হাঁ হাঁ বেচি হামি হামার মাংস। হামার মাংস বেচ্যে হামি রসিকের ছেল্যেপুল্যাদের মানুষ করি...’ (সরস্বতী)।
‘আমি শিল্পী, আমি অভিনয় করতে ভালবাসি, কিন্তু তার জন্য আমার গায়ের মাংস আমি বিক্রি করি না।’ (সুন্দর)
দুটি সংলাপ মাত্র। সংঘাতও। এ যেন নাটকের মধ্যে নাটক, তারও মধ্যে নাটক। নাট্যকার অনিকেত রায় বিদ্যাসুন্দর কাব্যের মতো একটি পালা মঞ্চস্থ করতে চান। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। নাটকের চরিত্রও নির্বাচন করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু মহড়া কক্ষেই বাধে যত গণ্ডগোল। সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল শেখর সমাদ্দার-এর নির্দেশনায় আভাস প্রযোজিত ‘সুন্দরবিবির পালা’।
যে দৃশ্য দর্শকের মনে ঝড় তোলে তা হল, সরস্বতী এবং সুন্দরের কথোপকথন। যেখানে দুই অভিনেতার তথা মানুষের জাত্যভিমান ছাপিয়ে ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে দুই প্রান্তবাসী মানুষের অন্তরের জ্বালা। অস্তিত্বের সংকট, ভুখা পেটে দুটো অন্ন তুলে দেওয়ার লড়াই। সুন্দরলালের চরিত্রে চপল ভাদুড়ি মানানসই। কিন্তু নাটকে অন্য মাত্রা পায় সরস্বতী’র চরিত্রে মহাশ্বেতা চক্রবর্তীর অভিনয়। তার মধ্যে ফুটে ওঠে অসহায় নারীদের মর্মবেদনা। তার নারী সত্তায় আঘাত হানায় প্রতিঘাতে বেরিয়ে আসে যন্ত্রণার পাহাড়-প্রমাণ বোঝা। তবে একটি দৃশ্যে চপল ভাদুড়ির অভিনয়ও মন ভরিয়ে দেয়। মহুয়ায় গলা ভেজানো, নারী সাজে গানের তালে চপল ভাদুড়ির নাচের এই কল্পদৃশ্য আলাদাভাবে মন ছুঁয়ে যায়। তাঁর নৃত্যে এবং অভিব্যক্তিতে অদ্ভুত মাদকতা ঝরে পড়ে।
নাটকের অপর প্রান্তে আরও একটি বিষয়ও বেশ জোরালো ভাবেই উঠে আসে। নাট্যকার অনিকেত রায়ের ব্যক্তিগত জীবন। তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে স্ত্রী সুনন্দার সঙ্গে। তাদের বর্তমান সম্পর্কের একমাত্র যোগসূত্র ছেলে। অনিকেতের আবিষ্কার লোকশিল্পী সুন্দর হালদার-এর নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে আরও একটি জটিলতা তৈরি হয়। অনিকেতও ক্রমশ হতাশার গর্ভে তলিয়ে যেতে থাকেন। হতাশাগ্রস্ত অনিকেতের চরিত্রে পরিচালক শেখর সমাদ্দার নজর কাড়েন। সুনন্দা চরিত্রে ঋতুপর্ণা বাগচি উল্লেখযোগ্য। রুচিরা’র চরিত্রে ঐন্দ্রিলা ঘোষ এবং কিশোরলালের চরিত্রে সুপ্রিয় হরি’র অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে।
একটি বেসরকারি চ্যানেলে নির্দেশক অনিকেত রায়ের জবানবন্দি দিয়ে নাটকের শুরু। এই দৃশ্যে তেমন কোনও চমক চোখে পড়ে না। আর সঞ্চালকের চরিত্রাভিনেতার অভিনয় আরও একটু বাস্তবোচিত হওয়া উচিত ছিল। নাটকের বিষয়, পরিচালকের ব্যক্তিগত জীবন, রুচিরা নামে নাটকের দলের একটি মেয়ের ব্যক্তিগত সমস্যা, সুন্দর হালদারের ছোটবেলা, ব্যক্তিগত জীবন—এত সব বিষয় উঠে আসায় নাটকটি বেশ দীর্ঘ হয়ে যায়। আলোর ব্যবহারেও একটু যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। তবে কী নাচনী, কী সুন্দরলাল বা পরিচালক – চরিত্রগুলোর ক্ষত বিক্ষত হওয়ার যন্ত্রণা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
ব্যক্তি কিংবা শিল্পীর থেকে শিল্পই যে বড় এ কথাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন নাট্যকার শেখর সমাদ্দার।
জোড়াসাঁকো মঞ্চ-গাথা
শতকের সময় সারণিতে মধ্য-উনিশের কলকাতা। প্রিন্স দ্বারকানাথের ঠাকুরবাড়ির পালে লাগল নতুন হাওয়া। বোহেমিয়ান পৌত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে গড়ে উঠল জোড়াসাঁকো থিয়েটার। আত্মীয়স্বজন সঙ্গী করে মঞ্চস্থ করলেন মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’।
গানে-অভিনয়ে ঝমঝমিয়ে উঠল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দির। নতুন নাটকের সন্ধানে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন রীতিমতো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে। সে তখনকার দিনে বিরাট ব্যাপার।
পুরস্কারজয়ী নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘নব নাটক’ মঞ্চস্থও করলেন তাঁরা নিজেদের থিয়েটারে। সে নাট্যে কনসার্টে হারমোনিয়াম বাজানোর পাশাপাশি নটী চরিত্রে অভিনয় করলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বয়ং। গাইলেন গান ‘মলয় নিলয় পরিহারপুরঃসর’। অপূর্ব সে গান। নাটকটি পরিচালনা করেন ব্রাক্ষ্মনেতা কেশবচন্দ্রের অনুজ কৃষ্ণবিহারী সেন।
এরপর প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং দায়িত্ব নেন নাট্যরচনা আর পরিচালনার পাশাপাশি সঙ্গীত নির্মাণেরও। উদ্বুদ্ধ করেন আগামী প্রজন্মকেও। বঙ্কিমচন্দ্রের পাশাপাশি একে একে অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে শুরু করে পরিবারের মেয়েরাও – স্বর্ণকুমারী, সরলা দেবী আর ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী – সংলাপের পাশাপাশি গানে গানেও মাত করলেন দর্শকমন।
ঠাকুরবাড়ির সে ধারায় শেষ প্রতিভূ জ্যোতিরিন্দ্র-ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ নিজের নাট্যরচনার পাশাপাশি নাট্যরূপ দিয়েছেন পরশুরামের কাহিনি ‘লম্বকর্ণপালা’। সে নাট্যের গানে স্বীকার ‘উইথ কমপ্লিমেন্টস্ টু অবিন ঠাকুর প্রিন্টারি’।
জোড়াসাঁকো থিয়েটারের সার্বিক ইতিহাসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অ্যাকাডেমি থিয়েটারের প্রযোজনা ‘জোড়াসাঁকো মঞ্চ-গাথা’।
রচনা, নির্মাণ ও গানে দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। গানে দেবজিতের সঙ্গী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাষ্যে দেবাশিস বসু। প্রথম মঞ্চায়ন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে রবিবার ৬ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ছ-টায়।
পরের শনিবার ১২ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ছ-টায় আবার প্রযোজনাটি উপস্থাপিত হবে জোড়াসাঁকো থিয়েটারে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য, নাটক, সঙ্গীত এবং দৃশ্যকলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে। উৎসবের সূচনাপর্বে রবিবার ৬ই বেলা তিনটেয় পরিবেশিত হবে রবীন্দ্রভারতী থিয়েটার রেপার্টরির ‘ফাগুন রাতের গপপো’।
সাজানো সম্পর্কের পরিণতি
‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ নাটকে। দেখলেন পিনাকী চৌধুরী
সম্প্রতি শিশিরমঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ‘কসবা অশনি’ প্রযোজিত নাটক ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’। নাটকের মুখ্য চরিত্র দামোদর এক বিত্তশালী ব্যক্তি। তিনি পাশের গ্রামের অন্য এক বিত্তশালীকে টেক্কা দেবার উদ্দেশ্যে মানময়ী গার্লস স্কুল খুলে ফেললেন। কিন্তু সেখানে পড়াবে কে? অগত্যা দামোদরবাবু বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন যে, তাঁর স্কুলে একজোড়া শিক্ষক দম্পতি নিয়োগ করবেন। এবং তাঁদের দুজনেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক হতে হবে। বিজ্ঞাপনটি মানসের দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু সে তো অবিবাহিত। তাহলে উপায়? অনেক কষ্টে মানস মিলিকে রাজি করায়। তারা দু’জনে স্বামী-স্ত্রী না হয়েও সেই পরিচয়ে স্কুলে যোগদান করে। প্রথমে দামোদরবাবু এবং তাঁর স্ত্রী মানময়ী বিষয়টি বুঝতে না পারলেও পরে দামোদরবাবুর মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি ব্যাপারটা আঁচ করার পরেই মিলি এবং মানসকে একটি নির্দেশ দেন, আর তারপরেই ঘটতে থাকে বিভিন্ন মজা এবং হাসির কাণ্ডকারখানা! দামোদর চরিত্রে শ্যামল দাস এবং মানময়ীর চরিত্রে নন্দিনী ভাদুড়ি যথাযথ।
ভাল লাগে মানসের ভূমিকায় দেবাশিস সরকার ও মিলির ভূমিকায় মুনমুন রায়কে। নাটক রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, নির্দেশনায় কাশীনাথ চক্রবর্তী। মঞ্চ বিলু দত্ত।