মোহনবীণায় বিশ্বমোহন ভাট
চণ্ডীগড়ের রবীন্দ্র থিয়েটারে ২১ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত প্রাচীন কলাকেন্দ্রের উদ্যোগে ৫১তম সর্বভারতীয় ভাস্কররাও নৃত্য ও সঙ্গীত সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। সাত দিনব্যাপী এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন পঞ্জাবের রাজ্যপাল বনোয়ারিলাল পুরোহিত। প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের পর অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করা হয় তবলাবাদক সুরেশ তলওয়ারকর, চিত্রকর-লেখক সিদ্ধার্থ ও ভরতনাট্যম শিল্পী অঞ্জনা রাজনকে। উদ্বোধনী ভাষণে রাজ্যপাল পুরোহিত ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের পাশাপাশি লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের ঐতিহ্যের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে প্রবীণ তবলাবাদক সুরেশ তলওয়ারকর তাঁর কন্যা-সহ নবীন পাঁচ জন শিল্পীকে নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান উপস্থাপিত করেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরম্পরাকে বজায় রেখেও সুরেশ তলওয়ারকর বিদেশি সঙ্গীতকে আপন করে নিয়েছেন। তারই পরিচয় পাওয়া যায় সে দিনের ফিউশন-মিশ্রসঙ্গীতের উপস্থাপনায়। সে দিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন তবলায় তাঁর সুযোগ্যা কন্যা সাওনী তলওয়ারকর, গানে তাঁর আর এক শিষ্য নাগেশ আরগাওকর। হারমোনিয়ামে ছিলেন তাঁর শিষ্য অভিষেক শিলকর। সুরেশজির আরও দু’জন শিষ্য হাজির ছিলেন। ঈশান পরাঞ্জপে ছিলেন স্প্যানিশ বাদ্যযন্ত্র কহোন নিয়ে, আর ঋতুরাজ হিঙ্গে বাজান আফ্রিকান বাদ্যযন্ত্র কলাবাস। শিল্পীকে কলাকেন্দ্রের পক্ষে ‘তালমার্তন’ উপাধিতে ভূষিত করা সার্থক হয়েছিল। উৎসবের সূচনায় প্রবীণ ও নবীন শিল্পী সমন্বয়ে মঞ্চস্থ অনুষ্ঠানটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকেই ইঙ্গিত বহন করে।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় কণ্ঠসঙ্গীতের উপস্থাপনায়। শিল্পী অধ্যাপক হরবিন্দর সিংহ। এ দিন হরবিন্দরজি রাগ বাগেশ্রী পরিবেশন করেন। এই রাগের পরিবেশনা দর্শক-শ্রোতাকে আপ্লুত করে। তাঁর সঙ্গে যন্ত্রে সহযোগিতা করেন হারমোনিয়ামে রাজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলায় ছিলেন গোপীকান্ত ঝাঁ’র সুযোগ্য পুত্র এবং বুলবুল মহারাজের শিষ্য মিথিলেশ ঝাঁ। হরবিন্দর সিংহের দুই শিষ্য সৌরভসুধ ও অরুণদীপ সিংহ তানপুরায় সহযোগিতা করেন। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান ছিল সরোদ বাদন— শিল্পী দেবাশিস ভট্টাচার্য। সে দিন তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন দুর্জয় ভৌমিক। তানপুরায় সহযোগিতা করেন সুব্রত দে। শিল্পীর প্রথম নিবেদন রাগ ঝিঞ্ঝোটি। তার পর আর একটি উপস্থাপনা রাগ কলাবতী। শিল্পী অনুষ্ঠান শেষ করেন মিশ্র পিলু রাগে একটি ধুন বাজিয়ে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেও সুরের রেশ থেকে যায় প্রেক্ষাগৃহে, দর্শক শ্রোতার মনে।
তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ বিদুষী তুলিকা ঘোষের কণ্ঠসঙ্গীত দিয়ে। তবলিয়া নিখিল ঘোষের সুযোগ্যা কন্যা এবং প্রখ্যাত বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষের ভ্রাতুষ্পুত্রী তুলিকা টপ্পা শেখেন হনুমানপ্রসাদ মিশ্রের কাছে। তুলিকার প্রথম নিবেদন ‘হরিচরণ কি…’ পরে তারানা ও শেষে রাগমালিকা পরিবেশন করেন। কথা ও সুরের এমন আশ্চর্য সমন্বয় সচরাচর শোনা যায় না। রাগমালিকাটি শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। সে দিন তুলিকা ঘোষকে তবলায় সহযোগিতা করেন দুর্জয় ভৌমিক। তানপুরা বাদনে ছিলেন দীপশিখা ও কুসুমলতা।
দ্বিতীয়ার্ধের শিল্পী ছিলেন সেতারবাদক পার্থ বসু। পরিবেশন করেন রাগ বেহাগ। ত্রিতালে নিবদ্ধ এই রাগের উপস্থাপনা যথাযথ ছিল। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন
চতুর্থ দিনের অধিবেশন শুরু হয় কণ্ঠসঙ্গীত দিয়ে— শিল্পী সৌনক অভিষেকী। সৌনকের সঙ্গে হারমোনিয়ামে সহযোগিতা করেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়, যাঁকে এর আগে অন্য অধিবেশনেও আমরা পেয়েছি। তানপুরায় ছিলেন প্রাচীন কলাকেন্দ্রের ছাত্রী অ্যাঞ্জেলিনা এবং সৌনকের ছাত্র সত্যজিৎ কেরকর। শিল্পীর প্রথম নিবেদন রাগ সরস্বতী। তাল রূপক। পরে একটি ঠুমরি— ‘চঞ্চল নারী দু’ধারী কাটারি’। শেষে চারুকেশী রাগে নিবেদন করেন তাঁর পিতার একটি সঙ্গীত নির্মাণ— ‘হে পুরানো চন্দ্রভা’। চমৎকার উপস্থাপনা।
চতুর্থ দিনের দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান ছিল কুচিপুড়ি নৃত্যের। শিল্পী বৈজয়ন্তী কাশি। বৈজয়ন্তী কাশি যক্ষগান কলাপম ও কুচিপুড়ি নৃত্যে শিক্ষাপ্রাপ্ত। গুরু ড. নটরাজ রামকৃষ্ণের কাছে নৃত্যশিক্ষা করেন তিনি। বেঙ্গালুরুবাসী এই নৃত্যশিল্পী তিরিশটিরও অধিক নৃত্য পরিকল্পনা করেছেন। ওই দিন তাঁর প্রথম নিবেদন ছিল ‘আদিভু আল্লাদিভু’। তিরুমালাই পর্বতের অধীশ্বর ভেঙ্কটেশ ও শ্রীদেবী-ভূদেবীর কাহিনি নিয়ে এই নৃত্যের পরিকল্পনা। পরের উপস্থাপনা আভঙ্গ—বিঠ্ঠল অর্থাৎ কৃষ্ণের রূপবর্ণনা। শেষে কৃষ্ণলীলা তরঙ্গিনী থেকে নিবেদন— নীলমেঘ শরীরম। বৈজয়ন্তীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর শিষ্যা অভিগ্না গুরিকর, প্রতীক্ষা কাশি, দীক্ষা শঙ্কর, গুরুরাজু এন, শিবানী অবধানী, আসুদালা ও হিমা বৈষ্ণবী। শিল্পীর শেষ নিবেদন ছিল যক্ষগান আঙ্গিকে কৃষ্ণতর্পণ। এই কৃষ্ণতর্পণ ভাগবতের পুতনামোক্ষম থেকে আহরিত। কথা প্রভাকর যোশী, সুর আরোপ করেছেন রমা পি। বৈজয়ন্তী ও সহশিল্পীদের নৃত্য কুচিপুড়ি ও যক্ষগানের পরম্পরাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরে।
পঞ্চম দিনের অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে ছিল শাস্ত্রীয় গায়ন— শিল্পী সঞ্জীব অভিয়ংকর। তাঁর অনুষ্ঠান শুরু হয় রাগ শুদ্ধকল্যাণ দিয়ে ‘বোলন লাগি পাপিহা’। পরে রাগ কলাবতী, তাল ত্রিতাল ও শেষে মীরার ভজন ‘মোহন খেলত হোলি’, তাল কাহারবা। সুকণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পীর গান শ্রোতা-দর্শককে আবিষ্ট করে রেখেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান বংশীবাদন— পিতাপ্রবীণ গোরখণ্ডে ও পুত্র সরোজ গোরখণ্ডের যুগলবন্দি উপভোগ্য হয়েছিল।
ষষ্ঠ দিনের প্রথমার্ধে সন্তুর বাদন শিল্পী রাহুল শর্মা। সন্তুরের সঙ্গেই রাহুল পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র পিয়ানো, স্যাক্সোফোন এবং নাইজেরিয়ান উড-ও বাজাতে পারেন। ওই দিন রাহুলের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন মুকুন্দ রাজদেও। রাহুল তাঁর অনুষ্ঠান শুরু করেন হংসধ্বনি রাগ বাজিয়ে। প্রথমে আলাপ, পরে মধ্যতাল ও শেষে তিনতালে নিবদ্ধ ছিল তাঁর উপস্থাপনা। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সুযোগ্য পুত্র রাহুল শর্মা সে দিনের অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।
দ্বিতীয়ার্ধে নৃত্যের অনুষ্ঠান, শিল্পী পদ্মজা সুরেশ। আত্মালয় অ্যাকাডেমির চেয়ারপার্সন পদ্মজা সুরেশ নৃত্যের রিসার্চ স্কলার। গুরু কে কল্যাণসুন্দর। পদ্মজার প্রথম নিবেদন ছিল গণেশবন্দনা। তার পর কৌতুভম। বিষয় পৃথিবীর মাতৃকা কামাক্ষী দেবী (পার্বতীর আর এক রূপ)। প্রথমটির নৃত্য নির্মাণ করেন পি এস কৃষ্ণমূর্তি। পরে কীর্তনম, নৃত্য পরিকল্পনা শ্রী দীক্ষিত। তাঞ্জোর ঘরানার বৈশিষ্ট্য কৌতুভম সে দিন দর্শক উপভোগ করেছিলেন। দ্বিতীয় নিবেদন ছিল অধরাবর্ণম। মীনাক্ষী দেবী জন্মকথা এবং কার্তিক ও গণেশের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহের কথা বর্ণিত হয়েছে এই নৃত্যের মধ্য দিয়ে। গতি পরিবর্তনই ছিল এই বর্ণমের বৈশিষ্ট্য। সঙ্গীতস্রষ্টা মুথাইয়া ভাগবত। রাগ খাম্বাজ। তাল আদি। দেবীকে শঙ্করী, শ্যামা, চামুণ্ডেশ্বরী... নানা বর্ণনায় ভূষিত করা হয়েছে এই নৃত্যে। পরে জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে রাধার বিরহ— ‘রাধিকা তব বিরহে কেশব’। রাগ বাসন্তী, তাল আদি। চণ্ডী থেকে দুর্গা সপ্তসতী আর এক কৌতুভম। পরিকল্পনা মহালিঙ্গম পিল্লাই। রাগ বালেচি, তাল খণ্ডচাপু। সহযোগিতায় ছিলেন, সঙ্গীতে বালসুব্রহ্মনিয়ম, মৃদঙ্গে শ্রীহরি রঙ্গস্বামী, বাঁশিতে জয়রাম কে এস, নটুভঙ্গম—আর কেশবন। পদ্মজা তাঁর অনুষ্ঠান শেষ করেন একটি ভজনের নৃত্যরূপ দিয়ে, ‘ভজত অখিল মৈত্রীম’। চন্দ্রশেখর সরস্বতী কৃত এই সঙ্গীতটি ইমনকল্যাণ রাগে, আদি তালে নিবদ্ধ। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন তাঁর নৃত্যশিল্পী ভগিনী কাঞ্চনা নারায়ণ।
সপ্তম দিনের প্রথমার্ধে ছিল তবলা বাদন। শিল্পী যোগেশ সামসি। তাঁর তবলাবাদন আর একবার শ্রোতাদের মোহিত করল। তাঁর বাজানো পরন, চক্রদার, দ্রুত তিনতাল যেন সূক্ষ্ম অঙ্কের বিন্যাস। তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে সহযোগী ছিলেন তন্ময় দেওচাকে।
উৎসবের শেষ অনুষ্ঠানের শিল্পী ছিলেন বিশ্বমোহন ভাট। শিল্পী তাঁর সৃষ্ট যন্ত্র মোহনবীণা বাজালেন। এই প্রসঙ্গে আর এক মোহনবীণার কথা উল্লেখ করি। সরোদকে অদলবদল করে মোহনবীণা সৃষ্টি করেন এক কালের প্রসিদ্ধ সরোদবাদক রাধিকামোহন মৈত্র। তাঁর মৃত্যুর পর এই যন্ত্র বাজানোর শিল্পী নেই বললেই চলে, ছাত্রদের বাড়িতেই যন্ত্রগুলি শোভা পাচ্ছে। বিশ্বমোহন ভাট তাঁর পুত্র সলিল ভাটকে নিয়ে সে দিনের আসরে বসেছিলেন। এই পরম্পরাই হয়তো মোহনবীণাকে বাঁচিয়ে রাখবে। শিল্পী শিবরঞ্জনী ও মধুবন্তী রাগের মিশ্রণে একটি নতুন রাগ বাজান, বিশ্বরঞ্জনী। রাগটি তিনিই সৃষ্টি করেছেন। সে দিন ছিল প্রাচীন কলাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা কোশলজির প্রয়াণ দিবস। বিশ্বমোহন ভাট তাঁরই স্মৃতির উদ্দেশে রাগটি নিবেদন করেন।
সাত দিনের এই সঙ্গীত মহোৎসবে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম—ভারতের সমস্ত প্রান্ত থেকেই শিল্পীরা এসে অংশগ্রহণ করেন। পরম্পরা বজায় রেখে নবীন ও প্রবীণ শিল্পীদের সমাগম ঘটে এবং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গীত ও ভারতীয় সঙ্গীতের মিশ্রণে পরীক্ষামূলক ফিউশনেরও উপস্থাপনা করা হয়। আশা করব, ভবিষ্যতেও নৃত্যের এমন এক্সপেরিমেন্ট দেখতে পাব এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত ও নৃত্যের ধারা অব্যাহত থাকুক।