মডেল: ঐশিকী; ছবি: আশিস সাহা মেকআপ: সুবীর মণ্ডল; লোকেশন: দ্য সনেট, সল্টলেক।
বয়স সাতেকের মৌলি মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে দিন তিনেকের ছুটিতে। সঙ্গে মাসির মেয়ে মেহুলি। ট্রেনে জানালার ধারে সিট পেয়েই দু’বোন আত্মহারা। কিন্তু এক ঘণ্টা পেরোতেই দৃশ্যবদল। দু’জনের চোখ জানালা থেকে সরে মোবাইলের পর্দায়। শত ডাকাডাকিতেও হুঁশ নেই কোনও। রাহুল তিনে পা দিয়েছে। ভিডিয়ো অ্যাপের ব্যবহার, মোবাইলের পাসওয়ার্ড প্যাটার্ন— সবই তার নখদর্পণে। কিংবা সদ্য কৈশোরের দেবলীনার কথাই ধরুন। স্কুল থেকে প্রাইভেট টিউটর— মোবাইল ছাড়া যেতে চায় না কোথাও। স্কুলপড়ুয়াদের ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও সাইলেন্ট মোডে ব্যাগে লুকিয়ে রাখে সে।
দোষটা মৌলি, মেহুলি, রাহুল কিংবা দেবলীনার নয়। ছোটবেলার কুমিরডাঙা, এক্কাদোক্কা, আচার চুরি করে খাওয়া বা গল্পের বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকার অভ্যেসটা এখন নস্টালজিয়ার মতো। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের হাতে উঠছে স্মার্টফোন। কেউ নিজেই ব্যবহার করছে, কারও মা-বাবা-দাদা-দিদির মোবাইলেই কাটছে দিনের বেশির ভাগ সময়। যদিও ফোনে আসক্ত হয়ে পড়া ভীষণই অস্বাস্থ্যকর।
শারীরিক ক্ষতি
• স্মার্টফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন মস্তিষ্ক, কান-সহ নানা অঙ্গের ক্ষতি করে। একটি বাচ্চার স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার সময়ে তা আরও ক্ষতিকর। মস্তিষ্ক ও কানে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হওয়ার ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
• বিজ্ঞান বলছে, বাচ্চার মস্তিষ্কের ত্বক, কোষ এবং হা়ড় তুলনায় অনেক নরম ও পাতলা হওয়ার দরুন তা প্রাপ্তবয়স্কের চেয়ে প্রায় ৬০% বেশি রেডিয়েশন গ্রহণ করে। এই রেডিয়েশনকে ‘কারসিনোজেনিক’ আখ্যা দিয়েছে ওয়র্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন। অর্থাৎ ফোনের ব্যবহার শিশুর ক্যানসারের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়।
• যেটা বাচ্চাদের হেসেখেলে, ছুটে বেড়ানোর সময়, তখন তারা ফোনে ডুবে থাকলে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা তো ব্যাহত হয়ই, তাদের ওবেসিটি বা অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়তে পারে।
• এমনকী সারা দিন অতিরিক্ত ফোন, ট্যাবের ব্যবহার বাচ্চার স্বাভাবিক ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়।
মানসিক ক্ষতি
• যে বয়স শিশুকে মানসিক ভাবে সুস্থ, সুন্দর ও বড় করে তুলতে সাহায্য করে, সেই সময়েই থাবা বসায় স্মার্টফোন। ফোনে ডুবে থাকলে বাচ্চার মানসিক সমস্যাও দেখা যেতে পারে। সারা ক্ষণ ফোনে ডুবে থাকার ফলে অপেক্ষা করার অভ্যেস হ্রাস পায়।
• ফোনের প্রতি আসক্ত বাচ্চাটিকে ফোন না দিলে তার বিরক্তির ভাব দেখা দেয়। কথোপকথনেও অল্পেই ধৈর্য হারিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ে তারা। খারাপ ব্যবহারও অস্বাভাবিক নয়।
• ফোনে আটকে থাকা শিশুর সৌজন্যবোধ হারিয়ে যেতে পারে। • আবার যারা সেলফি তোলায় মগ্ন, তাদের অনেকের মধ্যেই আত্মকেন্দ্রিকতার লক্ষণ প্রবল হয়ে ওঠে বলে জানাচ্ছেন মনস্তত্ত্ববিদরা।
• অনেক সময়ে বাচ্চা হয়তো স্মার্টফোনেই ভিডিয়োর মাধ্যমে কোনও গল্প পড়ছে বা দেখছে। ভিডিয়োয় ব্যবহৃত মিউজ়িক গল্পের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে আনুষঙ্গিক জিনিসের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।
• ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিয়ো যা বাচ্চার জন্য মোটেও প্রয়োজনীয় নয়, স্মার্টফোনের অবাধ ব্যবহারে তা তাদের হাতে পড়তে পারে, যা তার মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।
• ফোন বা ট্যাব কল্পনাশক্তিও কেড়ে নিচ্ছে। যেখানে প্রথম পর্যায় থেকেই বাচ্চাকে সমস্ত কিছু প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে নিজের ইচ্ছে মতো কল্পনা করার অবকাশ কোথায়? কল্পনার অভাব শিশুকে সুন্দর মানুষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। না ভাবার অভ্যেস লেখার ক্ষমতা বা সৃজনশীলতাও কমিয়ে দেয়।
সমস্যার উৎস
এই সমস্ত সমস্যার জন্য শিশুকে সর্বতো ভাবে দায়ী করা যায় না। হতেই পারে মা-বাবা কাজে ব্যস্ত। বাচ্চাকে দেখার সময় নেই। কিন্তু তার প্রতিকার কখনওই বাচ্চার হাতে স্মার্টফোন ধরিয়ে দেওয়াও হতে পারে না।
বাচ্চা খেতে না চাইলে অনেক বাড়িতেই টিভিতে বা ফোনে কার্টুন চালিয়ে দেওয়ার অভ্যেস থাকে। কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে অন্য কিছু হাসিল করে নেওয়ার প্রবণতা সুখকর হয় না। কার্টুনেও এমন বার্তা থাকে, যা আপনি নিজেই খুদেটিকে শেখাতে চান না। তাই ফোনের নেশা থেকে সন্তানকে দূরে রাখার কাজ আপনাকেই করতে হবে।
উত্তরণের উপায়
• যে শিশু ইতিমধ্যেই ফোনে ডুবে আছে, তার কাছ থেকে এক ঝটকায় ফোন কেড়ে নিয়ে মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা না করাই ভাল। হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বাচ্চার দৈনিক ফোন ব্যবহারের সময়ে লাগাম টানুন।
• স্মার্টফোনের ব্যবহার মাত্রই ভুল, এটা ঠিক নয়। সমীক্ষা বলছে, দু’বছরের বাচ্চা ইন্টারঅ্যাকটিভ অ্যাপের মাধ্যমে অনেক বেশি শব্দ শেখে। কিন্তু শিশু কত ক্ষণ ফোন ব্যবহার করবে, ঠিক করুন আপনি।
• গল্পের বইয়ের প্রতি বাচ্চার আগ্রহ বাড়ান। এখন পপ-আপ জাতীয় ত্রিমাত্রিক বইও পাওয়া যায়। এতে কল্পনাশক্তি বাড়বে।
• সাঁতার, নাচ, গান, খেলা, বাদ্যযন্ত্রে ব্যস্ত রাখুন বাচ্চাকে।
• যে সময়টায় শিশু ফোনের গেমিংয়ে আটকে, তাকে ওই সময়েই বাড়ির বাইরে খেলতে পাঠান।
• ক্লে মডেলিং, ব্রেনভিটা, দাবা, সুদোকুতে শিশুকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। সময়ও কাটবে, বুদ্ধিবৃত্তি ও কল্পনাশক্তির বিকাশও হবে।
• বাড়িতে আপনি মোবাইল ফোন যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করুন। শিশুকে বোঝানোর চেষ্টা করুন যে, ফোন ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, যার প্রধান কাজই কল বা মেসেজ করা।
যে দুনিয়ায় প্রায় সব কিছুই ডিজিটাল হতে বসেছে, সেখানে আপনার বাচ্চার সুস্থতার জন্য ফোন ব্যবহারে সংযত হোন আপনিও। আপনাকে দেখেই না সন্তান জানবে মোবাইলের ব্যবহার সম্পর্কে!