Cultural Programme

রস অক্ষুণ্ণ ভাবের, সম্পন্ন লীলাসঞ্চারও

বসন্তের আবহে অনুষ্ঠান শুরু। ‘ওরে গৃহবাসী’ দিয়ে। প্রকৃতি-পর্যায়ের বিভাসে বাঁধা বাউলাঙ্গ। নবীন শিল্পীর তুমুল-তৈরি খোলা গলায় আবেশ তৈরি হল।

Advertisement

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩২
Share:
ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় সঙ্গীত ভাবব্যঞ্জক, রাগ-রাগিণীর নিছক ব্যাকরণ বা তালের গণিতবিদ্যা নয়। ‘বাহিরের আয়তন বৃহৎ বিচিত্র ও নির্দোষ’ হয়ে উঠলেও ‘ভাবের রসটি চাপা’ পড়লে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়, ‘ইহাতে শক্তি আছে, কিন্তু লীলা নাই’। রবীন্দ্রগান লীলারই সন্ধানস্রোত। ঘটনাচক্রে, ‘রবিবাবু’র গান রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে ওঠার অব্যবহিত পর থেকেই সে কালের অন্যতম আকর্ষবিস্তারী মাধ্যম চলচ্চিত্র নানা ভাবে তার শরণ নিয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্র সরাসরি রবীন্দ্রগান ব্যবহার করে এসেছে। হিন্দি এবং নানা ভাষার ছবি রবীন্দ্র-সুরে কথা বসিয়ে দেদার বাণিজ্য করেছে। তাতে লীলা কতটা তিলকমণ্ডিত হয়েছে, সে প্রশ্নও উঠেছে কিছু ক্ষেত্রে। তবে, খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালকদের এই ‘অ্যাডাপ্টেশন’ প্রয়াসটি ঐতিহাসিকই।

Advertisement

দোলের পরের সন্ধ্যায় ‘ইনার হুইল ক্লাব অব ক্যালকাটা’র আয়োজনে কলকাতার জ্ঞান মঞ্চের অনুষ্ঠানে সেই ইতিসূত্র আবারও মূর্ত হল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় গানের প্রশিক্ষিত নবীন শিল্পী আরমান খান রবীন্দ্রনাথের ১০টি গান গাইলেন। প্রতিটির পরে গাইলেন সেই সব রবীন্দ্রগানের আধার-সুরে বাণী-পারম্পর্যে তৈরি হিন্দি ছবিগান। আরমানের সহশিল্পী ছিলেন শ্রীখোল-পাখোয়াজ-তবলায় বিপ্লব মণ্ডল, এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী, কি-বোর্ডে দেবাশিস সাহা। অর্থাৎ, হিন্দি গানগুলির পরিচিত বাদ্য-অনুষঙ্গের প্রায় কিছুই ছিল না। কিন্তু আরমান এবং তাঁর সতীর্থরা দুই পরিসরেই মুগ্ধ করলেন।

বসন্তের আবহে অনুষ্ঠান শুরু। ‘ওরে গৃহবাসী’ দিয়ে। প্রকৃতি-পর্যায়ের বিভাসে বাঁধা বাউলাঙ্গ। নবীন শিল্পীর তুমুল-তৈরি খোলা গলায় আবেশ তৈরি হল। তারই রেশ বহন করে আরমান ধরলেন ‘রাহি মাতোয়ালে’। ১৯৫৪ সালের নীতিন বসু পরিচালিত ‘ওয়ারিস’ ছবির গান। সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস, গীতিকার কমর জালালাবাদি। ছবিতে গেয়েছিলেন সুরাইয়া, তালাত মাহমুদ। তালাতের নরম স্বরক্ষেপণ-জাদুর সন্ধানী হল আরমানের শ্রীকণ্ঠ। পরের পরিবেশনা ‘রোদন-ভরা এ বসন্ত’। কীর্তনাঙ্গ, মিশ্র বেহাগ, প্রেম পর্যায়। তার সূত্রেই ‘মেরা সুন্দর স্বপ্না বিত গয়া’। ১৯৪৭ সালে মুনশি দিলের ‘দো ভাই’ ছবির গান। গীতিকার রাজা মেহেদি আলি খান, সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ, ছবিতে কণ্ঠ গীতা দত্তের। আরমান সেখান থেকে এলেন ‘যদি তারে নাই চিনি’তে। প্রকৃতি-পর্যায়ের খাম্বাজ-পিলু। তার রেশ ধরে ‘তেরে মেরে মিলন কি’। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘অভিমান’, সাল ১৯৭৩। সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। গীতিকার মজরু সুলতানপুরি। ছবিতে কণ্ঠ লতা মঙ্গেশকর, কিশোরকুমারের। তুমুল হিট সে-গান সমীহ-সহযোগে পরিবেশন করলেন আরমান। পরে পাখোয়াজি দ্রুত-বোলপথে প্রবেশ করলেন বিচিত্র পর্যায়ের ইমনে— ‘খরবায়ু বয় বেগে’। তারই গন্ধনির্মাণ ‘পবন চলে জ়োর’, রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে ১৯৫২ সালে পল জ়িলসের তৈরি ‘জ়লজ়লা’ ছবির। গীতিকার সত্য কুমার, সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিক। গেয়েছিলেন সহশিল্পী-যোগে পঙ্কজকুমারই। দু’টিই চমৎকার গাইলেন আরমান। এর পরে ‘মধু-গন্ধে ভরা’। শ্রীখোল-অনুষঙ্গে নিটোল ভৈরবী। ‘শ্যাম-কান্তিময়ী কোন স্বপ্নমায়া’ চরণে শিল্পীর ‘কোন্’ উচ্চারণের অনির্দেশ-আবহ আর ‘মায়া’ শব্দের আদুরে বাষ্প স্মরণসঞ্চয়। তার রেশ ধরে এল ‘মেরে চঞ্চল নয়না মধুরসকে ভরে’। ১৯৬০ সালে বিজয় ভট্ট পরিচালিত ‘অঙ্গুলিমাল’ ছবির। সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাস। গীতিকার ভরত ব্যাস। ছবিতে কণ্ঠ মিনা কপূর ও সহশিল্পীদের। দ্বিতীয়টির ভাল পরিবেশনা সত্ত্বেও আরমান চমকিত করলেন বাংলা মূল গানটিতেই।

Advertisement

বিরতির পরে শুরু প্রকৃতি পর্যায়ের মল্লার-নিবদ্ধ ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’তে। এসরাজে রাগরূপের সযত্ন প্রতিষ্ঠা। গমক-মিড়-স্পর্শস্বরে মাত গোটা পরিবেশনা। আরমান অনায়াস বিহার করলেন আরোহণ-অবরোহণে। রাগাশ্রয়ে আর্দ্রতা জমিয়ে ধরলেন ১৯৬২ সালে লেখরাজ ভাকরির ‘মা বেটা’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া অনুসারী গান ‘মন মেরা উড়তা যায়ে’। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গীতিকার প্রেম ধওয়ন। পাখোয়াজে-কণ্ঠে গমগম করে উঠল সভাগৃহ। পরে প্রকৃতি পর্যায়ের বাউলাঙ্গ ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ দাপুটে পরিবেশনা। কি-বোর্ডে সরোদের আবহ। শ্রীখোলে সূচিমুখ। সজীব কণ্ঠের লালমাটি তারুণ্য। ‘ঘরের মুখে আর কি রে’ অংশে আরমান নিখুঁত-তীক্ষ্ণ স্বরস্পর্শে ছুঁয়ে গেলেন তাঁর বাবা উস্তাদ রাশিদ খানের শাস্ত্রীয় গায়কির পরম্পরা। এমন উদ্দাম বাউলপনা রবীন্দ্রগানের অধুনা-চেনা চর্চায় খুব ধরা পড়ে না। ‘বন্ধন খুলা পঞ্ছি উড়া’ এল তারই ধারায়। সে গান ১৯৯৮ সালে পার্থ ঘোষের ‘যুগপুরুষ’ ছবির জন্য সঙ্গীত পরিচালক রাজেশ রোশনের বাঁধা, মজরু সুলতানপুরির লেখা। ছবিতে মূল কণ্ঠ প্রীতি উত্তমের। আরমানের পরের গান ‘তুমি কেমন করে গান করো’ পূজা পর্যায়ের, খাম্বাজ-নিবদ্ধ। সুন্দর পরিবেশনা। সে গানের সূত্রে ‘কই জ্যায়সে মেরে’। এটিও ‘যুগপুরুষ’ ছবির। সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার একই। ছবিতে কণ্ঠ আশা ভোঁসলের। পরের গান পূজা পর্যায়ের মল্লার-অঙ্গ ‘যেতে যেতে একলা পথে’। সামান্য তালচ্যুতির উদ্রেক সত্ত্বেও ঝোড়ো ঝম্পকের আবহে সুঠাম পরিবেশনা। সে গানের পরে ‘শাওন কি রাতোঁ মে’। ১৯৬২ সালের বিমল রায়ের ‘প্রেমপত্র’ ছবি থেকে। সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী, গীতিকার গুলজ়ার। ছবিতে কণ্ঠ লতা মঙ্গেশকর, তালাত মাহমুদের। ছুঁয়ে গেলেন আরমান। এ পর্বে শেষ রবীন্দ্রগান ‘একদা তুমি, প্রিয়ে’। প্রেম পর্যায়। কাফি-নিবদ্ধ অর্ধ-ঝাঁপতাল। কঠিন গান। তবে আরমানের এ পরিবেশনাতেও ভাব-নিরীক্ষাই প্রধান প্রাপ্তি। অনুসারী ‘জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে’। ১৯৫৯ সালে বিমল রায়ের ‘সুজাতা’ ছবির গান। সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। গীতিকার মজরু সুলতানপুরি। ছবিতে কণ্ঠ তালাত মাহমুদের। ভাল গাইলেন আরমান। সব শেষে, শ্রোতাদের অনুরোধে, শিল্পী ধরলেন মিশ্র পাহাড়ির হোরি ‘রঙ্গি সারি গুলাবি চুনারিয়া’ এবং মাত করলেন।

এ সন্ধ্যায় প্রাপ্তি অনেক। প্রথমত, উদাত্ত-লাবণ্যময় কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ শুনতে পাওয়া, যা বস্তুত বিরল। দ্বিতীয়ত, অর্থ বুঝে শব্দোচ্চারণ। তৃতীয়ত, বাদ্যযন্ত্রের অনুপম অনুষঙ্গ। তালবাদ্যে বিপ্লব অভিভাবকের মতো মাপা সঙ্গতে মেজাজ ধরে রাখলেন। এসরাজে অপরাজিতা অনবদ্য বাদনে সজাগ সখার ভূমিকা পালন করলেন গোটা পরিসরে। কি-বোর্ডে দেবাশিস মূলত হিন্দি পরিবেশনার পথ অনেকটাই সহজ করে দিলেন। সুন্দর এই আয়োজনের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য ‘ইনার হুইল ক্লাব অব ক্যালকাটা’র।

শুরু হয়েছিল যে কথায়, তারই সূত্রে বলা যায়, এই আয়োজনে ‘ভাবের রসটি চাপা’ পড়েনি একবিন্দুও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement