সুর-সাম্রাজ্যের তিমিরবরণ

তিনি ভারতীয় অর্কেস্ট্রার প্রাণপুরুষ, উদয়শঙ্করের ‘সহযাত্রী’ — সরোদ শিল্পী তিমিরবরণ ভট্টাচার্য। ঠাকুরদার সেই সুরজগতের সন্ধান দিলেন নাতনি রঞ্জনী সরকার। শুনলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়তিনি ভারতীয় অর্কেস্ট্রার প্রাণপুরুষ, উদয়শঙ্করের ‘সহযাত্রী’ — সরোদ শিল্পী তিমিরবরণ ভট্টাচার্য। ঠাকুরদার সেই সুরজগতের সন্ধান দিলেন নাতনি রঞ্জনী সরকার। শুনলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৯:১০
Share:

কয়েকটা সিনেমার কাজ রয়েছে। শিল্পী ঠিক করলেন স্ত্রী ও ছেলেকে রেখে যাবেন ‘বাবা’র কাছে। ভোরবেলা। পরিবার নিয়ে শিল্পী নামলেন মাইহারে। গেলেন বাবার কাছে। প্রণাম করে শিল্পী বলেন, ‘বাবা, করাচি যাচ্ছি। আপনার বউমা ও নাতিকে এখানেই রেখে যাব।’ শুনেই খেপে গেলেন বাবা। বলেন, ‘আমি তোমার বাপের চাকর নাকি?’

Advertisement

পরিবার নিয়ে স্টেশনে ফিরে গেলেন ওই শিল্পী। খানিক বাদে বাবা শুনলেন, সত্যিই স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে চলে গিয়েছেন সেই শিল্পী। শুনেই ভীষণ উতলা। একান্ত সচিবকে বললেন, ‘যাও বড় ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’ ছেলের বউকে ঘরে স্বাগত জানাতে ততক্ষণে ধানদুব্বো নিয়ে তৈরি হয়ে গেলেন বাবার স্ত্রী।

‘বাবা’ অর্থাৎ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। তাঁর ‘বড় ছেলে’টি তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, আমার ঠাকুরদা।

Advertisement

সুদূর মাইহার থেকে পাকিস্তান, কখনও বা ইউরোপ— ঠাকুরদা সব সময় এ ভাবেই মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। আর সেই ভালবাসার কেন্দ্রে রয়েছে ঠাকুরদার সৃষ্টি, তাঁর জাদু-হাতের সরোদ।

সৃষ্টির সূত্রপাত কিন্তু এই কলকাতায়। বড়বাজারের শিব ঠাকুরের গলি। একফালি রাস্তার ধারে ৩১ নম্বর বাড়িতে তিন পুরষের তন্ত্রসাধক ভট্টাচার্যদের বাস। সেখানেই জন্ম ঠাকুরদার, ১৯০৪-এর ১০ জানুয়ারি। বাবা, জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ঠাকুরদারা তিন ভাই, মিহিরকিরণ, তিমিরবরণ ও শিশিরশোভন।

ভট্টাচার্যবাড়ির মন্ত্রশিষ্য পাথুরিয়াঘাটার রাজবংশীয় ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা। এই বাড়িরই জামাই ধ্রুপদশিল্পী ‘আশুবাবু’। উনি তো আসতেনই বাড়িতে। আনাগোনা ছিল পাখোয়াজশিল্পী নগেন দেব, খেয়ালশিল্পী রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীদেরও। রাধিকাপ্রসাদের কাছেই দিন কয়েক গলার তালিম চলল ঠাকুরদার। দাদা মিহিরকিরণের নিজের সংগ্রহে ছিল, বাঁশি, এসরাজ, বেহালা-সহ নানা বাদ্যযন্ত্র। এমন সাঙ্গীতিক পরিবেশ ঠাকুরদার শিশুমনে বিরাট প্রভাব ফেলে। এতটাই যে, ওরিয়েন্টাল সিভিল স্কুল ও সিটি ট্রেনিং স্কুলে পড়াশোনা করলেও মন প়়ড়ে থাকে সুরের জগতে। খুব অল্প বয়সে বাবা-মা’কে হারিয়েছিলেন ঠাকুরদা। তাঁকে বড় করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দাদা মিহিরকিরণ।

তবে আগামী দিনের সরোদ-শিল্পী তিমিরবরণের হাতে সরোদ উঠেছে বেশ কিছু দিন পরে। ১৪ বছর বয়সে হ্যারিসন রোডের বাসিন্দা, ক্ল্যারিওনেট শিল্পী রাজেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম শুরু। তবে সেখানেও মন বসে না ঠাকুরদার। একদিন একটা ব্যাঞ্জো দেখে গুরুর কাছে ঠাকুরদার আবদার, ‘ওইটেই শিখব আমি।’

ব্যাঞ্জো-শিক্ষাই কিন্তু আগামী দিনের সরোদ শিল্পীর জন্মের পটভূমি তৈরি করে। কী ভাবে? ব্যাঞ্জোটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা সারাই করতে ঠাকুরদা গেলেন চিৎপুর রো়ডে, বিখ্যাত কারিগর গোবর্ধনের কাছে। দেখলেন, গোবর্ধন কী যেন একটা যন্ত্র নিয়ে ‘টুংটাং’ করছেন। কী ওটা! অমন সুন্দর আওয়াজ। ব্যাঞ্জোটি ঠাকুরদার হাত থেকে নিয়ে গোবর্ধন বললেন, ‘বাবু, এ সব খেলনা যন্ত্র কেউ বাজায় নাকি? আপনি বরং সরোদ বাজান!’

সরোদ কী বস্তু? তখনও জানা ছিল না তিমিরবরণের। গোবর্ধনই দেখাল। ষোলো বছরের তিমিরবরণ দাদা মিহিরকিরণকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন দোকানে। দাদাও যন্ত্রটি দেখে অবাক।

অবাক হওয়ার কারণও আছে। কারণ, ঠাকুরদারই কথায়, ১৯২০ সালে ‘সারা ভারতে মাত্র ছ’জন ওই যন্ত্র বাজাতেন। ফিদা হুসেন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল্লা খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, করমতুল্লা খাঁ এবং আমির খাঁ।’

ঠাকুরদার সরোদের প্রতি আবেশের সেই শুরু। দাদার কাছে ফের আবদার, ‘আমি ওই যন্ত্রটিই শিখব।’

কিন্তু কে বানাবে তা? গুরুই বা মিলবে কোথা থেকে? হাল বের করলেন গোবর্ধনই। বললেন, ‘যন্ত্রটি আমারই বানানো, আমির খাঁ সাহেবের জন্য। তিনি থাকেন কাছেই, মেছোবাজারে। আমার কাছে সরোদ বানাতে সুদূর গ্বালিয়র থেকে কলকাতা আসেন হাফিজ আলি খাঁ সাহেবও।’

এই ঘটনার মাস ছয়েক বাদে ঠাকুরদার সরোদ তৈরি হল। বাড়িতে এলেন আমির খাঁ সাহেব।

আমির খাঁ’র শিষ্য তিমিরবরণ সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমে ঠিক হয়, ওস্তাদজি সপ্তাহে দু’দিন সন্ধেবেলা বাড়িতে আসবেন। কিন্তু ক’দিন বাদে শিষ্যের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষমতা দেখে ওস্তাদজি ফি দিন সকাল-বিকেল আসতে থাকলেন। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তালিম চলে। মাঝে শিষ্যই সাজিয়ে দেন তামাক, খাস ফৌজদারি বালাখানা থেকে আনা।

আমির খাঁ নিজের সরোদটিও রেখে গেলেন শিষ্যের বাড়িতে। টানা পাঁচ বছর এমনটা চলতে থাকল। এমনও দিন গিয়েছে, যখন কলকাতা শহর বৃষ্টিতে ভাসছে। কিন্তু সরোদ শিক্ষায় খামতি নেই। কারণ, বুক সমান জল ডিঙিয়ে ততক্ষণে দরজায় টোকা দিচ্ছেন ওস্তাদজি, স্বয়ং আমির খাঁ।

কিন্তু কোথাও স্থির থাকাটা ঠাকুরদার স্বভাব নয়।

১৯২৫ সাল। হঠাৎ শোনা গেল, মাইহার থেকে আসছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। উঠেছেন সুকিয়া স্ট্রিটে, গৌরীপুরের রাজবাড়িতে।

একদিন তিন ভাই মিলে গেলেন এসরাজশিল্পী শীতল মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, আলাউদ্দিনের সরোদ শুনতে। শুনে মনে হল, ‘এই সুর নিশ্চয়ই কোনও দেবতার সৃষ্ট’। ঠাকুরদা ঠিক করলেন, আলাউদ্দিন খাঁ’র কাছেই নাড়া বাঁধবেন। সরাসরি বাবাকে বললেন, ‘আপনার কাছে সরোদ শিখতে চাই।’ কিন্তু ওস্তাদজি ‘মাইহার অনেক দূর’ ইত্যাদি বলে বিদায় করে দিলেন ঠাকুরদাকে।

কিন্তু ঠাকুরদাও নাছোড়। বিস্তর সাধ্য-সাধনার পর আলাউদ্দিন বললেন, ‘বেশ, আপনার বাজনা শুনব।’ ২১ বছরের তিমিরবরণ মন-প্রাণ ঢেলে সরোদ শোনালেন। শুনে বাবা বলেন, ‘আপনি আমার থেকেও ভাল বাজান। আমির খাঁ সাহেব তো আপনাকে সব দিয়ে দিয়েছেন।’ ফের কাটিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন।

শেষমেশ গৌরীপুরের রাজকুমারের অনুরোধে বাবা রাজি হলেন। পড়ে রইল শিব ঠাকুরের গলি আর গুরু আমির খাঁ সাহেব।

মাইহারে গিয়ে প্রথম প্রথম যেন বড্ড মন কেমন করে ঠাকুরদার। কলকাতার শহুরে পরিবেশের ঠিক উল্টো যেন এখানে। বড্ড নির্জন পথঘাট।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিমিরবরণ ও শিশিরশোভন ছবি: বিক্রম সিংহ নাহার

কিছু দিন থাকা-খাওয়া ওস্তাদজির বাড়িতেই। পরে আলাউদ্দিনের আবেদনে মাইহারের মহারাজা একটি মন্দিরে তিমিরবরণের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানেই একটি ইকমিক কুকারে রান্না করতেন ঠাকুরদা। সেই সময়ে প্রতি মাসে কলকাতায় ভাইকে কুড়ি টাকা পাঠাতেন তিনি।

তবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঠাকুরদার প্রথম কাজটি ছিল শিক্ষাগ্রহণ। বাবার কাছে শিক্ষাগ্রহণও যে খুব একটা সহজ নয়। আলাউদ্দিন নাকি মাত্র এক বার শিক্ষার্থীকে বাজিয়ে শোনাতেন, তাও মিনিট ১৫। সেটাই মনে রেখে ঠিকঠাক বাজাতে হবে। না হলে জুটতে পারে হুঁকো হাতে বাবার মার।

ঠাকুরদার অবশ্য সাধকের নিষ্ঠা। গ্রীষ্মে রাতভর বাজাতেন। শীতে রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে টানা সাত ঘণ্টা চলত অভ্যেস। শিক্ষা চলাকালীন বছরে এক বার বাড়ি আসতেন ঠাকুরদা। সেই সময়ে আমাদের বাড়িতে নিত্য আনাগোনা কাজী নজরুল ইসলাম, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অতুলপ্রসাদ সেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসুদের।

ঠাকুরদার নিষ্ঠার কারণেই হয়তো তাঁর সরোদে মুগ্ধ হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-মুগ্ধতার পিছনে একটি গল্পও রয়েছে। এক বার ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি চা-চক্রের মজলিশ বসিয়েছেন। আমন্ত্রিত ঠাকুরদা ও তাঁর দাদা। খবর গেল কবির কাছে। সব শুনে উনি ঠাকুরদার দাদাকে বললেন, ‘শুনলাম তোমার ভাই সরোদ বাজায়। তাও আমাকে অন্যের মুখ থেকে শুনতে হবে!’ এটুকুই যথেষ্ট ছিল। রবীন্দ্রনাথকে সরোদ শোনালেন ঠাকুরদা, ‘পুরিয়া ধানেশ্রী’ রাগ। মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ এবং উপস্থিত গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথেরা। আসরের শেষে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘মাইহার থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে যোগ দিও। তোমার মতো লোক আমার দরকার।’

ঠাকরদার সরোদ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন দিলীপকুমার রায়ও। ১৯২৮-এর কোনও এক সময়ে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘মীরাবাঈ’। একদিন অভিনয় শেষে দিলীপকুমার শুনলেন ঠাকুরদার আলাপ, ‘পূরবী’তে। শুনেই দিলীপ রায়ের মনে হল, এ যেন ‘সৃষ্টির নির্ভীক পদক্ষেপ’। সেই সময়েই ফিলাডেলফিয়ার বিখ্যাত সঙ্গীত নির্দেশক লিওপোল্ড স্টকস্কিও শুনেছিলেন ঠাকুরদার সরোদ। শুনেই আমন্ত্রণ জানান আমেরিকা যাওয়ার।

শুধু আমেরিকা নয়। গোটা ইউরোপও মুগ্ধ হবে ঠাকুরদার সরোদে। সৌজন্যে উদয়শঙ্কর। ১৯৩০ সাল। বিদেশে বেশ সফল তখন উদয়শঙ্কর। সেই সময়ে সুইৎজারল্যান্ডের এক ধনকুবেরের কন্যা এলিস বোনার একদিন নৃত্য-কিংবদন্তিকে বললেন, ‘তোমার দলে ভারতীয় যন্ত্রীদের প্রয়োজন।’ দেশে ফিরলেন উদয়শঙ্কর ও এলিস। উঠলেন পার্ক স্ট্রিটের এক ফ্ল্যাটবাড়িতে।

উদয়শঙ্করের দরকার ছিল একজন অর্কেস্ট্রা পরিচালকের, যাঁর অর্কেস্ট্রা হবে প্রায় পুরোপুরি ভারতীয়। এই ‘দরকারি’ প্রয়োজনটা জানতেন সেকালের বিখ্যাত জলসা-সংগঠক হরেন ঘোষ। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ান আর্টসের ভবনে উদয়শঙ্করের অনুষ্ঠান হল। তা দেখাশোনার জন্য আমন্ত্রিত হলেন ঠাকুরদা।

তত দিনে অবশ্য দাদা, ভাই, ভাইপো, ভাগ্নে, ভাগ্নীদের নিয়ে একটা পারিবারিক অর্কেস্ট্রা প্রায় তৈরিই করে ফেলেছিলেন ঠাকুরদা। সেখানে বাড়ির লোকজন বাদে প্রায়শই দেখা যেত আরও কিছু গুণী মানুষকে। নাহার পরিবারের বিক্রম সিংহ নাহারের হাতে থাকত বেহালা। এম্পায়ার থিয়েটার পরিবেশিত ‘দালিয়া’ নাটকের জন্যও ভারতীয় অর্কেস্ট্রা তৈরি করে ফেলেছেন ঠাকুরদা।

বিভিন্ন সূত্র মারফত এ সবই জানতেন উদয়শঙ্কর। আর দেরি করলেন না তিনি। সুভো ঠাকুর আর এলিসকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আমাদের বাড়ি। পার্ক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানালেন ঠাকুরদা আর তাঁর দাদাকে। সেখানে উদয়শঙ্করের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ভারতীয় যন্ত্রের বিরাট সংগ্রহ মুগ্ধ করল ভট্টাচার্য ভাইদের।

প্রস্তাবটা পাড়লেন উদয়শঙ্কর। কিছু দিন পরে ঠাকুরদা যোগ দিলেন উদয়শঙ্করের ‘ব্যালে ট্রুপ’-এ। চিঠিতে আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে পা বা়ড়ালেন ইউরোপ-বিজয়ে। উদয়শঙ্করের ‘ট্রুপ’ প্রথমে পৌঁছল প্যারিসে। সেটা ১৯৩০-এর সেপ্টেম্বর। বেশ ক’মাস ধরে টানা প্রস্তুতি চলল। ভারতীয় অর্কেস্ট্রা নিয়ে তৈরি হলেন ঠাকুরদাও। ১৯৩১-এর ৩ মার্চ সঁজে লিজে রঙ্গমঞ্চে উদয়শঙ্করের এ যাত্রার প্রথম অনুষ্ঠান। সেই শুরু। তার পর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপের নানা দেশে অনুষ্ঠান। বিশ্ব জুড়ে অভিনন্দিত হলেন উদয়শঙ্কর আর ঠাকুরদা।

এই পর্বে দু’-একটি মজার ঘটনা ঘটে। ঠাকুরদার লেখা থেকেই পড়া। একবার নাকি হল্যান্ড সীমান্তে রক্ষীরা কিছুতেই ‘ব্যালে ট্রুপ’কে ঢুকতে দেবেন না। কারণ, ব্যালে দলের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ যন্ত্র ও কাপড় রয়েছে। এ সব দেখে রক্ষীরা ভাবলেন, উদয়শঙ্কর ও তাঁর দলবল নিশ্চয়ই ব্যবসাদার। শেষমেশ ঠাকুরদা সরোদ হাতে বসলেন। মুগ্ধ হলেন রক্ষী। মিলল ছা়ড়পত্রও।

আরও একবার চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগে অনুষ্ঠান। সেখানেও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উৎপাতে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছতে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রেক্ষাগৃহে তখন মারমুখী দর্শকেরা। অনুষ্ঠানের পরিচালকেরা পড়লেন মহা ফাঁপরে। শেষে মার না খেতে হয়! এ বারেও ত্রাতা ঠাকুরদাই। পরদা উঠল। ঠাকুরদা চোখ বুজে সরোদ বাজাতে শুরু করলেন। হঠাৎ স্টেজে ধুপধাপ করে কী যেন পড়তে থাকল। চোখ বুজে সরোদ বাজাচ্ছেন ঠাকুরদা। ভাবলেন, নিশ্চয়ই পচা ডিম বা পনির উড়ে আসছে। একটা কিছু গায়ে এসে লাগায় শিল্পীর ধ্যান ভাঙল। চোখ মেলে দেখলেন, ‘ছোট ছোট সুন্দর ফুলের তোড়া’!

এই ইউরোপ-পর্বে লম্বা, ঝাঁকড়া চুল, খানিক শ্যামবর্ণ ঠাকুরদা শ্রোতা ছাড়া মহিলা মহলেও বেশ সমাদর পেয়েছিলেন। রবিশঙ্করের বর্ণনায় দেখি, ‘দাদার পরেই শ্বেতাঙ্গিনী মহলে ওঁর (তিমিরবরণের) ডিমান্ড ছিল ইউরোপ বা আমেরিকাতে।’

কিন্তু ইউরোপ বেশি দিন ভাল লাগল না ঠাকুরদার। ফিরলেন কলকাতায়। যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্সে। স্বাগত জানালেন কর্ণধার বিএন সরকার। অর্কেস্ট্রায় এ বার ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে ব্যবহার করলেন ব্যাঞ্জো, ভিওলা, চেল্লো-সহ বিভিন্ন ভিনদেশি যন্ত্র। সংযোজন করলেন পশ্চিমি সুরের। শুধু তা-ই নয়, বালি ও জাভা গিয়ে সেখানকার ‘গ্যামেলন অর্কেস্ট্রা’র বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এলেন। এই বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের কাজে সাহায্য করল জাভার সুলতানকে রবীন্দ্রনাথ এবং এক অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা চিঠি। ঠাকুরদার মননে আলাদা একটা জায়গা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বোধহয় ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘শিশুতীর্থ’ পরিবেশনা করেছিলেন ঠাকুরদা।

এই নিউ থিয়েটার্সেরই দু’নম্বর স্টুডিয়োতে হিন্দি ‘দেবদাস’-এর শ্যুটিং হবে। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন ঠাকুরদা। যদিও পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া তাতে প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু সিনেমাটি মুম্বই ও কলকাতায় ১৯৩৫-এ মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের এক নতুন ইতিহাস তৈরি হল। এই প্রথম অত্যন্ত সার্থক ভাবে চলচ্চিত্রে অর্কেস্ট্রা ব্যবহৃত হল। যে প্রমথেশবাবু প্রথমে ঠাকুরদাকে সিনেমায় নেওয়া নিয়ে নিমরাজি ছিলেন, তিনিই পরে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিমিরবরণে। ঠাকুরদার নিজের কথায়, ‘একদিন অফিসে বসে আছি। পাশে পাহাড়ী সান্যাল। বড়ুয়া সাহেব পাহাড়ী সান্যালকে বললেন, ‘জানো পাহাড়ী, ছেলেটা একটা গানে খুব ভাল সুর দিয়েছে।’

বেশ কিছু দিন কাটল নিউ থিয়েটার্সে। হঠাৎ একদিন ডাক এল এক বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পীর কাছ থেকে। তাঁর আমন্ত্রণে ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্সে সঙ্গীত ও অর্কেস্ট্রা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তিমিরবরণ। ‘ওমরের স্বপ্নকথা’, ‘বিদ্যুৎপর্ণা’ প্রভৃতি ছবিতে সঙ্গীত ও নৃত্যের সুর সং‌যোজন করলেন ঠাকুরদা।

ঠাকুরদার নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে যাওয়াটা বিএন সরকার অবশ্য ভাল ভাবে নিলেন না। তিনি বললেন, ‘তিমিরবাবু, আপনি খুব ভুল করছেন। এ ভাবে চলে যাবেন না।’ শুনলেন না ঠাকুরদা। সেই অভিনেত্রীর হাতছানি তিনি এড়াতে পারেননি। অভিনেত্রীটি কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি, ইতিমধ্যেই বিখ্যাত সাধনা বসু। তিনি নিজের একটি ছবি তিমিরবরণকে দিয়েছিলেন। যার তলায় লেখা, ‘টু তিমির— উইশ ইউ অল দ্যাট ইউ উইশ ইওরসেল্ফ... সাধনা বসু’।

এই সম্পর্কের কারণ বোধহয় সৃষ্টিশীল ঠাকুরদার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মণিকা দেবীর বৌদ্ধিক দূরত্ব। যদিও ঠাকুমা সারা জীবন অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন সংসার এবং এই মহান শিল্পীটিকে সযত্নে লালন করতে। ঠাকুরদা কেমন বেহিসেবি ছিলেন, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উনি নানা রকম গাড়ি পছন্দ করতেন। সেই জন্য প্রতি মাসে গাড়ি বদলাতেন!

যদিও পরিবারের সদস্যদের বৌদ্ধিক চেতনাকে চিরকালই সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন ঠাকুরদা। ছেলে, মানে আমার বাবা ইন্দ্রনীলকে রেখে এসেছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। আমাকেও মাঝেসাঝে ডেকে ছোট্ট-ছোট্ট ছড়া তৈরি করে শোনাতেন।

রাজনীতি নিয়ে কোনও দিনই আগ্রহ ছিল না ঠাকুরদার। তবে এড়াতে পারেননি রাজনীতির কিছু মানুষের আবেদন। যেমন কংগ্রেস সভাপতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন, ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে এমন ভাবে সুর দেওয়া হোক, যাতে সকলে তা গাইতে পারেন। ১৯৩৯ সালে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুরেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে ঠাকুরদা এ কথা শুনলেন। ঠাকুরদা ‘দুর্গা’ রাগে বাঁধলেন গানটিকে। আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের যৌথ ‘লেবেল’-এ গানটি রেকর্ড করা হয় ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি। মোহনদাস করমচন্দ গাঁধী নিহত হয়েছেন। ব্যথিত ঠাকুরদা তৈরি করলেন, ‘ভায়োলেন্স টু নন ভায়োলেন্স’। এ ছাড়া ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় তৈরি করেন ‘মুক্তিসংগ্রাম’।

তিমিরবরণকে দেওয়া সাধনা বসুর ছবি

তবে ঠাকুরদার জীবনের শেষ দিকটি মনখারাপ করা। শেষ জীবন তাঁর নেতাজিনগরের এক ছোট্ট ঘরে অসম্ভব শরীর-খারাপের অবসন্নতায় কেটেছে। মাঝেসাঝে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা প্রিয় সরোদটির দিকে তাকিয়ে আক্ষেপ করতেন ভারতীয় অর্কেস্ট্রার প্রথম প্রাণপুরুষ, ‘একদিন ভেবেছিলাম সরকারি আনুকূল্যে একটা জাতীয় অর্কেস্ট্রা তৈরি করব... আমি আর পারলাম না।’

তবে মানুষের ভালবাসাতেই বেঁচে আছেন ঠাকুরদা। না হলে ১৯৮৭ সালের ২৯ মার্চ তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পরেও কেন এক অচেনা-অজানা মানুষ কাঠফাটা রোদে বহু পথ ডিঙিয়ে এসে দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, ‘আপনি কি তিমিরবরণের নাতনি?’

ঋণ: ‘দেশ’ (১ আষাঢ় ১৩৭৫, ‘বিনোদন সংখ্যা’ ১৩৮৭), ‘উদয়-পথের সহযাত্রী’ (আনন্দ): তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, ‘রাগ-অনুরাগ’ (আনন্দ): রবিশঙ্কর, ‘গুণী তিমিরবরণ বনাম ওস্তাদপন্থী’ (ভারতবর্ষ, ১৩৩৭):দিলীপকুমার রায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement