ধরনের রং চাপানো, ব্রাশের স্ট্রোক তো আমরা সেকেন্ড ইয়ার-থার্ড ইয়ারে শিখেছিলাম।”
তার পর থেকে ছবি আঁকায় লেগে গেলাম। বিশেষ করে নাচের ভঙ্গিমা নিয়ে, প্রকৃতি নিয়েই ছবি আঁকি। তবে একটা কথা, ছেলেবেলায় কয়লা দিয়ে দেওয়ালে ঠাকুর দেবতার ছবি যখন আঁকতাম, তখন আম্মা বলতেন, “ঘর নোংরা কোরো না।”
পত্রিকা: সম্প্রতি কলকাতায় ‘পদাতিক’ গোষ্ঠীর হয়ে কত্থক নাচের ওয়ার্কশপ করলেন। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, যে সব ছেলেমেয়ে ওয়ার্কশপে এল, তারা তো কেউ চলে যাবে রিয়েলিটি শোয়ে, কেউ বা ফিউশন ডান্সে। এটা ভাবলে মন খারাপ হয় না?
বিরজু মহারাজ: দেখুন, পাঁচশো বাচ্চার মধ্যে তিন জনও যদি খাঁটি কত্থক নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেয় তা হলেও এই প্রচেষ্টা সার্থক। আর শুনুন, এখনও আমার অনুষ্ঠান হলে একই রকম ভিড় হয়, সেটা ওই খাঁটি কত্থক দেখার জন্যই। এই তো কয়েক দিন আগে জাপানে অনুষ্ঠান করে এলাম। কত্থকের কী জনপ্রিয়তা সেখানে! মুম্বইয়ে কয়েক দিন আগে অনুপ জলোটার ভজন আর আমার নাচ নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করলাম। দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ ...
‘পারফেকশনিস্ট’ মাধুরীর সঙ্গে
পত্রিকা: শুনেছি, যারা ফিউশন ডান্সে চলে যায়, এমন ছাত্রছাত্রীদের নাকি আপনি শিষ্য হিসেবে স্বীকার করতে চান না?
বিরজু মহারাজ: বিদেশি মিউজিক, বিদেশি ডান্সে, ফিল্মে দেহ প্রদর্শন করা ছাড়া তো কিছুই থাকে না। কী ভাবে ওদের শিষ্য হিসেবে স্বীকার করব বলুন? আবার দেখুন মীনা কুমারী, মধুবালা, ওয়াহিদা রহমানের সময় নাচ ছিল ঝঙ্কার আর মাধুর্যে ভরা। সেই নজির যদি দেখি আমার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে, নিশ্চয়ই তাদের শিষ্যের স্বীকৃতি দেব। এখন তো ফিল্মি নাচ মানে পঁচিশ বার ড্রেস আর লোকেশন বদল। তা হলে নাচের নিজস্বতা আর কী থাকল? আর গানের কথাও খুব খারাপ। অনেকটা এই কারণে আমি রিয়েলিটি শো-ও দেখি না।
পত্রিকা: তাই? এ দিকে আপনি তো ‘ঝলক দিখলা যা’-য়ে এসেছিলেন!
বিরজু মহারাজ: এসেছিলাম। মাধুরী দীক্ষিত ক্ল্যাসিকাল ডান্স করেছিল বলেই আমায় ডেকেছিল। মাধুরী আমাকে গুরু বলে মানে। ও আমার গ্রুপের সঙ্গেই তো নেচেছিল।
পত্রিকা: মাধুরী একটা অনলাইন নাচের ক্লাস খুলেছেন। সেখানে আপনার কি কোনও যোগাযোগ আছে?
বিরজু মহারাজ: আমি কয়েকটা লেসন তৈরি করে দিয়েছি ওর অনলাইন সিলেবাসে। শিক্ষার্থীরা সেগুলো পছন্দ করেছে। ব্যস্।
পত্রিকা: মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কী ভাবে?
বিরজু মহারাজ: আমি তখন আমেরিকায় এক ছাত্রীর বাড়িতে ওয়ার্কশপ করছি। সেই ছাত্রী বলল, মাধুরী ওর বাড়িতে নাচের ওয়ার্কশপে যোগ দিতে চায়। তখন ওর প্রবল জনপ্রিয়তা। ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ নেচে ফেলেছে। ফলে বুঝতেই পারছেন। মাধুরী আসতে চায় শুনে আমাদের যে ছেলেটি তবলায় সঙ্গত করে, সে বলল, “ও বাবা! আমি তো তা হলে বাজাতেই পারব না। ওকে দেখলে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাব।’’
পত্রিকা: তারপর?
বিরজু মহারাজ: আমি বুঝলাম এই রকম সুপারস্টারকে ওয়ার্কশপে আনলে তালিমের পরিবেশ নষ্ট হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাধুরী এল। দাঁড়িয়েছিল অতি সাধারণ পোশাকে দু বেণী করে ছাত্রছাত্রীদের একেবারে শেষ সারিতে। এত সাধারণ ভাবে এসেছিল যে বুঝতেই পারা যাচ্ছিল না, ও মাধুরী। এত বিনয়ী! এত নম্র! ওর মধ্যে স্টারসুলভ কোনও অহম্ দেখিনি। লাঞ্চের সময় যখন বললাম, তুমি সামনের সারিতে এসে দাঁড়াও, ও বাধো-বাধো ভাবে বলল, “না না না, তা হয় না।”
পত্রিকা: একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে মাধুরীকে কেমন লাগে?
বিরজু মহারাজ: প্রচণ্ড পারফেকশনিস্ট। মনে আছে, ‘দেবদাস’-য়ের শু্যটিংয়ের সময় প্রতি নাচের দৃশ্য মনিটরে এসে দেখত। আমি বরং বলতাম ঠিকই হয়েছে। ও বলত, “একদম না। খুব বিশ্রী হয়েছে। আপনি কী সুন্দর করে দেখালেন, তার সামান্যটুকুও আমি করতে পারলাম না।” এই ভাবে রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত ও শট দিত। মাঝে মাঝে বাড়িতে রান্না করে খাওয়াত। মেয়ে হিসেবে মাধুরী খুব ঘরোয়া। কী করে যে এক দিকে ওই স্টারডম, অন্য দিকে সংসারটা নিজে হাতে সামলায়, ভেবে পাই না।
পত্রিকা: কমল হাসনের ‘বিশ্বরূপম’ ছবিতেও তো আপনি কোরিওগ্রাফি করেছিলেন। ওঁর নাচেরও তো অসম্ভব ক্রেজ...।
বিরজু মহারাজ: হ্যাঁ। অবশ্যই।
পত্রিকা: ওঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
বিরজু মহারাজ: অপূর্ব। সেই প্রথম আমি কোনও মেল ডান্সারকে নিয়ে ছবির জন্য কোরিওগ্রাফি করি। ভাবিইনি যে জাতীয় পুরস্কার পাব। কমলের সঙ্গে আমার আলাপ তিরিশ বছরের। দেখা হলে গুরু বলে এসে প্রণাম করত। সারিকাও আসত ওর সঙ্গে। কমল ভরতনাট্যমের ছাত্র। কিন্তু কী অসাধারণ কত্থক কপি করেছিল! ‘বিশ্বরূপম’ করার আগে কত্থকের মুভমেন্ট শিখতে বহুবার দিল্লিতে আমার ইন্সটিটিউটে এসেছে।
আমার যেটা ভেবে অবাক লাগে তা হল, ‘বিশ্বরূপম’-য়ে কিন্তু কোনও সেটসেটিং, মেক আপ ছিল না। সাদা-পাঞ্জাবি আর কুর্তা পরে কমল নেচেছিল একটা ক্লাসরুমের মধ্যে। তারই কোরিওগ্রাফি করে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ভাবা যায়!
পত্রিকা: আর কোনও ছবিতে কোরিওগ্রাফি করছেন নাকি?
বিরজু মহারাজ: কথা হয়েছিল এক বার। সঞ্জয় লীলা বনশালী যদি ‘বাজিরাও মাস্তানি’ করে তা হলে করব।
পত্রিকা: যে ভাবে ফিউশনের জমানা শুরু হয়েছে, আপনার মূল শেকড়ের সেই কালকা-বিন্দাদিন ঘরানা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব?
বিরজু মহারাজ: হ্যাঁ। সম্ভব। ছাত্রছাত্রীরা বাঁচিয়ে রাখবে। আমার ছেলে (দীপক মহারাজ) বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। আমাদের ঘরানার কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। পূর্বপুরুষেরা সবাই কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। নাচের তো দুটো দিক। অভিনয় আর লয়। আমাদের ঘরানায় লয়টা সাঙ্ঘাতিক সুন্দর। অর্থাৎ পায়ের কাজে ফাস্টনেস। উত্তরপ্রদেশের নবাব, রাজা, মহারাজা বেগম, রানি সেকালের সবাই মুগ্ধ ছিল কালকা- বিন্দাদিন নাচের ঘরানায়। আমরাও তো এক ধরনের ছোটে নবাব ছিলাম। আমাদের তখন প্রচুর অর্থ। বাড়িতে চারটে ঘোড়া। ঘরেই এত পয়সা ছিল যে তা পাহারা দেওয়ার জন্য ছিল আটজন সিপাই। তার মধ্যেও বাবা বলতেন নাচের ভিতর ভক্তি থাকতে হবে। দাদা বিন্দাদিনের পাঁচ হাজার ঠুমরি ছিল। সবই ভক্তিরসে ভরা।
পত্রিকা: রাধাকৃষ্ণের নাচের কম্পোজিশনই তো কত্থকের মূল ফর্ম। কিন্তু যখন নবাবেরা এ নাচ দেখতেন তাঁরা কি রাধাকৃষ্ণের ভক্তিভাব বা শৃঙ্গার ভাবের নাচের তারিফ করতেন?
বিরজু মহারাজ: নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ পছন্দ করতেন রাধাকৃষ্ণের খুনসুটি ছেড়ছাড়। ভক্তিভাবের নাচ ততটা পছন্দ ছিল না ওঁর, আমি যা শুনেছি। কান্থা-রাধার ঠুমরি খুব পছন্দ করতেন। তিনশ পঁয়ষট্টি জন বেগম ছিল। তাঁদেরকে গোপিনী ভাবে সঙ্গে নিয়ে নবাব কত্থক নাচতেন। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের এক এক দিন একেক জন বেগমের সঙ্গে কাটাতেন। তবে এই দাসী বেগমরাই ছিলেন নাচের সহচরী। সেই সময় নাচে খুব স্পিড থাকত। দাদরা, ঠুমরি খুব চলত। তবে ভজন নয়, ভজনের সঙ্গে কত্থক চলত মন্দিরেই।
পত্রিকা: আজকের লখনউতে কত্থক কতটা জনপ্রিয়? শো হয়, কলকাতায় করেন না কেন?
বিরজু মহারাজ: এখন খুব একটা জনপ্রিয় নয়। তবে ভাতখণ্ডেজি-র একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে রেওয়াজ হয়। দিল্লিতে কত্থক চর্চার প্রবণতা এখন বেশি। আমার কত্থক কেন্দ্রে প্রচুর ছাত্রছাত্রী। আমার ছোট ছেলে, বড় ছেলে শেখায়। আগে ঠুমরির সঙ্গে নাচে লয়ের একটা জোরদার ব্যাপার ছিলই। কিন্তু এখন কত্থকে অঙ্গ সঞ্চালনে আরও অনেক বেশি সূক্ষ্মতা এসেছে। এখনকার বন্দিশও খুব ভাল।
পত্রিকা: দিল্লি মুম্বইতে কত্থক নিয়ে অনেক শো হয়, কলকাতায় করেন না কেন?
বিরজু মহারাজ: কেউ না ডাকলে আসব কী করে? কলকাতায় একবার কেলুচরণ মহাপাত্রের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠান করেছিলাম। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে হয়েছিল। লাইটিং থেকে সেট, সবই করেছিলাম। আমরা ছোটবেলায় মশাল জ্বালিয়ে নাচতাম। তিন বছর বয়স থেকে নবাবের দরবারে নাচছি। মাঝরাতে ঘুমচোখে মশালের আলোয় নাচতে হত। চোখে কাজল পরতে হত। আজকাল সেই নাচ কোথায় এসে থেমেছে বলিউডের কল্যাণে? বিয়ে-শাদিতে গিয়েও নাচতে হচ্ছে। লোক খেতে খেতে নাচ দেখছে।
পত্রিকা: আপনার কাকা লচ্ছু মহারাজ কিন্তু মুম্বইতে গিয়ে কোরিওগ্রাফির কাজ করেছিলেন। আপনি পাকাপাকি ভাবে মুম্বই গেলেন না কেন?
বিরজু মহারাজ: আমার ধমর্র্ মঞ্চে পারফর্ম করা। যখন মনে হয় যে বলিউডের কোনও শিল্পীর মধ্যে সেই নিষ্ঠা, সমর্পণ আছে, নাচের ছন্দ, লয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আছে তখন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। যেমন মাধুরী দীক্ষিত।
পত্রিকা: উদয়শঙ্কর ব্যালে গ্রুপ ভারতীয় নৃত্যকে একটা আন্তর্জাতিক চেহারা দিয়েছিলেন। আপনি যখন কত্থককে বিদেশে নিয়ে গেলেন তখন কত্থক কতটা...
বিরজু মহারাজ: প্রশ্নটা বুঝেছি, শুনুন, আমি কখনই কত্থককে ওদেশের মতো করে প্রেজেন্ট করিনি। কত্থকের শৈলীর শিকড় থেকে দূরে সরে গেলে তার ভাবটাই নষ্ট হয়ে যাবে যে। একটা কথা বুঝুন, কত্থকে কী আছে? আছে নন্দ-যশোদার বাৎসল্য রস। দেশে দেশে মা-ছেলের এই খুনসুটি একই রকম। কোথাও বাচ্চারা মাখন খেতে চায়, কোথাও বা চকোলেট। কোথাও তারা মায়ের আঁচল টেনে ধরে, কোথাও বা স্কার্টের বা গাউনের কাপড়। কিন্তু আবদারটা একই রকম থাকে। এর কোনও বদল নেই। সেটাই বোঝাতে চেয়েছি বিদেশিদের। ‘লয় পরিক্রমা’ বলে আমি একটা ব্যালে করেছিলাম যেখানে গাছের পাতার কাঁপন, চন্দ্র-সূর্যের ওঠার ছন্দ, বাতাসের হিল্লোল, এমনকী চাষির ধানকাটা, হোটেল বয়ের সব্জি কাটা, মোটর চালকের গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা, সবেতেই আমি নাচের ছন্দ খুঁজেছিলাম। সারা পৃথিবীর সব কিছুতেই ছন্দ আছে। জীবন- মৃত্যুও একটা ছন্দ।
পত্রিকা: জীবনে অনেক সম্মান, স্বীকৃতি পেয়েছেন। এমন কোনও না-পাওয়া আছে যার জন্য মন কেমন করে? কোনও অপূর্ণ প্রেম...
বিরজু মহারাজ: আমার জীবনে অনেক মহিলাই এসেছেন যাঁরা আমার নৃত্যকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। প্রেম জিনিসটা তো নিজের মধ্যেই থাকে। সে আমি রাধা হই, কী কৃষ্ণ। দুটো ভাবকেই নিজের মধ্যে ধারণ করতে হয়। তবেই না কত্থক।
পত্রিকা: অতৃপ্তি বলে কিছু...
বিরজু মহারাজ: সেটা যদি বলেন, তবে বলব ‘কলাশ্রম’ বলে আমার যে নৃত্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটা দিল্লিতে করেছি সেটাকে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলা বাকি। আমি এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন ভাবে শিক্ষাধারা তৈরি করে যেতে চাই যাতে ছাত্রছাত্রীরা জানবে ভারতীয় না হলে কত্থক শিখে লাভ নেই। আগে ভারতীয়ত্ব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, তার পর নাচ। যে সম্মান পেয়েছি তা আসলে আমি নয়, পেয়েছে আমার কলা। আমি তো শিল্পের মজদুর মাত্র...