চিরপরিব্রাজক, চিরতীর্থপথিক, সাহিত্যিক

নিজেকে তিনি সামাজিক শাসনের বিরোধী, জন্ম থেকে নৈরাজ্যবাদী অথচ জীবনধর্মের প্রকৃতির উপাসক বলে মনে করতেন। প্রবোধকুমার সান্যালকে নিয়ে লিখেছেন সুদেষ্ণা বসুপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় সাহিত্যের যে ‘নেতি-প্রত্যয়’ কল্লোলের সাহিত্যিকদের প্রাণিত করেছিল, প্রবোধকুমার সেই প্রভাবকে কাটিয়ে উঠেছিলেন নিজ স্বভাবগুণে। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

‘কল্লোল’ পত্রিকাগোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা প্রথম সারির, প্রবোধকুমার সান্যাল তাঁদেরই অন্যতম। যদিও নিজেকে তিনি ওই গোষ্ঠীর শরিক বলতে একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপীয় সাহিত্যের যে ‘নেতি-প্রত্যয়’ কল্লোলের সাহিত্যিকদের প্রাণিত করেছিল, প্রবোধকুমার সেই প্রভাবকে কাটিয়ে উঠেছিলেন নিজ স্বভাবগুণে। কল্লোল পত্রিকায় তাঁর ‘মার্জনা’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। তার পর থেকে তাঁর সাহিত্যসাধনা ‘বিচিত্রপথগামী’ হয়ে উঠেছিল কেবল সাহিত্যশাখার নিরিখে নয়, জীবনের পথ চলার নিরিখেও। চিরপরিব্রাজক প্রবোধকুমার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সদর্প ঘোষণা করতেন, “আমি সর্বপ্রকার সামাজিক শাসনের বিরোধী, জন্মের থেকে নিহিলিস্ট, জীবনধর্মে পেগান।”

Advertisement

১৯০৫ সালের ৭ জুলাই যখন আপামর বাঙালি স্তব্ধ বিস্ময়ে বঙ্গভঙ্গের সরকারি সিদ্ধান্তের খবর পড়ছিল সকালের কাগজে, কলকাতার গোয়াবাগানের ৪ নম্বর রাধানাথ বোস লেনে সেই দিনই জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রবোধকুমার। বাবা রাজেন্দ্রনাথ সান্যাল ও মা বিশ্বেশ্বরী দেবী। কিন্তু চার মাস বয়সেই যখন প্রবোধকুমার তার বাবাকে হারাল (রাজেন্দ্রনাথ হঠাৎই মারা গিয়েছিলেন হৃদ্‌রোগে), সচ্ছল পরিবারটিতে রাতারাতি নেমে এল চরম আর্থিক বিপর্যয়। অনিশ্চিত হয়ে পড়ল স্ত্রী ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ। অবস্থা সামাল দিতে দিদিমা দ্রাক্ষাময়ী দেবী গোটা পরিবারকে নিয়ে এলেন শ্যামবাজারে তাঁর নিজের বাড়িতে। মামাদের সংসারে স্থান হল তাঁদের। দিদিমার প্রভাব প্রবোধকুমারের জীবনে অনেকখানি জুড়ে ছিল। স্বাধীনচেতা এই নারীর মধ্যেই প্রবোধকুমার দেখেছিলেন স্বাধীন ভাবে বাঁচার প্রথম প্রকাশ। মা বিশ্বেশ্বরীর কাছে পেয়েছিলেন সাহিত্যপাঠের আস্বাদ। আর বাবা রাজেন্দ্রনাথকে চেনার সুযোগ না হলেও, তাঁর ঘুরে বেড়ানোর

শখটি প্রবোধকুমারের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছিল।

Advertisement

মাত্র চার বছর বয়সে ভাগলপুরে পিসিমার বাড়ি বেড়াতে যাওয়াই ছিল প্রবোধের প্রথম বাড়ির বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা তাঁকে এতটাই আনন্দ দিয়েছিল যে, পরবর্তী কালে দিদিমার মুখে কাশী যাওয়ার গল্প শুনে ওই বয়সে এক দুপুরবেলা সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার পথে হেঁটে কাশী যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নিতে। ভাগ্যক্রমে রাস্তার এক পাহারাওয়ালা তাঁকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে দেখে কোলে করে বাগবাজারের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যায় সন্ধেবেলা।

তিন ছেলের সঙ্গে সাহিত্যিক

শৈশবে প্রবোধ মাকে দেখতেন ‘প্রহ্লাদচরিত’-এ ডুবে থাকতে। চালতাবাগানে রঘুপণ্ডিতের পাঠশালায় ‘তিন পয়সা একখানা স্লেট, এক পয়সা দুটো পেন্সিল, ‘বর্ণপরিচয়’ এক পয়সা, ‘বোধোদয়’ এক পয়সা, এক আনা পণ্ডিতের প্রণামী’ দিয়ে ছোট্ট প্রবোধকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন দিদিমা। কিন্তু পুঁটিবাগানের সংকীর্ণ পথ দিয়ে বর্ষাকালে ‘শীত শীত ভাব, কাজে জড়তা, থৈ থৈ জল’ পেরিয়ে পাঠশালায় যেতে যেতে যখনই তাঁর সর্বাঙ্গ বেয়ে বর্ষার ধারা নেমেছে, চোখ বন্ধ করে তিনি ভেবেছেন, ‘সবাই থাকুক আশ্রয়ে, সুখে থাকুক’, কিন্তু তাঁকে বেরিয়ে পড়তেই হবে। কারণ, তাঁর ‘অন্তর্গূঢ় প্রাণচেতনার সঙ্গে যোগ রয়েছে বাইরের বর্ষার জল দাঁড়ানো পথের, দুর্যোগের আর ওই দিগন্তজোড়া কাতর ভাবটির।’

পাঠশালার পাট চুকিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছেন স্কটিশ চার্চ স্কুলে। বিনা বেতনের ছাত্র হিসেবে। দিদিমার বাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় বিরাট একান্নবর্তী পরিবার তত দিনে ছিটকে পড়েছে শহরের নানা প্রান্তে। আর্থিক অনটন আর আশ্রয়ের সন্ধানে প্রবোধদের ভাড়াবাড়ি বদলাতে হয়েছে বেশ কয়েক বার। তিন পয়সায় এক দিস্তে কাগজ কিনে চালাতে হত তিন মাস। বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সরকারকে। আর হাতে এসেছিল ‘হাসিখুশি’, ‘ছবি ও গল্প’ এবং ‘দাদামশায়ের থলে’র মতো বই, যা তাঁর মনে কল্পনার ফানুস উড়িয়েছিল। শিল্প সৃষ্টির প্রথম প্রেরণা অঙ্কুরিত হয়েছিল মনে। রামায়ণ, মহাভারত যেমন তাঁকে চিরকালীন সাহিত্যের পরিচয় দিয়েছিল, তেমনই বাইবেল, কোরান সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধার আসনটিও পেতে দিয়েছিল তাঁর মনে। দশ বছর বয়সেই চুঁচুড়ায় মেজমাসিমার বাড়িতে গিয়ে পড়ে ফেলেছিলেন জলধর সেনের ‘হিমালয়’ ও ড. সোয়েন হেডিনের ‘ট্রান্স হিমালয়ান্স’ বই দু’টি। হিমালয়কে দেখার প্রবল ইচ্ছে সেই বয়সেই গেঁথে গিয়েছিল তাঁর মনে।

ফলে এক দিকে কখনও ঘুড়ি উড়িয়ে, কখনও ঝন্টু মাস্টারের টিকি ধরে টেনে স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে, কখনও দীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব হয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে জেল খেটে যেমন তিনি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছেন, অন্য দিকে তেমনই মাইকেলী ঢঙে প্রয়াত পণ্ডিতমশায়ের জন্য শোকগাথা লিখে, বাংলার ছোটলাটের হাত থেকে তামার মেডেল নিয়ে, ‘শঙ্খ’ পত্রিকায় প্রথম প্রবন্ধ লিখে, দিদিমার জন্য লুকিয়ে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে, কবিতা ও গল্প লেখার নেশায় বুঁদ হয়ে গিয়েছেন। বাড়িতে বউদি সেই নেশা ছাড়াতে তাঁকে দিনের বেলায় নানা কাজে ব্যস্ত রাখতেন। আর রাতে ঘরে আলো জ্বালতে দিতেন না খরচ কমানোর অজুহাতে। তাই বিকেল হলেই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যেতেন শিয়ালদহ রেল লাইনের ধারে শান বাঁধানো একটি জায়গা খুঁজে নিয়ে একা বসে বসে লিখতে। পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রেন পেরিয়ে যেত ঝমঝমিয়ে। তিনি লিখে যেতেন তাঁর চারপাশে দেখা, জানা কান্না-হাসির দোল দোলানো মানুষের নানা কাহিনি।

সিটি কলেজের ছাত্র যখন তিনি, ১৯২২ সালে কাশীতে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে খুব কাছ থেকে প্রথম দেখলেন রবীন্দ্রনাথকে। পড়াশোনা মাথায় উঠল। মনে হল, গল্প লিখতে না পারলে জীবন বৃথা। অবহেলিত, অপমানিত, নিপীড়িত মানুষের গল্প। আর সেই সব গল্প এক বন্ধুর হাত ঘুরে এসে পড়ল ‘সোনার বাংলা’, ‘মজলিস’ ও ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদকদের হাতে। ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ছাপা হল ‘মার্জনা’ গল্পটি। গল্প লেখার পাশাপাশি ব্যবসা করেও তিনি রোজগারের চেষ্টা চালিয়েছেন তখন। কখনও মাছের ব্যবসা করেছেন কলকাতার তৎকালীন লবণ হ্রদ এলাকায়। কখনও শিয়ালদহ লাইনে ট্রেনের কামরায় ফেরি করেছেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা। অতুলপ্রসাদ সেনের ‘উত্তরা’ পত্রিকার ক্যানভাসার হয়ে ঘুরেছেন বিহারে। আলমবাজারের জুটমিল, শ্রীরামপুরের ডাকঘর ও বারাণসীর ইন্ডিয়া প্রেসেও চাকরি করেছেন। আবার এরই মধ্যে মাধুরীদেবী ছদ্মনামে ‘বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের স্থান’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ‘করুণাময়ী’ পদক পেয়েছেন।

ছোট থেকেই তাঁর শরীর ছিল মজবুত। পরিশ্রম করতে যেমন কোনও ক্লান্তি ছিল না, ভ্রমণের ধকলও তিনি অনায়াসে সামলেছেন। মাকে নিয়ে তীর্থ করতে বেরিয়ে পড়েছেন হরিদ্বারের পথে। সেখানে গিয়ে প্রথম বার তাঁর হিমালয়কে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তার পরে আবার কলকাতায় ফিরেই কয়েক মাসের মধ্যেই বন্ধু রবি সরকারকে নিয়ে রেঙ্গুনে পালিয়ে গিয়েছেন। এই ভাবেই এক দিন সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছেন উত্তর পশ্চিম সীমান্তে রাওয়ালপিণ্ডির মারী পাহাড়ে। সেখানে চাকরি করার ফাঁকে তিনি মাঝেমাঝেই বেরিয়ে পড়তেন পাহাড়ি পথে। ঘুরে বেড়াতেন রাওয়ালপিণ্ডি, চিত্রল, পেশোয়ার প্রভৃতি জায়গায়। লক্ষ করতেন পাঠান মানুষদের আচার-আচরণ, খাওয়াদাওয়া।

১৯২৮ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘যাযাবর’ প্রকাশ পায়। পরবর্তী বছরগুলিতে মামা ও দিদিমার মৃত্যু তাঁকে আরও একলা করে দেয়। ‘কল্লোল’, ‘প্রবাসী’, ‘কালিকলম’, ‘উত্তরা’ ইত্যাদি পত্রিকায় গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের সূত্রে সমকালীন বড় বড় সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটতে থাকে। এক সময়ে তাঁর লেখা নজরে পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও। ‘দার্শনিক’ প্রবন্ধ, ‘নিশিপদ্ম’ ও ‘কলরব’ গল্প দু’টি পড়ে তিনি প্রবোধকুমার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে পড়েন। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রবোধকুমারের লেখা নিয়ে তাঁর মূল্যবান মতামতও দেন। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে প্রবোধকুমার ফিরে আসেন কলকাতায়। ইচ্ছে, কেবল লিখেই বেঁচে থাকবেন। ‘কল্লোল’-এর অফিসে এক দিন তাঁকে আড্ডা দিতে দেখে নরেন্দ্র দেব ধমকে বলেন, “সাহিত্য করে কারও ভাত জোটে? খেতে না পেয়ে পথে পথে ঘুরবি, লেখকদের দুর্দশা দেখতে পাচ্ছিসনে চারদিকে? তোরা তো সামান্য। রবি ঠাকুরের বই ক’খানা বিক্রি হয় বাজারে?”

কথাগুলো ছুঁয়েছিল প্রবোধকুমারকে। একে একে বন্ধ হতে থাকা ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘ধূপছায়া’ ইত্যাদির মতো পত্রিকা তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের উদীয়মান লেখকদের কোণঠাসা করে দিচ্ছিল। সাহিত্যের আড্ডাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না হেমচন্দ্র বাগচী, প্রমথনাথ বিশী, সুবোধ রায় বা জীবনানন্দের মতো কবি, সাহিত্যিকের। একা হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। লিখেছেন, ‘এই সময়টায় আমি অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করছিলুম। আমার বাঁধন নেই, আগল নেই এবং মানসিক প্রশান্তিও নেই। আমার স্বাস্থ্যের বাঁধন কঠিন, সাংঘাতিক। কণ্ঠে পশুরাজের মতো গর্জন, আমার যৌবনের প্রবলতা অনেকের ভীতির কারণ। কোনও সময়েই আমার মস্তিস্ক এবং শরীরের অন্ত্রতন্ত্র স্থির থাকছে না, আমি বেপরোয়া, দুর্দান্ত এবং অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম যেখানে সেখানে।’

কিন্তু তিনি যখন লিখতে বসতেন, তাঁর বাহ্যজ্ঞান লোপ পেত। এমনও হয়েছে মেঝেতে মাদুরে শুয়ে লিখতে লিখতে তেঁতুলে বিছের কামড় খেয়েছেন, তবু ভ্রুক্ষেপ না করে লিখে গিয়েছেন। কনিষ্ঠ পুত্র শান্তনুর মনে পড়ে, “বাবা যখন লিখতেন, কারও সঙ্গে দেখা করতেন না, কথা বলতেন না। মাকে শুধু চায়ের জন্য বলতেন। জানালা-দরজা সব বন্ধ। পুজোসংখ্যার লেখা যখন লিখতেন তখন দেখেছি, একটা করে লেখা শেষ করছেন আর ‘দেশ’, ‘আনন্দবাজার’, ‘উল্টোরথ’, ‘জলসা’ থেকে লোক আসছে, নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওঁর লেখার সময় ছিল সকাল ন’টা থেকে বেলা ১টা আর বিকেল ৪টে থেকে রাত ১০টা। ছ’মাস ধরে ‘হাসুবানু’ লেখার পরে যখন উঠে দাঁড়াতে গেলেন, পড়ে গেলেন। পা থেকে কোমর পর্যন্ত অবশ হয়ে গিয়েছিল।”

জীবনের নানা বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ‘খাঁচা জীবনের একটানা’ অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে ‘যাযাবর’ উপন্যাসে এসে পৌঁছনো প্রবোধকুমার সান্যালের জীবনে অবধারিত ছিল। যা তাঁকে একাধারে করে তুলেছিল প্রকৃতির উপাসক ও পরিণত এক সাহিত্যিক। বারীন ঘোষ তাঁকে ‘বিজলী’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি ‘একাধারে সম্পাদক, প্রুফরিডার, পত্রলেখক, কেরানী সবই।’ হয়ে উঠেছিলেন বারীন ঘোষের শিষ্য। ফলে স্বদেশি আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত মানুষদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাঁদের কথা উঠে এসেছে তাঁর সেই সময়ে লেখা ‘ছি ছি’র মতো গল্পের মধ্য দিয়ে।

বিজলী ছাড়া ‘দুন্দুভি’, ‘স্বদেশ’, ‘উপাসনা’, ‘পদাতিক’ পত্রিকা সম্পাদনা করার সুবাদে কবিশেখর কালিদাস রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মোহিতলাল মজুমদারের মতো প্রবীণ সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে পরিচয় হয়েছে গজেন্দ্রকুমার মিত্র ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। চাঁদপুরে পুলিশ ইনস্পেক্টরকে হত্যার অপরাধে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয়। ‘স্বদেশ’ পত্রিকায় সেই ফাঁসির প্রতিবাদে সম্পাদকীয় লিখে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। আবার স্যর আশুতোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, যতীন দাসের শবদেহ বয়ে নিয়ে যেতে কাঁধ দিয়েছেন। এ ভাবেই বিংশ শতাব্দীর বিশ ও তিরিশের দশকের উত্তাল সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাবলির শরিক থেকেছেন প্রবোধকুমার।

কিন্তু এ সবের পাশাপাশি নিজের প্রজন্মের সাহিত্যিকদের দেখে তিনি মনে করতেন, ‘নিশাচর জীবন-সন্ধানীর দল... পথে-বিপথে, নোংরায়, খানায়, বস্তির আশপাশে ঘুরে’ বেড়াচ্ছে। কেবলই নিজেদের বলতে চাইছে ‘ছোট ছোট প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ, এখনও তোমরা মাত্র লেখক, এখনও শিল্পী হয়ে ওঠোনি।’ অথচ দেখছেন এক ‘অদৃশ্য নিয়ন্তা’ একটি ‘বিশেষ যুগের নকসা’ তাঁদের সামনে এঁকে ধরছে। যে যুগটি ১৯২৩ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে সীমিত। ‘আজ যে সকল ছোট ছোট বুভুক্ষু প্রতিভা সর্বহারার মতো রাত্রির মধ্যে আপন আপন প্রাণের তাড়নায় নৈশ অভিযানে চলেছে, তাদের ভিতরে ভবিষ্যৎকালের অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, নৃত্যশিল্পী, কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক, বিজ্ঞানী’ রয়েছেন বলে উপলব্ধি করছেন। তবু দম যেন তাঁর বন্ধ হয়ে আসছে।

এমনই এক শ্বাসরোধকারী পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে মাত্র পঁয়ষট্টি টাকা পকেটে নিয়ে তিনি রওনা দেন কাশী হয়ে কেদারবদ্রীর দিকে। বয়স তখন তাঁর সাতাশ। যাওয়া তাঁর অনেক দূর পর্যন্ত হয়েছিল। লিখেছেন, ‘১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আমি কেদারবদ্রী তীর্থযাত্রা করি এবং চারশো মাইলের কিছু বেশী (৬৪৪ কিলোমিটার) আমাকে পায়ে হেঁটে পরিক্রমা শেষ করতে হয়। সেই পরিক্রমা ঋষিকেশ থেকে আরম্ভ করে আলমোড়া জেলার রাণীক্ষেত নামক পার্বত্য শহরে তার শেষ। মোট আটত্রিশ দিনে এই যাত্রা সম্পূর্ণ হয়।’ এই কাহিনি নিয়েই লেখা হয়েছিল ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। যা তাঁকে পাকাপাকি ভাবে বাংলা সাহিত্য জগতে জায়গা করে দিয়েছিল এবং বাংলায় লেখা ভ্রমণ সাহিত্যের গতিমুখকেও বদলে দিয়েছিল। সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে প্রমথ চৌধুরী, সুভাষচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি রবীন্দ্রনাথও মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘তোমার লেখা শাস্ত্রিক পথ দিয়ে নয়, ভৌগোলিক পথ দিয়ে নয়। মানুষের পথ দিয়ে। কত শতাব্দী ধরে দুঃসাধ্যসাধনরত মানুষের দুর্গম যাত্রার প্রয়াস নিরবচ্ছিন্ন বয়ে চলেছে, এই তীর্থযাত্রা তারই পথিক।’ এই যাত্রাই হয়তো প্রবোধকুমারকে নৈরাজ্যবাদী থেকে প্রকৃতির উপাসকে বদলে দিয়েছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘পেগানিস্ট’।

প্রবোধকুমার সান্যাল, গজেন্দ্রনাথ মিত্র ও সুমথনাথ ঘোষ খুব বন্ধু ছিলেন। মাঝেমধ্যেই তিন বন্ধু বেরিয়ে পড়তেন পুরী, ভুবনেশ্বর, ঘাটশিলা, মধুপুর ইত্যাদি জায়গায়। কিন্তু যখনই হিমালয়ের দুর্গম পথে পাড়ি দেওয়ার ডাক আসত, তিনি একলা যেতেই পছন্দ করতেন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার এই নেশা তাঁর এতটাই ছিল যে, বাড়িতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা অসুস্থ থাকলেও তাঁকে থামানো যেত না। আজীবন চিরপরিব্রাজকের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিদেশের শহরে। এই ভাবেই তিনি একে একে লিখেছেন ‘দেবতাত্মা হিমালয়’, ‘উত্তর হিমালয় চরিত’, ‘গঙ্গাপথে গঙ্গোত্রী’। এ ছাড়া ‘দেশ-দেশান্তরে’, ‘ইতস্ততঃ’, ‘ভ্রমণ ও কাহিনী’, ‘পায়ের দাগ’, ‘হিমালয়ের শিখরে’তেও হিমালয় এসেছে আংশিক ভাবে। এই হিমালয়-অনুরাগ থেকেই প্রবীণ বয়সে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট’। যার সভাপতি হন আর এক হিমালয় অনুরাগী উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এডমন্ড হিলারি যখন এ দেশে এসেছিলেন, প্রবোধকুমার তাঁর মেজ ছেলে অতনুকে নিয়ে গিয়েছিলেন দেখা করতে। আসলে বাঙালিকে পাহাড়ে চড়ার নেশা তিনিই ধরিয়েছিলেন। তাঁর মুখে হিমালয়ের কথা শুনতে শঙ্কু মহারাজ থেকে শুরু করে অনেকেই আসতেন তাঁর বালিগঞ্জ টেরেসের বাড়িতে।

সাহিত্যের গোষ্ঠীতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না প্রবোধকুমার। মনে করতেন, প্রত্যেক সাহিত্যিকের নিজস্ব একটি ‘প্রতিষ্ঠাভূমি’ থাকে। সেখানেই থাকে তাঁর অনন্যতার পরিচয়। তাঁর এই প্রতিষ্ঠাভূমি ছিল কলকাতা শহর, বাংলার পল্লি ও প্রবাসের জীবন। ছাত্রজীবন থেকে গল্প লেখা শুরু করলেও সেই সময়ের অনেক গল্পই পাওয়া যায় না। ১৯২৩ থেকে ’৭৯ সাল অবধি তাঁর ছোট গল্পের রচনাকাল। এই সাতান্ন বছরে তিনি ২১৪টি গল্প লিখেছেন বলে জানিয়েছেন গবেষক ড. অজিতকুমার ভট্টাচার্য। তাঁর ছোট গল্পে অভিজ্ঞতার বিস্তার যেমন আছে, তেমনই আছে প্রখর বাস্তববোধ। তিনি লিখে গিয়েছেন, “পথেঘাটে গল্প খুঁজে বেড়িয়েছি— স্টিমারঘাটে, চটকলের ধারে, রেলস্টেশনে, বিদেশের ধর্মশালায়, মফস্বলের ওয়েটিং রুমে, তীর্থযাত্রার মেলায়। আমি লিখতুম মজুর, জেলে, রাজমিস্ত্রি, গাড়োয়ান, মুদি, ফড়ে এইসব চরিত্র নিয়ে। কারণ তাদের জীবনযাত্রাটা চোখে দেখতুম।”

প্রবোধকুমারের উপন্যাসও সেই জাতের। ১৯২৮ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত মোট ৫৩টি মৌলিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। যদিও তিনি উপন্যাস লিখতে শুরু করেন ১৯২৫ সালে ‘প্রমীলার সংসার’ দিয়ে। যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে। এ ছাড়া রয়েছে একটি অনূদিত উপন্যাস ‘বন্দী বিহঙ্গ’ ও চারটি বারোয়ারি উপন্যাস ‘অষ্টমী’, ‘পঞ্চদশী’, ‘ভালমন্দ’, ‘বান্ধবী’। আয়তনের দিক থেকে ‘হাসুবানু’ তাঁর সর্ববৃহৎ উপন্যাস। ১৯৪৭-এর বাংলাভাগকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা বিতর্কিত এই উপন্যাসটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪/৭/১৯৫৫ তারিখে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাজেয়াপ্ত করেছিল। এ ছাড়া ‘বনস্পতির বৈঠক’ ১৯০৫ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত তাঁর জীবনের বিতর্কিত স্মৃতিচারণ। যা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য দলিল বলে গণ্য হয়। তাঁর ‘দুই আর দুইয়ে চার’, ‘বাতাস দিল দোল’, ‘কাজললতা’, ‘কলরব’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘আলো আর আগুন’, ‘আঁকাবাঁকা’র মতো উপন্যাস আজও পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয়। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’-সহ বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। প্রবোধকুমার তাঁর লেখা কাহিনি থেকে তৈরি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজেও হাত লাগিয়েছিলেন। ‘প্রিয় বান্ধবী’র জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও পান। তাঁর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিল উত্তমকুমার, অরুন্ধতীদেবী থেকে সেকালের বাংলা চলচ্চিত্রের রথী-মহারথীদের। শিশিরকুমার ভাদুড়ি ছিলেন তাঁর নিকটাত্মীয়।

১৯৩৩ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতেই প্রবোধকুমার তাঁর ‘চিতার আলোয়’ গল্পটি সম্পাদককে দেন। পরের বছর থেকে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে তাঁর ‘জয়ন্ত’ উপন্যাসটি। অন্য দিকে ‘প্রবাসী’ পুজোসংখ্যায় তাঁর ‘অবিকল’ গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি লেখেন। প্রবোধকুমার এর পরে কবির সঙ্গে দেখা করতে যান। সেই সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ উপন্যাসের রাণী চরিত্রটির আসল পরিচয় তাঁকে জানাতে হয়। এই রাণী হয়ে উঠেছিলেন প্রবোধকুমারের সারা জীবনের সাহিত্য সৃষ্টির ‘মিউজ’।

প্রবোধকুমারের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে উদ্ধৃত করে গবেষক অজিতকুমার ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, প্ল্যানচেট করার অভ্যেস ছিল তাঁর। ১৯৪৭ সালে এমনই এক প্ল্যানচেটের আসরে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিতকুমার দত্ত ও ভবানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বসে রবীন্দ্রনাথের বিদেহী আত্মাকে ডেকে এনেছিলেন। প্রবোধকুমার রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুব ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি প্রবোধকুমারের মুখে একটি কবিতা শুনতে চান। ‘কঙ্কাল’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন তিনি।

প্রবোধকুমারের গৃহ ছিল না গৃহিণীর অভাবে। সেই অভাব মিটেছিল ১৯৪০ সালের ১৬ জানুয়ারি। ফরিদপুর জেলার বিপিনবিহারী মৈত্রর কন্যা জয়ন্তীকে তিনি বিবাহ করেন। সেই বছরেই তাঁদের প্রথম সন্তান বাণীর জন্ম হয়। এই সময় প্রবোধকুমার ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় চাকরি করতেন। কিন্তু বিয়ের পরের বছরই ১৯৪১ সালে সেই চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্য সাধনায় নেমে পড়েন। বয়স তখন ৩৬। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে আসেন চাকরি ছাড়ার আগে পরামর্শ নিতে। বিভূতিভূষণকে চাকরি ছাড়তেই পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রবোধকুমার।

বিয়ের পর থেকে প্রবোধকুমারকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমশ হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন অপরিহার্য সাহিত্যিক। প্রকাশ করতে শুরু করেন ‘পদাতিক’ সাপ্তাহিক পত্রিকা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদক তাঁর কাছ থেকে লেখা পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। অভিনন্দনপত্র, মানপত্র পেতে শুরু করেন। তিনি পঞ্চাশ বছরে পৌঁছলে ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকা তাঁর ‘সংবর্ধনা সংখ্যা’ প্রকাশ করে। সেই সংখ্যায় প্রবোধকুমারের সাহিত্য প্রতিভার নানা দিক নিয়ে লেখেন তৎকালীন বাংলা সাহিত্যের রথী-মহারথী প্রবীণ, নবীন ও সমবয়সিরা। পাকিস্তান ও বর্মায় সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন ‘আনন্দ’ পুরস্কার। নিখিলবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক পর্যটক হয়ে আমেরিকা গিয়েছেন। জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘দেবতাত্মা হিমালয়’ ভ্রমণ উপন্যাসের মুখবন্ধটি লিখে দিয়েছিলেন।

সাংসারিক না হয়েও তিনি ছিলেন সংসারের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁদের তিন কন্যা ও তিন পুত্রের মধ্যে এক পুত্র অকালে মারা যায়। সন্তান শোকে কাতর হয়েছিলেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। অনেক সময় লেগেছিল সে শোক সামলে উঠতে। তিন মেয়ে ও পুত্র অতনুর বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পুত্রবধূ ঋতুপর্ণার মনে আছে, তাঁকে দেখতে এসে প্রবোধকুমার তাঁর বাবাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘এসেছিলাম মেয়ে দেখতে, দেখে গেলাম পুত্রবধূ।’ ‘‘ভীষণ স্নেহপ্রবণ ছিলেন মানুষটি। যদিও খুব অল্প দিনই পেয়েছিলাম ওঁকে,’’ বলছেন ঋতুপর্ণা।

সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের (ভানুবাবু) লেখায় পাওয়া যায় প্রবোধকুমারের জন্মদিন পালনের বর্ণনা। “সকালে প্রণাম সেরে চা খেয়ে এলেও ভুরিভোজ হত রাত্রে। মাটিতে ফরাস বিছিয়ে বসতাম আমরা। উনি মাঝখানে বসে এক এক জনের পাতে এক এক রকম আহার্য তুলে দিচ্ছেন। প্রত্যেকের জন্য এক একটা আস্ত মুরগির রোস্ট।” ১৯৭৪ সালে রাশিয়ায় রাইটার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পালন করা জন্মোৎসবে উনি এক বার গিয়েছিলেন।

পরিব্রাজকের জীবন অবশ্য থেমে থাকেনি। কৈলাস ও মানস সরোবর ভ্রমণে গিয়ে মারাত্মক তুষারঝড়ের কবলে পড়েছেন। কুলু-মানালি, রাজস্থান সীমান্ত ঘুরেছেন। রাশিয়া গিয়ে সেখানকার সাহিত্য অনুরাগীদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পেয়েছেন। ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে সুইডেনের স্টকহোমে ভাইঝি জামাইয়ের সাহায্যে গিয়েছেন উত্তরমেরু অভিযানে। বয়স তখন তাঁর ৭৩। ১৯৭৯ সালে মধ্যপ্রদেশের বাস্তার জেলার দণ্ডকারণ্য অঞ্চল ঘুরতে গিয়ে জিপ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। তার পর থেকে দীর্ঘ ছ’মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বারাণসী যাওয়ার পথের সন্ধান করে বেড়ানো সেই শিশুর চলমান জীবনের ইতি হয় ৭৪ বছর বয়সে এই ভাবেই। সেই দুর্ঘটনায় ডান হাতের আঙুলে আঘাত পাওয়ায় নিজের হাতে আর লিখতেও পারতেন না।

১৯৮৩ সালে ১৭ এপ্রিল আটাত্তর বছর বয়সে ৬, বালিগঞ্জ টেরেসের বাড়িতে সাহিত্যিক প্রবোধকুমার সান্যালের জীবনাবসান ঘটে। মানবতীর্থের পথিক এই সাহিত্যিক রেখে যান তাঁর প্রশ্ন, “মানব-যাত্রী কী একদিন স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনায় তীর্থযাত্রা করবে না?”

ছবি: অত্রিকুমার সান্যাল, সোমাঙ্ক সান্যাল, অনন্যা সান্যাল, নির্মলেন্দু চট্টোপাধ্যায়

ঋণ: শান্তনু সান্যাল, ঋতুপর্ণা সান্যাল, ড. অজিতকুমার ভট্টাচার্য

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement