গুরুদোংমার লেক
রডোডেনড্রনে ঘেরা পাহাড়ি গ্রাম লাচেন থেকে শুরু হয় গুরুদোংমারের উদ্দেশে যাত্রা। যতটা রঙিন শোনাচ্ছে এই যাত্রা, একেবারেই তা নয়। তবে রোমাঞ্চকর বটে। কারণ যাত্রা শুরু হবে মাঝরাতে। গুরুদোংমার যাওয়ার নিয়মই এ রকম অদ্ভুত। সিকিমের গ্যাংটক থেকে সাত-আট ঘণ্টা লাগে লাচেন পৌঁছতে আর সেখান থেকে মাঝরাতে বেরিয়ে প্রায় চার ঘণ্টার রাস্তা গুরুদোংমার। সফরটা ভেঙে ভেঙে সময় নিয়ে করতে পারলেই ভাল। কারণ একেবারে এতটা উচ্চতায় উঠে এলে শরীর মানিয়ে নিতে পারবে না। তাই বিকেল-বিকেল লাচেন পৌঁছে পর দিন ভোররাতে গুরুদোংমারের যাত্রা শুরু করতে হয়।
সৌভাগ্যবশত আমাদের যাত্রা ছিল পূর্ণিমার রাতে। মাথার উপর ঝলমল করছে শয়ে শয়ে তারা আর চাঁদ। তার সঙ্গে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। বৈদ্যুতিক আলোহীন রাস্তায় ভরসা শুধু তারা আর গাড়ির আলো। রাত আড়াইটে-তিনটে নাগাদ যাত্রা শুরু হল গুরুদোংমারের উদ্দেশে। পরপর একসঙ্গে সব গাড়ি এগিয়ে চলেছে পাকদণ্ডি বেয়ে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির চালকদের এই বোঝাপড়াটাও দেখার মতো। রাতের আকাশ তখন যেন মাথার উপরে চাঁদোয়া, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। বিড়লা তারামণ্ডল ছাড়া আর কোথাও খালি চোখে এত কাছ থেকে এত স্পষ্ট তারা কখনও দেখিনি। ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইট’ ছবিটির সারমর্ম বুঝতে পারলাম এত দিনে।
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে এ রকম ঘুরতে বেরিয়ে পড়়ার অভিজ্ঞতা নেই কখনও। ভেবেছিলাম, মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু এ রকম রোমহর্ষক সফর দু’পলকের দূরত্ব সমান ভাবে বজায় রাখল সারাটা রাস্তা।
চলার পথের দু’পাশের পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেউ চুনকাম করেছে। ভোরের আলো ফুটতে বুঝতে পারলাম, সাদা রঙের প্রলেপ পড়েছে প্রকৃতির হাতে বরফের তুলিতে। পাহাড়ের এক-এক জায়গায় তুষারধসের চিহ্নও বেশ স্পষ্ট।
গুরুদোংমারের পথে
লাচেন থেকে যাত্রা শুরুর পর প্রথম দিকে খানিকটা রাস্তা বেশ বন্ধুর। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও গাড়ির ঝাঁকুনিতে মালুম হয়। কিন্তু আর একটু এগোতেই পাওয়া গেল ঝকঝকে চকচকে, মসৃণ রাস্তা। গুরুদোংমার হ্রদটি ১৭,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, লাদাখের প্যাংগং লেকের (১৪,২৭০ ফুট) চেয়ে অনেক বেশি উঁচুতে এই হ্রদ। সেই উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য মসৃণ পিচঢালা রাস্তা দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। পরে আর্মি ক্যান্টিনে জানা গেল যে, পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত (উচ্চতার জন্য) পাহাড়ি রাস্তা, যেখানে সহজে গাড়ি চলাচল করতে পারে।
দেড় ঘণ্টা পর গাড়ি এসে থামল ছোট্ট একটা গ্রামে। হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি রয়েছে এই থাঙ্গু গ্রামে। এখানেই কোনও এক বা়ড়িতে হবে আমাদের ব্রেকফাস্ট। হোটেল থেকেই ব্রেকফাস্ট প্যাক করে দেয়। থাঙ্গুতে কারও বা়ড়িতে সেটা গরম করে ব্রেকফাস্ট সারা হয়। তার সঙ্গে একটু বিশ্রামও নেওয়া হয়। গাড়ি থেকে নেমেই পা দুটো যেন টলে গেল। বুঝতে পারলাম উচ্চতার সঙ্গে সইয়ে নেওয়ার জন্যই মাঝের এই বিরতি।
এখান থেকে গুরুদোংমারের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ঘণ্টাখানেক সুন্দর রাস্তায় আরাম করে এসে পৌঁছলাম হ্রদের ধারে। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে-মুখে এসে লাগল ঠান্ডা হাওয়া। সেই হাওয়া ছুরির ফলার মতো চিরে দিয়ে যাচ্ছে নাক-মুখ। যেমন ঠান্ডা, তেমনই হাওয়ার দাপট। প্রথম দিকে শ্বাস নিতেও একটু সমস্যা হচ্ছিল। একে এত উচ্চতায় বায়ুর চাপ কম, তার সঙ্গে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব। ফলে চট করে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। মিনিট দশেক সময় লাগে স্বাভাবিক হতে। একটু বিশ্রাম নিয়ে এগোলাম হ্রদের দিকে। শীতের শুরুতে হ্রদের পিছনের পাহাড়ের অর্ধেকাংশ বরফে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। আর তার সামনের হ্রদের স্বচ্ছ জলে নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি। মনে হল যেন কোনও স্বর্গের জলাশয়ে চলে এসেছি। তখনই ঠিক করে নিয়েছি যে, এই জল না ছুঁয়ে ফিরে যাব না।
গাড়ি যেখানে নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে বেশ কিছুটা নামলে হ্রদের নাগাল পাওয়া যায়। সে দিকে এগোতেই ড্রাইভার জানান দিলেন, ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে ফিরতে হবে। হাওয়ার গতি এত বেড়ে যায় যে, সকাল সাড়ে ন’টার পরে আর হ্রদের ধারে দাঁড়ানো যায় না। সেই জন্য মাঝরাতেই যাত্রা শুরু করে সকাল সকাল গিয়ে ঘুরে আসতে হয় এই হ্রদ থেকে।
বরফের পাহাড়
ড্রাইভারের কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললাম হ্রদের দিকে। হু হু হাওয়ায় জমে যাচ্ছে হাত-পা, শিরশিরিয়ে ঠান্ডা নামছে শিরদাঁড়া বেয়ে। হ্রদের কাছে যেতেই যেন জীবনীশক্তি ফিরে পেলাম। হ্রদের ধারে হাওয়ায় উড়ছে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ, তার পাশে কয়েক জন লামা বসে মন্ত্র পাঠ করছেন। বাতাসে ভেসে আসছে পাহাড়ি ধূপের গন্ধ। হ্রদের জলে প্রতিফলিত সূর্যের আলো এসে লাগছে চোখেমুখে। হাঁটু গেড়ে বসে হ্রদের হিমশীতল জল ভরে নিলাম দু’হাতে। নৈসর্গিক দৃশ্যে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।
হাতে সময় বেশি নেই। হাওয়ার গতি বাড়ছে। ফিরতি পথের ডাকে উঠে এলাম হ্রদ থেকে। সঙ্গে রইল সেই বরফমোড়া পাহাড় আর হ্রদের জলে আকাশের গল্প।
ফেরার পথে চোপতা ভ্যালিতে এসে গাড়ি দাঁড়াল। রাস্তার ধারের ভিউ পয়েন্টের পাথরে বসে চোখ বুজতেই সেই উপত্যকা ভেসে গেল গুরুদোংমারের জলে। চোখের সামনে ভেসে উঠল স্বচ্ছ নীল হ্রদ।
চোপতা ভ্যালি
মনে রাখতে হবে
• গুরুদোংমার যাওয়ার জন্য পারমিট লাগে। গ্যাংটকে পৌঁছে সেখান থেকে গুরুদোংমার যাওয়ার পথে পারমিট বানিয়ে নিতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় নথি অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে।
• উচ্চতার জন্য অনেক রকম শরীর খারাপ হতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
• খুব ছোট বাচ্চা ও বয়স্ক মানুষদের এই হ্রদে যাওয়ার অনুমতি মেলে না।
• গুরুদোংমার ঘুরতে যাওয়ার প্রাথমিক শর্তই হল অাবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। তাই গুরুদোংমার যাওয়ার আগের দিন লাচেন পৌঁছে কিছুটা সময় কাটানোর চেষ্টা করবেন।
কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছনোর অজস্র ট্রেন আছে। ট্রেনে চেপে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে গ্যাংটক। গ্যাংটক থেকে সাত-আট ঘণ্টার রাস্তার পর লাচেন। সেখান থেকে গুরুদোংমার। পুরো ট্রিপের জন্য একটা গাড়ি সঙ্গে রাখলেই ভাল।
কোথায় থাকবেন
গ্যাংটক আর লাচেনে রাতে থাকতে হবে। আর এই দুই জায়গাতেই রাত্রিবাসের জন্য অসংখ্য হোটেল পেয়ে যাবেন।
যাওয়ার সময়
এপ্রিল-মে মাসে গেলে প্রচুর রডোডেনড্রন দেখা যায়। শীতের শুরুতে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যেও যাওয়া যায়। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি হ্রদের জল জমে বরফ হয়ে যায়। তখন রাস্তাও বন্ধ থাকতে পারে।