নিসর্গ ও নির্জনতা

একঘেয়ে দাম্পত্যে মিঠে রোমাঞ্চের স্বাদ আনতে চলুন উত্তরাখণ্ডের চক্রাতায়। আবার এখানেই খুঁজে নিন নিজেকেও...একঘেয়ে দাম্পত্যে মিঠে রোমাঞ্চের স্বাদ আনতে চলুন উত্তরাখণ্ডের চক্রাতায়। আবার এখানেই খুঁজে নিন নিজেকেও...

Advertisement

ঈপ্সিতা বসু

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:১৮
Share:

ফুলের বাগিচায়

মেঘ-পিয়নের ডাকে, পাহাড়ি উপত্যকায় রংবেরঙের ফুলের মাঝে, পাইন গাছের ভিড়ে আমার ‘আমি’কেই যেন খুঁজে পেয়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের চক্রাতায়। ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো সুন্দর পার্বত্য এলাকায় চরৈবেতি আমার কাছে নতুন নয়। কিন্তু চক্রাতা যে আরও অনেক ডালি সাজিয়ে রেখেছে।

Advertisement

ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বলে এখানে নিয়মের শাসন আছে, কিন্তু দাপট নেই। উদার মনের গাড়োয়ালি মানুষজন। মিশ্র সংস্কৃতি মিলিয়ে যেন ‘সব পেয়েছির দেশ’। শহুরে বিলাসিতা স্পর্শ করেনি এখনও। জনশ্রুতি, মহাভারত-খ্যাত ‘বক বধ পালা’র একচক্রা গ্রামটি এখানেই ছিল। তা থেকেই নাম বদলে এখন হয়েছে চক্রাতা। সেখান থেকে অনাবিল আনন্দ নিয়ে কলকাতায় ফিরেই কলম ধরলাম।

নতুন নতুন জায়গা চেনার নেশায় দেশ ছাড়িয়ে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু কবির কথায় ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’। এ বার সেই ইচ্ছেতেই শুরু সফর।

Advertisement

কিন্তু চক্রাতা কেন? আট-দশটা সাইট সিয়িংয়ের গণ্ডিতে আটকে যাওয়া নয়। ছিল না বেড়াতে এসেও রুটিন মেপে চলার জীবন। ছিল কেবল ইচ্ছে মতো লাগামহীন হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ। আমার সঙ্গে আরও যাদের পছন্দটা মিলে যাবে, তাদের জন্যই চক্রাতা। ঠান্ডা সহ্য না হলে এ পথ বেশ কষ্টের! এপ্রিল থেকে জুন এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর চক্রাতা ঘোরার মনোরম সময়। গরমেও ১০ ডিগ্রির নীচে তাপমাত্রা নেমে যায়। অবশ্য তুষারপাত দেখতে হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিই ভরসা। প্রকৃতি নিরাশ করবে না। নভেম্বর থেকে এপ্রিলে স্কিয়িং এখানকার জনপ্রিয় আকর্ষণ। ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং, সাইক্লিং...কী নেই‌! তবুও সে পর্যটকের কাছে প্রায় অপরিচিতই। তাই হয়তো নেই হোটেল-রিসর্টের বাড়াবাড়ি। নেই অকারণ কোলাহল। আছে গাড়োয়ালি পরিবারের আতিথেয়তা। মুগ্ধ করবেই হোম স্টেতে থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধে।

পরিকল্পনা না করে কেবল ইন্টারনেট ঘেঁটে কয়েকটি তথ্যের উপর নির্ভর করেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি। সেখান থেকে জনশতাব্দীতে দেহরাদূন। সে দিন রাত্রিবাস এখানেই। দেহরাদূন থেকে চক্রাতা প্রায় ৮৭ কিমি। যমুনাকে সঙ্গী করেই কখনও রুক্ষ পাহাড় তো কখনও সবুজের বুক চিরে গাড়ি ছুটে চলেছে। ঝুম চাষের খেত, ছোট ছোট ধাপ কাটা আবার কোথাও শীর্ণকায়া নদী, দলছুট হনুমান, পাহাড়ি কুকুর— কত কী যে জলছবির মতো চোখের সামনে এসে মিলিয়ে গেল! এ পথেই আরও ৪০ কিমি এগোলে পড়বে ডাকপাথার। যমুনার পারে এক অনাঘ্রাতা পাহাড়ি গ্রাম। ডাকপাথারের আগেই আসান ব্যারেজ। গরম চা আর রোমাঞ্চকর জলক্রীড়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। কিছুটা সময় প্রকৃতির কোলে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নতুন পথে। ডাকপাথার থেকে কালসির দূরত্ব কম করে সাত কিমি। সম্রাট অশোকের শিলালিপি এখানকার আকর্ষণ হলেও মন বলল, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’। আবার গাড়ি উঠতে শুরু করল পাকদণ্ডি বেয়ে। সেনা শহর চক্রাতায় পৌঁছনোর আগেই তুষারমাখা হিমালয় দৃশ্যমান।

গাড়ি থামে চক্রাতা বাজারে। আর পাঁচটা পাহাড়ি বাজারের মতোই। তাই বাজার ছেড়ে খোলা রাস্তায় হাঁটতেই মন চেয়েছিল। বড় বড় পাইন আর পড়ন্ত সূর্যের গোধূলির আলো মেখে ছিল পথ।

সূর্য যখন পাটে

কিন্তু শহুরে জীবনে অভ্যস্ত পায়ে জোর কম। অগত্যা গাড়ির শরণ। চক্রাতা বাজার থেকে খানিকটা নামতেই চিন্তাহরণ মহাদেবের মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে এগোলাম খাড়াম্বা চূড়ার দিকে। সেখান থেকে চিলমিরি পৌঁছতেই অনির্বচনীয় দৃশ্য। যাতায়াতের পথে পাহাড়ের গা বেয়ে আসা জলধারা খানিক জমে গিয়েছে। রাস্তার বেশ কিছুটা অংশ পাহাড়ি ঢাল। বছরের অনেকটা সময় রোদের দেখা পায় না। সেখানে পুরোটাই বরফ। তবে এখানকার সবচেয়ে আকর্ষক জায়গা টাইগার ফল্‌স। অনেকটা উঁচু থেকে পড়া জলধারায় দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। দু’পাশে রডোডেনড্রন-ওকের সারি। প্রকৃতি অকৃপণ এখানে। কী অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চারিদিকে। কাছেই ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য মুনডালি। শীতকালে বসে স্কিয়িংয়ের আসর।

উপত্যকা ও পাহাড়ের মাঝে ভোরের চক্রাতার আবার অন্য রূপ। সোনালি উজ্জ্বল রোদ, তুষারঢাকা পর্বতশৃঙ্গ দু’হাত বাড়িয়ে যেন ডাকছে! হিমালয়কে আরও ভাল করে দেখতেই চললাম দেওবন। চক্রাতা থেকে গাড়িতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল। অবশ্য দেওবনের শীর্ষে পৌঁছতে প্রায় দুই কিমি হাঁটা পথও অতিক্রম করতে হল। পর্যটকদের ভিড়ে ভারাক্রান্ত হয়নি এই পার্বত্য এলাকাও।

ফিরতি পথে আরও কিছুটা এগোতেই পেলাম আর এক সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরা রাজ্য চানি চুরানি। সে রাত কাটালাম ওখানেই। কাঠের বাড়ি। আর প্রতিটি বাড়িতেই একফালি জমি। ফুলের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার পাশ দিয়ে ঢাল বরাবর পাহাড় নেমে গিয়েছে। মেঘ-পাহাড়ের কোলে বসে কফির কাপে চুমুকেই বয়ে যায় অলস অবসর। আর দেখা মেলে হরেক রকমের পাখি আর হিমালয়ের অবর্ণনীয় শোভা।

বুকভরা অক্সিজেন আর মনভরা প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে ল্যাপটপে ছবি খুলে বসতেই সেই স্মৃতির রোমন্থন। কেজো জগতে কংক্রিটের জঙ্গলে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। তাকে খুঁজে পেয়েই নতুন উদ্যমে আবার কাজে লেগে পড়লাম। কিন্তু একঘেয়ে জীবনে মিঠে স্বাদ আনতে গিয়ে কতটাই বা চিনতে পারলাম এই পার্বত্য অঞ্চলকে! চেনা-জানার বাকি আছে অনেক, তাই তো ফিরে আসার আশ্বাস দিয়ে এসেছি চক্রাতাকে... মেঘবালিকার নতুন ঠিকানা!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement