সিমলিপালের পাহাড়ি নদী
বাই উঠলে বাঙালি কি এখনও কথায় কথায় কটক যায়?
নাহ, বাঙালির বাই এখন সেই দিঘা, পুরী, দার্জিলিং। কিন্তু যদি দিঘা গিয়ে ফের বাই ওঠে? দিঘাকে এড়াতেই চেয়েছিলাম আমরা। তাই কাছেপিঠের মন্দারমণি। রাত পার হতে না হতে বাইটা উঠল সেখানে গিয়েই। দলের সকলেই একমত যে, পরদিন সকালেই বেরোতে হবে। কিন্তু কোথায়? প্রথম থেকেই ঠিক ছিল দিঘা যাব না। তা হলে কোথায়? অবশেষে গুগলের স্মরণ নিতেই হল। ঠিক হল কটক না হলে সেই কটকেরই দেশে। ভোটে জিতে গেল ওডিশার চাঁদিপুর।
মাঝ অগস্টের এক সকালে শুরু হয়েছিল পথচলা। কলকাতা থেকে মন্দারমণি। কিন্তু মন টিকল না। পরদিন হোটেলে ব্রেকফাস্ট শেষ করেই ফের যাত্রা শুরু। দিঘাকে বুড়িছোঁয়া করে চাঁদিপুরের উদ্দেশে ছুটল গাড়ি। চাঁদিপুরের হোটেলে যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে দুপুর। লাঞ্চ সেরে ক্ষণিকের বিশ্রাম। তার পরে দে ছুট। একেবারে সমুদ্রতটে।
কুলডিহার বনপথ
সমুদ্রতটের ধারেই ওডিশা পর্যটন নিগমের পান্থনিবাস। পান্থনিবাসের উঠোন দিয়েই যেতে হয় সি-বিচে। সমুদ্রের ধারে বাঁধানো পাড়। ছিমছাম সাজানো। কিন্তু যা দেখতে আসা, সেই সমুদ্র কোথায়?
আমরা যখন সমুদ্রের ধারে পৌঁছলাম, তখন পড়ন্ত বিকেল। নিভন্ত সূর্যের লালিমায় রক্তিম চরাচর। কিন্তু সমুদ্রের জল তট থেকে মাইলটাক দূরে। হতাশই হলাম। জানা গেল, জোয়ারের সময় জল তিরবেগে ছুটে আসে পাড়ের দিকে। কাঙ্ক্ষিত সেই জোয়ার কখন আসবে? শুনলাম, আবার আসবে কাল দুপুরে। যাঃ, আবার কাল?
সিমলিপালের পথে, নাম না জানা পাহাড়
ঢেউয়ের শব্দ শোনা না যাক, পাড়ে পর্যটকদের কলরবের কোনও কমতি ছিল না। যাঁদের অনেকেই আবার বাঙালি। মনমরা আমরা ক’জন। বাকি পর্যটকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেনাকাটায়। সমুদ্রের ধারে হরেক পশরা। খাবারের দোকান। বাজার থেকে কিনে আনা মাছ ‘এই সমুদ্র থেকে ধরে আনা’ বলে দিব্যি বিকোচ্ছে। ঝুপ করে রাত নামতেই কোলাহলটা যেন বে়ড়ে গেল। দূরের সমুদ্রটা তখন বড় নিঃসঙ্গ, একলা। তারই মধ্যে কয়েকটা লণ্ঠনের আলোর নড়াচড়া চোখে পড়ল। ওগুলো জেলেদের নৌকো। সমুদ্র দেখার সাধ না মিটুক, আঁধার সমুদ্রে টিমটিমে আলোর মালা ছবির মতো আজও মনে গেঁথে রয়েছে।
হোটেলে ম্যানেজারের কাছে হতাশার কথা পাড়তে তিনি বললেন, ‘‘আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি রয়েছে। সিমলিপাল আর কুলডিহায় ঘুরে আসুন না। আশা করছি, হতাশ হবেন না। একজন গাইড নিয়ে যান। আপনাদের চিনিয়ে নিয়ে যাবে।’’
পরদিন ব্রেকফাস্ট করে যাত্রা শুরু হল। গাইড সকালেই হাজির হয়েছিলেন হোটেলে। জানা গেল, হোটেল থেকে দেবকুণ্ড কমবেশি ১০০ কিমি। হিসেব মতো দু’ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। শহর ছাড়তেই মন ভাল করা দৃশ্য একের পর এক হাজির হতে থাকল চোখের সামনে। সবুজে সবুজ চার দিক। যত এগোচ্ছি, ততই ঘন হচ্ছে সবুজ। সঙ্গে চমকও। রাস্তার বাঁক ঘুরতে আচমকাই চোখের সামনে হাজির হচ্ছে ছোট-বড় পাহাড়। যদিও বর্ষাকাল। কিন্তু যাত্রা শুরুর সময়ে ঘন নীল আকাশের বুকে কালো মেঘের লেশমাত্রও ছিল না। দেখলাম, সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আটকে মেঘপুঞ্জ। কখনও কখনও উড়ে এসে আটকে যাচ্ছে বড় মেঘের টুকরো। সবুজ কার্পেটের উপর ধবল মেঘের এমন ছোটাছুটিতে যেন মন ভাল করার ওষুধ লুকিয়ে রাখা ছিল। কিন্তু থামতে সেই হলই। কিছুটা গিয়েই। ততক্ষণে দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে। সঙ্গে কালো মেঘের হুটোপাটি। কালচে চাদরে মুখ লুকোনো সূর্যের বিচ্ছুরণ এমন মায়াবী আলো ঢেলেছে সবুজ ধানখেতের উপরে যে, গাড়ি থেকে না নামাটা অপরাধ বলে মনে হত। আর নামার আরও বড় কারণ একটি ছোট্ট টিলা মতো পাহাড়। ঠিক পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ের মতো যেন। তবে পুরুলিয়ার মতো এ প্রান্তর রুক্ষ নয়। আদিগন্ত সবুজ। তার মধ্যে ধূসররঙা পাহাড়, দূরে জঙ্গল এবং আরও দূরে পর্বতমালা— এ যেন এক চলমান মায়াবী ছায়াছবি।
দেবকুণ্ড
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিমলিপাল ফরেস্ট রেঞ্জের গেটে পৌঁছলাম আমরা। ভিতরে ঢুকতেই আবার রঙের খেলা। লাল মোরাম বিছানো পথে বৃষ্টি পড়ে তার রং আরও গভীর। দু’দিকে শাল-পিয়াল হাত বাড়িয়ে। কিছুটা গিয়ে ফের থামতে হল। গাড়ি আর যাবে না। পরের এক কিমি হাঁটাপথ। ভাগ্যিস! হাঁটাপথের শুরুতেই একটা পাহাড়ি ঝরনা। তার উপরের অপরিসর রাস্তাটাই আামাদের পথ। হাঁটতে হাঁটতে বারবার দেখা হল সেই ঝরনার সঙ্গে। কোথাও সে খরস্রোতা, কোথাও বা তার অপার বিস্তার। কুলকুল করে বয়ে চলেছে।
ঋষিয়া জলাধার, কুলডিহা
সিমলিপাল আসলে সংরক্ষিত অরণ্য। কিন্তু বর্ষা বলে ‘টাইগার রিজার্ভ’ এলাকায় ঢোকার অনুমতি নেই। অতএব পরের গন্তব্য দেবকুণ্ড। আরও কিছুটা হাঁটতেই সামনে এল সেই দৃশ্য। পাহাড়ের উপর থেকে সশব্দ নীচে আছড়ে পড়ছে জলরাশি। আরও কাছে যেতে নজরে পড়ল পাহাড় চুড়োয় একটা মন্দির। কথিত আছে, দেবতারা এখানে স্নান করেন। তাই নাম দেবকুণ্ড। এই কুণ্ডের নীচে রয়েছে এক প্রস্তরখণ্ড। স্থানীয় বিশ্বাস, সেটা আসলে শিবলিঙ্গ। অনেক চেষ্টা করেও তা নাকি তোলা যায়নি। ১৯৪০ সালে ময়ূরভঞ্জ জেলার রাজা পাহাড়ের উপরে মন্দিরটি তৈরি করেন। সেখানে রোজ পুজো হয়। মন্দিরে যেতে হলে ভাঙতে হয় প্রায় দুশো সিঁড়ি। ঘন বর্ষাতেও পর্যটকের অভাব নেই। জলপ্রপাতের ধারে থিকথিকে ভিড়। তার জল এমন স্বচ্ছ যে, অনেক গভীর পর্যন্ত নজর যায়।
পথেই লাঞ্চ সারা হল। এ বার গন্তব্য কুলডিহা ফরেস্ট রেঞ্জের ঋষিয়া জলাধার। ঘণ্টাখানেকের পথ। বড় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ঢোকার পর সেই লাল রাস্তা, আর ঘন সবুজ বন। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পরে বনপথ শেষ হল। সামনে বড় মাঠ। আর গাড়ি যাওয়ার অনুমতি নেই। ফের ভরসা হাঁটাপথ। প্রায় ৫০০ মিটার। কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ল আদিগন্ত জলরাশি। বিভিন্ন ঝরনার জল এনে এখানে জমা হয়। চার দিকে পাহাড়ের মেলা। যত দূর চোখ চলে যায়, দেখি একের পর এক ধাপে ধাপে নেমে এসেছে পাহাড়ের দল। বেলা পড়ে আসছে। চার দিকে কেমন নীলচে আভা। নীল মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি চলছে সূর্যের। রঙের খেলা চলল আরও কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে ড্যামের জলে কে যেন লাল আবির ছড়িয়ে দিল। তার মধ্যে জাল বিছিয়ে এগিয়ে চলেছে ডিঙি নৌকো। দাঁড়ের ছোঁয়ায় টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে জলছবি। মনে হচ্ছে শত শত পলাশকুচি ছড়ানো জলাধারের জলে। বেলাশেষে ফেরার পালা। গাড়ি করে শরীর ফিরল বটে। কিন্তু মন ফিরল কই?