ছোট্ট মোহর স্কুলে যাওয়ার সময়ে এখনও নিজের জুতোর দড়ি বাঁধতে পারে না। মায়ের জন্য বসে থাকতে হয়। স্কুলের গাড়ি এসে হর্ন দিয়ে যায়। ওর একদম ভাল লাগে না। কিন্তু উপায়ও যে নেই। তার জুতোর দড়ি বেঁধে দেবে কে? এই রকম ছোট ছোট অনেক সমস্যাই ওদের ঘিরে থাকে। নিজের সন্তানকে বাড়তে দিন— শুধু বয়সে নয়, বুদ্ধিতেও। ওর সব কাজ করে দিলে ও আত্মনির্ভর হবে কী করে? অল্প অল্প করে ওকেও দায়িত্ব দিতে হবে যে!
উৎসাহ দিন
বাড়ির খুদেটি যদি নিজে থেকে কিছু করতে চায়, ওকে করতে দিন। শুধু মা-বাবাই নয়, দাদু-ঠাকুমার অন্ধ ভালবাসাও কিন্তু ওর আত্মনির্ভরতার পথে অন্তরায় হতে পারে। ওকে ছোট ছোট কাজে উৎসাহ দিন। হতে পারে ও আপনার মতো নিখুঁত ভাবে কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেনি। তবুও তার কাজের প্রশংসা করুন। তবেই সে উৎসাহ পাবে।
ভুল থেকেই শিক্ষা
সব মা-বাবাই আত্মজের প্রতি সতর্ক হন। তার জামা পরানো, ব্যাগ গোছানো, জুতোর দড়ি বেঁধে দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজই করে দেন। এই সব কাজ ওর উপরেই ছেড়ে দিন। আপনি শিখিয়ে দিতে পারেন। যেমন, জুতোয় দড়ি বাঁধা দেখিয়ে দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর জুতোর দড়ি ওকেই বাঁধতে দিন। স্কুলের ব্যাগও গুছিয়ে দিতে যাবেন না। প্রথম কয়েক দিন হয়তো ও একটা খাতা বা দুটো বই নিয়ে যেতে ভুলে যাবে। তার জন্য স্কুলে সে বকুনিও খেতে পারে। চুপ করে সেটা মেনে নিন। সেই ভুল থেকেই আপনার সন্তান শিখবে। পরের দিন থেকে আর কিচ্ছু ভুলবে না ও। বরং নিজের ব্যাগ গোছানোর ব্যাপারে বেশি করে সচেতন হবে।
দায়িত্ব দিন
একটু একটু করে ওকেও কিছু দায়িত্ব দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে রাখতে বলুন। বালিশের উপরে বালিশ পরপর সাজিয়ে বিছানা গোছানোর কাজ এমন কিছু কঠিন নয়। স্নান শেষে ওর জামাকাপড় ওকেই ধুতে বলুন। খেতে বসার সময়ে গ্লাসে জল ঢালতে বলতে পারেন। এতে আত্মনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি আপনার নয়নের মণি ধৈর্য ও নিয়মানুবর্তিতাও শিখবে।
নিরাপত্তাও জরুরি
বাচ্চারা সাধারণত নির্ভীক স্বভাবের হয়। ফলে সব কাজেই তারা অকুতোভয় হয়ে এগিয়ে যায়। হয়তো ভিজে মেঝেতেও দৌড়ে খেলতে যায় বা গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না করতেও যেতে পারে। যেখানে সত্যিই ভয় আছে, সেখানে সন্তানের বর্ম হন। কিন্তু ওকে কাজটা করতে দিন। ভিজে মেঝেতে দৌড়লে পড়ে ব্যথা পেতে পারে, তা বোঝান। সে রান্না করতে চাইলে নিজে আগুন জ্বালিয়ে দিন। আবার গ্যাসের ব্যবহারবিধি সঠিক ভাবে শিখিয়ে দিতে পারেন। যাতে সে নিজে গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না করলেও বিপদ না ঘটে। সন্তানের কাজে বাধা না দিয়ে বরং তার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করুন।
অচেনা জগতেও বিচরণ
এখনকার যুগে সকলেরই ছোট পরিবার। মা, বাবা আর দাদু-ঠাকুমা। এই ছোট পরিবেশেই খুদে সদস্য নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিছু বাচ্চা অপরিচিত কাউকে দেখলে গুটিয়ে যায়। ঝট করে অন্য বাচ্চার সঙ্গেও মিশতে পারে না। নতুন পরিবেশে গেলে মা-বাবার গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকে। অচেনা-অজানা জগতের প্রতি ওদের মনে ভয় তৈরি হয়। ফলে গুটিয়ে যায়। ছুটিছাটার দিনে সন্তানকে নিয়ে তাই বাড়ির বাইরে বেরোন। খেলার মাঠে আর পাঁচটা বাচ্চার মাঝে তাকে ছেড়ে দিন। প্রথম দু’দিন হয়তো সে দূর থেকে তাদের দেখবে, কিছুতেই খেলতে যাবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গেই সেই জড়তা কেটে যাবে।
একা খেতে দিন
এটা সব বাড়ির সাধারণ সমস্যা। বাচ্চা কিছু খেতে চায় না। ফলে খাবারের থালা ধরে টিভি বা মোবাইল দেখিয়ে তাকে গিলিয়ে দিলেই কাজ শেষ। এতে অভ্যেস তো খারাপ হচ্ছেই, একই সঙ্গে খাবারের আনন্দও সে পায় না। বরং ওর মতো করে খেতে দিন। সুন্দর ভাবে খাবার সাজিয়ে দিন। একা খেতে শেখার মাধ্যমেই ওর মধ্যে ভাল-মন্দ নির্বাচনের বোধ তৈরি হবে। ওর ভাল-মন্দের সঙ্গে আপনার পছন্দ তো না-ও মিলতে পারে।
খেলার মাধ্যমে
কিছু খেলার মাধ্যমেও বাড়ির শিশুকে আত্মনির্ভর করে তোলা যায়। যেমন লুকোচুরি। এই খেলায় সে যেমন অজানা-অচেনা জায়গা খুঁজে বার করবে, একই সঙ্গে মা বা বাবাকে দেখতে না পেলেও নিজের দায়িত্বে তাঁদের খুঁজে বার করবে। সাইকেল চালানো, সাঁতার ইত্যাদি খেলাও নিজের উপরে নির্ভরতা বাড়ায়। ব্যালান্স করতে পারাটা
সব মানুষকেই ভীষণ ভাবে উজ্জীবিত করে।
মনে রাখবেন, সন্তান আত্মনির্ভর হতে শিখলে তবেই তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। বাচ্চার বৃদ্ধিতে এই আত্মবিশ্বাস খুব জরুরি। তাই ওর বেড়ে ওঠায় অন্তরায় না হয়ে বরং ওর অবলম্বন হয়ে উঠুন।
নবনীতা দত্ত
মডেল: রাইমা; ছবি: অমিত দাস মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত
লোকেশন: লাহাবাড়ি