ছবি: সমর দাস
মাঝপথে ভেস্তেই যেতে বসেছিল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’।
শেষে ছবির পরিচালক বিকাশ রায়কে কিনা বাঁচিয়ে দিল চারটে বাংলা মদের বোতল!
চাকুলিয়ায় শ্যুটিং সেরে, ঘাটশিলায় দু’দিন। তার পর দিঘায়। গোল বাঁধল ওই দিঘাতেই।
শহর থেকে অনেক দূরে লোকেশন। সেখানেই বালিয়াড়ির ওপর ক্যামেরা ধরবে ‘বালুচিস্তানের হিংলাজের মরুভূমি’।
এক জোড়া উট উঠিয়ে আনা হয়েছে বেনারস থেকে হাঁটা পথে। উট নাকি ট্রাক বা মালগাড়িতে উঠলে ছটফটিয়ে কেলেঙ্কারি বাধায়, তাই।
লোকেশনের ধারেই বালিয়াড়িতে উটের ডেরা বাঁধা হল। তাদের দুই কিপার কুল্লন খান আর আব্বাস ওদের সঙ্গেই থাকে দিনরাত। শুধু আর্টিস্টরা যাতায়াত করে দূরের হোটেল থেকে।
দু’চার দিন ভালই গেল। হঠাৎ এক সন্ধেয় কালো মেঘ করে প্রবল বৃষ্টি। সঙ্গে তুমুল ঝড়।
হোটেল থেকে যে গাড়ি করে কুল্লনদের খাবার যেত, ঝড়ের তোড়ে তা’ও ভেসে যেত আর কী! হোটেলে বসে পরিচালক খবর পেলেন, তেরপলের ছাউনি উড়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের অসময়ের ঝড়জলে হি হি ঠান্ডায় ভিজে চুপসে যাচ্ছে দুই কিপার আর তাদের জোড়া উট।
রাতটা ঘর-বার করে কাটল। সাতসকালে স্পটে গিয়ে দেখা গেল, উটের দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। ভাল করে শ্বাস নিতেও পারছে না। শোঁ শোঁ করে আওয়াজ শুধু। চোখ দিয়ে জল ঝরছে। নাক দিয়ে গাঢ় শ্লেষ্মা।
তার মধ্যেই ওদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে কুল্লন। তাতে আরও কাহিল হয়ে পড়ছে ওরা। আর বেশি কিছু করতে গেলে না মারাই যায়!
চুল-দাড়ি লাগিয়ে খালি গায়ে অবধূতের মেকআপ নিয়ে একেবারে ভাঙা মনে এক পাশে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন বিকাশ।
এত অর্থ, এত শ্রম, সময়, সব জলে গেল! দ্বিতীয় বার এমন ঝক্কি পোওয়ানোর কোনও উপায়ই নেই।
দূরে মাথায় হাত দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর্টিস্টরা— পাহাড়ী সান্যাল, উত্তমকুমার, চন্দ্রাবতী দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়...।
শ্যুটিংয়ের কোনও আশা নেই। পুরো হাল ছেড়ে দিয়ে সবাইকে হোটেলে ফিরে যেতে বললেন বিকাশ।
ঠিক তখনই শুরু হল কুল্লনের ভেল্কি!— ‘‘আমি দাওয়াই দিচ্ছি, সব ভাল হয়ে যাবে। ক’টা টাকা দিন তো!’’
টাকা পেয়ে স্যাঙাত আব্বাসকে কী যেন বলল কুল্লন! আব্বাস হাঁটা দিল গ্রামের দিকে।
বসে বসে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন বিকাশ। হঠাৎ হইহই চিৎকারে চটকা ভাঙতে দেখেন দুটো বাংলা মদের বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরও দুটো বোতল উটের মুখে ধরে আছে আব্বাস আর কুল্লন! একটু বাদেই টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল সেই জোড়া উট।
বেঁচে গেল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’!
•
মদ্যপ পশুপাখি নিয়ে বিকাশের আরও গল্প আছে, এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই। তার আরেকটি যেমন অভিনেতা নৃপতি চাটুজ্জের পোষা কুকুর আর মোরগটিকে ঘিরে।
রাস্তার কুকুরকে বাড়িতে এনে রেখেছিলেন নৃপতি। তার হার্ট নাকি এতই দুর্বল ছিল যে, বেশি চেঁচামেচি করলে ভিরমি খেত। তখন তাকে ‘রাম’ খাইয়ে হুঁশ ফেরাতে হত।
মোরগটি আরও সরেশ। কেটে খাওয়ার জন্য বাজার থেকে এনেছিলেন। কাটা হয়নি। বদলে পুষেছিলেন। পোষ্যটিকে মদের নেশা ধরিয়েছিলেন খোদ মালিকই। সে নেশা এমন পেকেছিল যে, সময়মতো মদ না পেলে রেগেমেগে যাকে তাকে ঠুকরে দিত ‘মদ্যপায়ী’ মোরগ।
ইডেনে উত্তমকুমার, অসিত সেন, শ্যামল মিত্রর পাশে
•
বিকাশ রায়ের অভিনয় জীবনে এমন অদ্ভুতুড়ে গল্প অফুরন্ত।
ছবি বিশ্বাসকে দিয়ে শুরু করা যাক। ছবির নাম ‘সূর্যমুখী’। পরিচালক বিকাশ নিজে। শ্যুটিংয়ে একদিন ছবি বিশ্বাসকে আসতে বলা হল বিকেল তিনটেয়। সূর্যের আলোয় খানকতক শট আছে। তার পর ঘরের ভেতরে।
এ দিকে সন্ধে নেমে এল প্রায়। ছবি বিশ্বাসের দেখা নেই। প্রোডাকশন ম্যানেজারকে পাঠানো হল। তারও ফেরার নাম নেই। বিকাশ রায় রেগে কাঁই। ম্যানেজারের ডেপুটি গেল। সে’ও ফেরে না।
ব্যাপার কী?
অনেক দেরি করে এলেন ছবি বিশ্বাস। তাড়াহুড়ো করে শটও দিলেন। পারফেক্ট শট! আর শেষে দেরির কারণটি যা বললেন, শুনে তাজ্জব বিকাশ।
পরদিন ছিল দোল। বেরোবার সময় ছবি বিশ্বাস দেখেন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দোলের তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন স্ত্রী। থালায় আবির চুড়ো করে দেওয়া। কিন্তু তাতেও যেন ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগছে। তখনই সেই প্রোডাকশন ম্যানেজারমশাই হাজির। তাঁকে দিয়েই অ্যালুমিনিয়ামের রঙিন ফয়েল কিনতে পাঠালেন ছবি বিশ্বাস। একটু বাদে এসে পড়লেন ম্যানেজারের ডেপুটিও। ফয়েল এলে সবাই মিলে কাঁচি দিয়ে তারার মতো কেটে কেটে বসিয়ে তবে রওনা দিয়েছেন কাজে। মেয়ের তত্ত্ব বলে কথা, এটুকু না করলে চলে!
ছায়াদেবী। এক বার শ্যুটিং জোনে তাঁকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বহুক্ষণ বাদে যেন আকাশ থেকে কেউ ডেকে উঠলেন, ‘‘এই যে আমি-ই-ই!’’
বিকাশ দেখলেন, ক্রেনে চড়ে বসে আছেন ছায়াদেবী।—‘‘চড়ে দেখলাম, ওখান থেকে আপনাদের দেখতে কেমন লাগে!’’
যে জন্য ক্যামেরাম্যান অনিল গুপ্তকে পাঁচ টাকা ঘুষ দিয়ে নাকি ম্যানেজ করেছিলেন তিনি!
চন্দ্রাবতী দেবী। খুব সাজতে ভালবাসতেন। এ নিয়েই একবার গোল বাধল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এই।
চাই তাঁর নো-মেকআপ লুক। এ দিকে একবার বিকাশের নজর এড়াতে পারলেই হল, হাল্কা বেসের ওপর
ঠিক পাউডার বুলিয়ে চলে আসবেন। প্রতিবার সেটে মেকআপ তুলে প্যারাফিন লাগাতে হতো। তাতে উৎপটাং সময় বেরিয়ে যেত।
একদিন বিরক্ত হয়ে বিকাশ বললেন, ‘‘রোজ রোজ সবার সামনে কচি মেয়ের মতো ধমক দিয়ে মেকআপ তুলিয়ে দিতে হয়, আপনার মনে হয় না যে, আর কখনও করবেন না?’’
বালিকার সারল্যমাখা মুখে হেসে চন্দ্রাবতী বলেছিলেন, ‘‘বারে, মেকআপ না করলে যে শ্যুটিং করছি মনেই হবে না। কত দিনকার অভ্যেস বলুন তো! আমি রোজ একটুআধটু মেকআপ করেই আসব, আপনিও রোজ সেগুলো তুলে দেবেন।’’
পরের গল্পটি ঠিক এমন সরস নয়, বরং তার গায়ে যেন কোমল রাগের লুটোপুটি।
শখ চাপল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে মূলে রেখে ছবি করবেন বিকাশ। ‘বসন্ত বাহার’। সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ডাকলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষকে। খুব ইচ্ছে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলির ‘আয়ে ন বালম্’ গানটি ব্যবহার করবেন। জ্ঞানপ্রকাশ অনেক বলেকয়ে রাজি করালেন খানসাহেবকে।
টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োয় সাতসকালে রেকর্ড করতে এলেন বড়ে গোলাম। তখনকার দিনের স্টুডিয়ো আজকের মতো নয়। এখন যেমন বাইরের শব্দ ভেতরে না আসে, তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে, সে কালে তেমন ছিল না।
আওয়াজ রুখতে একটাই উপায়, স্টুডিয়োর দরজা বন্ধ রাখা। জ্ঞানপ্রকাশ এসেছেন। অন্য কলাকুশলীরাও। সবাই খান সাহেবের রেকর্ডিং দেখবেন।
হঠাৎ বড়ে গোলাম বেঁকে বসলেন। বন্ধ ঘরে এই সাতসকালে তাঁর মেজাজ আসবে না। দরজা খুলে দিতে হবে।
বাবুরাম ঘোষ রোড, চণ্ডী ঘোষ রোডে তখন অত গাড়িঘোড়া চলত না বটে, কিন্তু একেবারে জনশূন্য তো নয়। ফলে চারদিকে লোক পাঠানো হল, যারা এ পথে কিছু সময় যান চলাচল রুখে দেবে।
খানসাহেব গাইলেন। অভিভূত সবাই। শুধু বিকাশের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার জোগাড়! গানের মেজাজটি যে ছবির সঙ্গে একেবারেই যায় না! এখন কী করা?
ততক্ষণে ছবির গানের রেকর্ডিং করতে বসে পায়ে পায়ে বেড়াজালে আক্রান্ত, বিরক্ত খানসাহেব বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়েছেন! তাঁকে আবার গাইতে বলা কার সাধ্যি?
তার ওপর রাতে তাঁর গান আছে কনফারেন্সে। ফিরে একপ্রস্ত বিশ্রাম নিতে হবে। তবু বিকাশকে যে বলতে হবেই! কাছে গিয়ে প্রণাম করে খান সাহেবের পায়ের কাছে বসলেন তিনি।
—কেমন হল গান?
—আপনার গানের কি তুলনা আছে, বাবা! তবে গল্পটা শোনাই।
আবেগে গলা চুবিয়ে বিকাশ গল্প শোনালেন ‘বসন্ত বাহার’-এর। শুনতে শুনতে চোখ ছাপিয়ে জল উথলে উঠল ওস্তাদের। শেষে বললেন, ‘‘এ গল্প আমায় আগে শোনাওনি কেন? নাও আবার রেকর্ড করো। কিছুই গাওয়া হয়নি।’’
সুরমণ্ডলের তারে হাত চালিয়ে চোখ বুজলেন উস্তাদ। এ বার গলায় যে হাহাকার ছেয়ে গেল, তাতে মুহূর্তে যেন চাঁদে ধোওয়া আকাশের মায়া! নির্জন পুকুরঘাটের ধু ধু হাওয়া। আশপাশের সবাইকে কান্নায় ডুবিয়ে থামলেন গোলাম!
•
‘‘তুমি গান শেখো, তোমার হইব।’’
বলেছিলেন খোদ শচীনকর্তা। কর্তা তখনও ‘এসডি’ হননি। অল্প কয়েকটি রেকর্ড বেরিয়েছে। তাতে যতটুকু যা নাম হয়েছে। ত্রিপুরা ছেড়ে চলে এসেছেন কলকাতায়। বাসা বেঁধেছেন এখানেই।
সে সময় সপ্তাহে দু’বার করে কর্তা আসতেন বিকাশদের বাড়ি। ওঁর বৌদিকে গান শেখাতে। আর বাড়ি ঢুকেই রোজ শুনতেন গান গাইছেন বিকাশ। বিকাশ লিখেছেন, ‘‘নেপথ্যে থেকে আমি কর্তাকে ইমপ্রেস করতে চাইতাম কি না!’’
সুরের লেশমাত্র নেই। বাজখাঁই গলার অমন গান শুনে কর্তা বিরক্ত হয়ে একদিন অমন মন্তব্য করে বসলেন। কাছেই ছিলেন পাহাড়ী সান্যাল। শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সর্বনাশ, বলছ কী কর্তা, ওর গলায় কি সুর আছে, যে গাইবে?’’
শুনে কর্তা হেসে বলেছিলেন, ‘‘সুর একটু কম আছে সত্যি, কিন্তু কী রকম দরদ আছে দেখেছ?’’
অমন ‘দরদি’ গলা কী যে বিপদে ফেলেছে সারাটা জীবন, তার খান-কয়েক কাহিনি আছে বিকাশের।
প্রথম ছবি ‘অভিযাত্রী’। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান রেকর্ড করা হল। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’।
রেকর্ডে গাইলেন হেমন্তের সঙ্গে বিনতা বসু (রায়)। ছবিতে বিকাশ আর বিনতা লিপ দেবেন।
হেমন্ত ধরিয়ে দিলেন, ‘আগুন জ্বালো...’। প্রথমটা বিকাশ ধরবার পর বিনতা ধরবেন। সে ধরা আর হয় কই! উল্টে ঘেমে নেয়ে একশা!
বিকাশ লিখছেন—
‘‘‘ভয় কি বিকাশবাবু, এই তো দেখুন না, এক... দুই... আগুন জ্বালো...।’
আমি ক্রমশ ক্রমশ লাল নীল বেগ্নে হচ্ছি...কিন্তু আগুন আর জ্বলছে না। কোনও বার এক-এ আগুন জ্বলে, তো কোনও বার দুই-এ। কিন্তু এক দুই-এর ঠিক পরেই কোনও সময় আগুন জ্বলে না। সে যুগে ফিল্মের ভয়ানক দাম, ব্ল্যাক মার্কেটে কিনতে হয়, সেই ফিল্ম হুড়মুড় করে নষ্ট হচ্ছে, সময় নষ্ট, অথচ...।’’
শেষে মিলেছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে ধরিত্রী বোধহয় বিকাশের লজ্জাকে ঢাকা দিতে দু’খান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর পায়ের কাছে।
এই লিপ দেওয়া নিয়ে বিপদে পড়েছেন বারবার। কিন্তু কী অদ্ভুত, পরে নিজেকেই ‘ঠাট্টা’ করে এ নিয়ে কষিয়ে লিখেওছেন ফলাও করে!
•
‘লিপ’ দেওয়া নিয়ে যেমন নিজেকে ‘ঠাট্টা’ করেছেন, তেমনই করেছেন প্রেমে পড়া নিয়ে।
পুজোর ছুটিতে দেওঘরে গিয়ে যখন প্রথম প্রেমে পড়েন, তখন সবে কলেজে। সে অবশ্য বেশি দিনের নয়, কিন্তু একেবারে শেষ বেলাতে এসেও যে তার উত্তাপ ছিল, টের পাওয়া যায় লেখায়— ‘‘এক দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, পরস্পর পরস্পরের বুকের শব্দ শুনেছিলাম। মনে পড়ে সারা দিন রাত কী এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকতাম।’’
এতে অবশ্য রসিকতা নেই। রসিকতা যত, সব বড় বয়সের প্রেম নিয়ে। নিজেই বলেছেন, ‘‘ফিল্মে নামার আগে দু’চার বার, পরে যে কত বার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ব্যাপারটি সব সময় ছিল বোধ হয় একপক্ষীয়। অর্থাৎ আমিই প্রেমে পড়তাম, হাবুডুবু খেতাম আবার ভেসে উঠতাম, অন্য পক্ষকে বলা হয়ে উঠত না, আর বলবই বা কী করে? বলবার উয্যুগ করলেই তো বিপদ ঘটে যেত।’’
তেমনই এক জবরদস্ত ‘বিপদ’-এর গল্প আছে অনুভা গুপ্ত আর মঞ্জু দে-কে নিয়ে। দু’জনেরই রীতিমতো প্রেমে পড়েছিলেন বিকাশ।
তখন ‘রত্নদীপ’ সবে হিট করেছে। পরিচালক দেবকী বসু তাই রাধা ফিল্মস্-এ এলাহি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। স্টুডিয়োয় গিয়ে ইতিউতি ঘুরছেন বিকাশ। তখনই কাণ্ড ঘটালেন দুই নায়িকা। হঠাৎ দু’জনেই বলে বসলেন, ‘‘আসুন বিকাশবাবু, চু কিৎকিৎ খেলি।’’
বিকাশ লিখেছেন, ‘‘বাহাদুরি দেখাতেই রাজি হয়ে গেলাম। ...প্রসঙ্গত বলে রাখি, অনুভা ছেলেবেলায় মেয়েদের ব্যান্ড লিডার ছিলেন। ইয়া ঢাউস ড্রাম বুকের ওপর রেখে দড়াম দড়াম করে বাজিয়ে মার্চ করে যেতেন, আর মঞ্জু তাঁর ছেলেবেলায় ঘোড়ায় চড়ে কোন মহিলা সেবাদলের অগ্রণী হয়ে মার্চ পাস্ট-এ যোগ দিতেন।... প্রথম খেপেই চু-উ-উ বলে দৌড়ে এসে মায়াকে ‘মোর’ করে অনুভা তাঁদের কোর্টে ফিরে গেলেন। তার পর আমি গেলাম ওঁদের কোর্টে। অনুভাকে ‘মোর’ করে ফিরে আসছি, পিছন থেকে উনি মারলেন ল্যাং। আমি তো ছিটকে পড়লাম, মঞ্জু দৌড়ে এসে বসলেন আমার বুকের ওপর, অনুভা বসলেন পা দুটোর ওপর। আর তার পর হি হি করে দু’জনের কী বিজয়িনীর হাসি! আমি তো গেলুম, মলুম বলে চেঁচাচ্ছি— শেষে মিলিদি এসে মহিলা দুটিকে ধমক দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ থেকে নামালেন— আমার প্রেমও ঘুচে গেল।’’
প্রেমজীবনে বিব্রত হয়েছেন। বিয়ে করতে গিয়েও ঝঞ্ঝাট কম হয়নি!
প্রথম বার বিয়ের ঠিক হল। বিয়ের দিন পনেরো আগে পাত্রীর বাবা বললেন, ‘‘টাকাকড়ি কিছু নেই। বিয়ে এক বছর পিছিয়ে দাও।’’
বিকাশের বাবা বললেন, ‘‘টাকাকড়ির তো কোনও প্রয়োজন নেই। আমার তো কোনও চাহিদা নেই। আপনিই বলেছিলেন মেয়ে জামাইকে দেবেন। নাইবা দিলেন। আর বরযাত্রী ইত্যাদি যদি না নিয়ে যাই, তা’হলে তো কোনও খরচ নেই।’
ভদ্রলোকের তাতেও এক কথা।
বিয়ে ভাঙল। আবার নতুন পাত্রীর খোঁজ। পাত্রী পাওয়াও গেল।
দিনক্ষণ ঠিক হল। চিঠি বিলি শুরু হল। তখনই এল ভাঙচি। দু’পক্ষেই।
ফলে আবার ভাঙন। এ বার খেপেটেপে বিকাশ তাঁর দিদিকে বললেন, ‘‘২০ জানুয়ারি বিয়ে। দেবে তো ভাল। নইলে চলে যাব বাড়ি ছেড়ে।’’
সাত দিন মাত্র বাকি বিয়ের তারিখের। এ দিকে একমাত্র ছেলে যদি বাড়িছাড়া হয়, বাবা সইবেন কী করে!
এক পারিবারিক বন্ধু বেরোলেন পাত্রীর খোঁজে। পাত্রী পাওয়া গেল এক অদ্ভুত উপায়ে।
মেয়েটির বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল এক বিপত্নীক ভদ্রলোকের সঙ্গে। অনেক টাকাকড়ির মালিক। নিঃসন্তান। ভাবী স্ত্রীর জন্য এক কাঁড়ি গয়নাও কিনে ফেলেছিলেন তিনি।
হঠাৎ কী খেয়াল হল, ভাবী স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন সিনেমা দেখতে। শান্তারামের ছবি, ‘দুনিয়া না মানে’। এক বিপত্নীক ভদ্রলোক অল্পবয়সি মেয়েকে বিয়ে করে কী দুর্ভোগে পড়েছিলেন, তাই নিয়েই কাহিনি। ব্যস, দেখে ভদ্রলোকের বুক শুকিয়ে গেল। ভাবী বৌয়ের গয়নাগাঁটি, কাপড়চোপড় রেখে বলা নেই কওয়া নেই, সোজা ধাঁ।
তখনই হঠাৎ যোগাযোগ দুই পক্ষের। এই বিয়ে-ভাঙা পাত্রীই ঘটনাচক্রে হয়ে গেলেন বিকাশ-ঘরণি।
•
‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, তুমি অভাগারে চেয়েছ’। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একের পর এক নাটক দেখে এ কথাগুলোই বলতেন বিকাশ।
কী না করেছেন! জজকোর্টে আইনি, এরোড্রোমে ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে হেডক্লার্ক, বিজ্ঞাপনে চাকরি, সেখান থেকে আকাশবাণী!
সে’ও এক সময় পোষাচ্ছিল না, তখন সিনিয়র সহকর্মী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরামর্শে গিয়েছিলেন সে কালের মস্ত বড় প্রযোজক পরিবেশক সংস্থা ডিল্যুক্স-এর ঘরে।
সেখান থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এমপি প্রোডাকশনের এক চিত্র পরিচালকের কাছে। ভদ্রলোকের ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে মুখের ওপর জবাব দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
সেটাই ছিল প্রথম আর শেষ বারের মতো সুপারিশ নিয়ে ফিল্মে নামার চেষ্টা।
সে বারের মতো ফিল্ম-এ নামা হল না, উপরন্তু রেডিয়োর বড় কর্তার সঙ্গে মতবিরোধে চাকরিটাও ছাড়তে হল। এ দিকে তত দিনে সংসারের চাপ বাড়ছে। বাড়িতে ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বুড়ো বাবা।
এমনই সময় হঠাৎই এক দিন ট্রামে দেখা রেডিয়ো-বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে। পরে যাঁর ‘উদয়ের পথে’র কাহিনি নিয়ে ছবি করবেন বিমল রায়। সে দিন জ্যোতির্ময়ই খবর দিলেন উনি একটি ছবি প্রযোজনা করছেন। নায়কের পার্ট বিকাশকে করতে হবে। এক হাজার টাকা দিয়ে চুক্তিও হয়ে গেল। ছবিতে শেষমেশ নায়ক হওয়া আর হয়নি। চার নম্বর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিকাশ।
অভিনয়-জীবনটা ওঁর পুরোটাই গল্প আর গল্প। তার মধ্যে একটি-দুটি না বললে বোধ হয় অভিনেতা-মানুষটির অভিনয়ে বিলীন হয়ে যাওয়া ধাঁচাটা যেন অধরাই থেকে যায়।
‘শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনাথ ও অন্নদাদিদি’ যেমন। শিউরে ওঠার মতো নেপথ্য-কাহিনি। বিকাশ সেখানে সাপুড়ে শাহজি। একটি দৃশ্যে শাহজিকে কামড় দেবে সাপ, আর শাহজি তার গলা টিপে পা দিয়ে চেপে টেনে মেরে ফেলবে। বিকাশ কিছুতেই করতে চাইছিলেন না। পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্যও কিছুতেই ছাড়বেন না।
শেষে রফা হল। শটের সময় সাপের মুখটা সেলাই করা থাকবে।
ক্যামেরা চলল। সাপও হিলহিলিয়ে ফণা তুলে ফোঁস করে উঠল। আর তখনই বিকাশ খেয়াল করলেন, কোথায় সেলাই! লকলকে জিভ নিয়ে দুলে দুলে এগিয়ে আসছে কেউটে! তবু মরিয়া হয়ে শট দিয়ে গিয়েছিলেন বিকাশ।
’৪২। মেজর ত্রিবেদী হলেন বিকাশ। অত্যাচারী মেজরকে জনতা মাড়িয়ে চলে যাবে। ক্যামেরার ক্লোজ শটে ধরা হবে তাই-ই।
হয়েও ছিল তেমনই। জনা তিরিশেক মানুষ পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল ত্রিবেদী-রূপী বিকাশকে। যন্ত্রণায় ফুলে গাল দুটি ঢোল হয়ে গিয়েছিল। বহু দিন তরল ছাড়া কোনও খাবার মুখে তুলতে পারেননি।
এই যার অভিনয়ের গুণপনা তিনি তাঁর অভিনয়-ঐতিহ্য নিয়ে যে সব গল্প শুনিয়েছেন, সে’ও কম জ্বালাময়ী নয়! বাবার এক কালে অভিনয়ে ঝোঁক ছিল। জ্যাঠামশাইয়েরও। তাঁদের উড়নচণ্ডী পিতৃদেব চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সংসারকে ভাসিয়ে দিয়ে যখন মারা যান, দুই ছেলের আশ্রয় হয় তাঁদের এক দিদির বাড়ি। সেখানে অত্যাচারের ঠেলায় পালিয়ে যান বিকাশের জ্যাঠামশাই। তখন নাকি তিনি পেট চালাতে যাত্রার সখীও সাজতেন!
এ তো তাও এক রকম। ঠাকুমার কাছ থেকে শোনা কাহিনিটি আকাশ-প্রমাণ বিস্ময়ের!
ওঁর প্রপিতামহর এক আধপাগল নানা ভাষাবিদ পণ্ডিত ভাই ছিল। তিনি নাকি দাদার জমিদারি বাড়াতে জাল নবাব সেজে বসেছিলেন!
সে কেমন?
একটি ছোট জমিদারি হাতিয়েছেন প্রপিতামহ। তা পাকা করতে এক নবাবের হাতের ছাপও জাল করেছেন। এ বার অন্য দাবিদার তো নালিশ ঠুকে দিলেন।
তাতে সেই ভাই করলেন কী, ইস্ট ইন্ডিয়ার কর্তাব্যক্তিদের সামনে মৃত নবাবের হাবভাব, চালচলন সব নকল করে নবাব সেজে বসলেন!
বিকাশ লিখছেন, ‘‘এইটুকু যদি বংশপরম্পরায় আমার মধ্যে অভিনেতার রূপ নিয়ে থাকে, তা’হলে বলার কিছু নেই।’’
জীবনরসিক না হলে এমন কথা কে আর কয়!
তথ্যসূত্র: কিছু স্মৃতি কিছু কথা (বিকাশ রায়)