Alipore Museum

স্বাধীনতা এবং সচেতনতা

প্রাচীন আলিপুর জেলের কথা ভাবলে এক শ্বাসরোধী কষ্ট গ্রাস করে। কত দীর্ঘশ্বাস, কত শোকের সাক্ষী ওই দেওয়ালগুলি। প্রবেশ করলে মনে হয় যেন তার আনাচ-কানাচে বিরাজ করেছে বিষণ্ণতা।

Advertisement

শমিতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:০৪
Share:

রূপান্তরিত: আলিপুর জেল মিউজ়িয়ামে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম। ফাইল ছবি।

গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর আলিপুর জেল যখন মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হল, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায়, কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি ‘ফ্রিডম অ্যান্ড অ্যাওয়েকেনিং’ নামে একটি প্রদর্শনী জনসাধারণের সামনে উপস্থাপিত করেছিলেন।

Advertisement

এই প্রদর্শনীটি নানা পর্বে অবিচ্ছিন্ন ভাবে দেখানো হবে এখন। এ দেশের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে এটি তাদের পক্ষ থেকে এক অভিনব উপহার।

এই প্রদর্শনীতে বেশ কিছু অভিজ্ঞ শিল্পীর কাজের সঙ্গে আরও কিছু তরুণ শিল্পীর কাজ‌ও দেখতে পাবেন দর্শক। এঁরা সকলেই স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার সচেতনতা সম্পর্কে নানা কথা তাঁদের ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

যোগেন চৌধুরীর ছবিটির নাম ‘আক্রমণ’। ছবিটিতে একটি মানুষ ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। তার পিঠের উপরে চড়াও হয়ে গাধা জাতীয় একটি জন্তু তাকে আক্রমণ করতে চাইছে। শিল্পী যেন বলতে চেয়েছেন, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও দেশের মানুষ বিভ্রান্ত। প্রগতিশীল মানুষ এবং তার মানবিকতা আজ বিপর্যস্ত, কারণ মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা মানুষের‌ই পশুপ্রবৃত্তির কাছে পরাস্ত।

শিল্পী শুভাপ্রসন্ন একটি প্যাঁচার ছবি এঁকেছেন। সাধারণত জ্ঞানী অর্থে এই পাখিটির রূপক ব্যবহার করা হয়। হিন্দুশাস্ত্রে প্যাঁচা লক্ষ্মীর বাহন। প্রাচীন গ্রিসে প্যাঁচাকে পাণ্ডিত্যের দেবী বলে মনে করা হত। সে ছিল জ্ঞানের প্রতীক। শুভাপ্রসন্ন হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, আমাদের জ্ঞানের আলো জ্বালাতে হবে। মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। প্রকৃত স্বাধীনতা আনতে গেলে সচেতনতার প্রয়োজন।

শিপ্রা ভট্টাচার্যের ছবিতে আমরা দেখতে পাই, অন্তরে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা। চিরকালীন এই ভারতমাতার মূর্তি স্বাধীনতা প্রার্থী। আর তাঁকে ঘিরে আছে বাড়ি-ঘর, নদী, আকাশ। আর সে সবেরও চারদিকে আছে দেশের সাধারণ মানুষ। তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের নানা অভিজ্ঞতার গল্প— দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের এবং পরের। শিপ্রার প্রাণের শহর কলকাতা আর সেখানে গঙ্গাবক্ষে একটি কুমিরকে দেখানো হয়েছে। কুমিরটি যেন গ্রাস করতে আসছে এই স্বাধীনতা। কিন্তু সেখানে মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর আশীর্বাদের হাত তাকে প্রশমিত করে রেখেছে। কারণ ৭৫ বছর পরেও সেই স্বপ্নের স্বাধীনতা আসেনি বলেই শিল্পীর বিশ্বাস।

ইন্দ্রপ্রমিত রায়ের কাজটির নাম ‘ওয়র্ক ইন প্রোগ্রেস’। শিল্পী বলছেন যে, দেশ স্বাধীন করার জন্য যে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, জীবনের সমস্ত কিছু ত্যাগ করেছিলেন, যে স্বাধীনতা আমাদের পূর্বসূরিদের কল্পনায় ছিল, সে তো এখনও আমরা পূর্ণাবস্থায় দেখছি না। অনেক উন্নতি হয়েছে দেশের, অনেক কাজকর্ম‌ই হচ্ছে, তবু তো এ দেশের অর্থবৈষম্য দূর হয়নি। বর্ণবৈষম্য এখনও আছে। নারীকে সেই সম্মানের জায়গা আমরা দিতে শিখিনি। কাজেই স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার পূর্ণতা কি প্রাপ্ত হয়েছে? এই কাজটা আমাদের এখনও চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর ছবিতে দেখি, জেলখানার দেওয়াল এবং একটি দরজা। সে দরজা হতাশায় ভারাক্রান্ত। অথচ বাইরের কাঠামোটি খুব জমকালো। সেখানে রাজমিস্ত্রিদের ভারা বাঁধা আছে। কাজ চলছে— ‘ওয়র্ক ইন প্রোগ্ৰেস’।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য ‘ভারতমাতা’ ছবিটির একটি প্রিন্ট এখানে দেখতে পাই। বহু যুগ আগে করা ওই ছবিটিতে অবন ঠাকুর এক গেরুয়া বস্ত্র পরিহিতা দেশমাতাকে আঁকেন। তাঁর চার হাত, কারণ তাঁকে দেবী অঙ্গেই দেখেছেন। একহাতে ধান, দ্বিতীয় হাতে পুঁথি, তৃতীয় হাতে বস্ত্র এবং চতুর্থ হাতে মালা। মাথার চারপাশে আলোর রশ্মি। এই দেবী মূর্তি সে যুগে ভগিনী নিবেদিতাকে মুগ্ধ করেছিল। এ ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও সেই মূর্তি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সে যুগে সৃষ্ট ভারতমাতার এই চিত্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক বলেই মানা হয়। অবন ঠাকুর ছাড়াও নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ, সোমনাথ হোর প্রমুখ শিল্পী স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বাংলায় দেশজ শিল্প সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া ‘প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্ট’স গ্রুপ’ মুম্বইয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে এম এফ হুসেন এবং সুজার নাম করা যায়। দিল্লির ‘শিল্প চক্র’ এবং তৎকালীন মাদ্রাজের ‘প্রোগ্রেসিভ পেন্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’ আধুনিক ভারতীয় শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করেছে।

প্রাচীন আলিপুর জেলের কথা ভাবলে এক শ্বাসরোধী কষ্ট গ্রাস করে। কত দীর্ঘশ্বাস, কত শোকের সাক্ষী ওই দেওয়ালগুলি। প্রবেশ করলে মনে হয় যেন তার আনাচ-কানাচে বিরাজ করেছে বিষণ্ণতা। কিন্তু জেল মিউজিয়াম থেকে বেরোলে মন অনেকটাই হালকা লাগে। নানা প্রজন্মের বহুবিধ চারুশিল্পে ভরে উঠছে এই মিউজিয়াম। যেন আনন্দের মেলা বসেছে জায়গাটিতে। এই ধরনের প্রচেষ্টায় আলিপুর জেল হয়তো অদূর ভবিষ্যতে শিল্পকলার এক অন্যতম পীঠস্থান হয়ে উঠবে, এমন আশা করাই যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement