তরঙ্গায়িত: শিল্পী মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনীর একটি কাজ। সম্প্রতি বিড়লা অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত
মন্দিরা গঙ্গোপাধ্যায় স্বশিক্ষিত চিত্রকর। স্কুলের গণ্ডি শেষ করে কিছু কাল প্যারিসে কাটানোর সময়ে শিল্পকলার স্বল্প কালের পাঠ গ্রহণ করেন। কলকাতা থেকে সদ্য যাওয়া মন্দিরা তখন লোরেটো কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক। ’৮৭ সালে প্যারিসেই আমেরিকান সেন্টার ফর ফাইন আর্টসে তিন মাসের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন। ড্রয়িং, চারকোল, ইঙ্ক— প্রধানত এই মাধ্যমগুলিতেই তখন কিছু কাজ করানো হত ক্লাসে। পরে কলকাতায় ফিরে ধারাবাহিক চর্চা আর সে ভাবে করা হয়নি। এগারো বছর ব্যাঙ্কে চাকরি করেছেন। স্বেচ্ছাবসরের আগে ও পরে বিভিন্ন সময়ে জলরং, অ্যাক্রিলিক, অয়েল পেন্টিং স্বল্প দিনের জন্য শিখেছেন। আসলে ছবি আঁকার ঝোঁকটি প্রবল ভাবে পেয়ে বসার সময়টিকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েই পরবর্তী সময়ে চর্চা করে গিয়েছেন একাই। সদ্য তাঁর ৩২টি পেন্টিং সংবলিত একটি একক প্রদর্শনী শেষ হল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। এটি তাঁর তৃতীয় একক।
মন্দিরার সব ছবিই কিন্তু বিভিন্ন আলোকচিত্র বা রেফারেন্স থেকে গ্রহণ করা। মাত্র দু’-একটি ছবিতে নিজস্বতা উপলব্ধি করা গেলেও, সামগ্রিক কাজগুলিতে তা সম্পূর্ণ নয়। তবে তাঁর ছবির বিশেষ দিকটিতে একটি স্বকীয়তা কাজ করেছে। তা হল, রেফারেন্সের বাইরে গিয়েও তিনি ওই স্টাইলকে রেখে, স্পেস ও চার পাশের আবহকে নিজের মতো বিবর্তিত করার চেষ্টা করেছেন। কিছু ছবিতে তা স্পষ্ট প্রতিভাত। রং ও ছায়াতপের মাধ্যমেই হোক, রচনার ভারসাম্যকে সামলে আলো-আঁধারি বিন্যাসের ভিন্ন মেরুকরণেই হোক, তিনি সেখানে কিছুটা অন্য রকম নিঃসন্দেহে।
যে গুণ তাঁর পেন্টিংকে আলাদা একটি মাত্রা দিয়েছে তা হল, তাঁর ব্রাশিং, রঙের মেলানো-মেশানো স্নিগ্ধতা, উচ্চকিত আলো ও আপাত অন্ধকারের দৃশ্যকল্প, প্রয়োজনীয় সূক্ষ্মতা এবং ফিনিশিং। এখানে অনেক জায়গায় যদিও একটু ওভার-ওয়র্ক হয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি নিজে কিছু স্টাইলাইজ়েশনের ডিজ়াইনধর্মিতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ছবিতে কোথাও একটু হলেও কাঠিন্য এনে ফেলেছেন। তবুও মন্দিরার কাজে নিষ্ঠা আছে। তাঁর ক্যানভাসে সবই প্রায় অ্যাক্রিলিকের কাজ। কিছু কাগজে জলরং, দু’টি অয়েল। রঙের ঔজ্জ্বল্য ও মলিনতার প্রয়োজনীয়তাকে তিনি মানানসই একটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। এ সব ক্ষেত্রে অনুকরণের চেয়ে অনুসরণটাই চোখে পড়ে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কাজ এখানে উল্লেখ্য। সাদা থলের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা চেরি ফলের লাল ও আলো-অন্ধকারের মধ্যের হাইলাইট চমৎকার। একটি ইউরোপীয় ঘরানা টের পাওয়া যায়। অনেকটা প্রায় মোনোক্রোমের মতো ‘ইনফ্যান্ট’, ‘কাব ইন দ্য সান’, ‘টরসো’, ‘হারমিট উইথ আ কঞ্চ শেল’ কাজগুলিতে তাঁর পরিশ্রমের চিহ্ন বর্তমান।
অ্যাক্রিলিকের সুবিধেগুলিকে যত না কাজে লাগিয়েছেন, ততোধিক চেষ্টা ছিল তার ব্যবহারের ধরনে। যে কারণে ‘সি অ্যাট ডন’ কাজটিতে রঙের ঘনত্বে ইমপ্যাস্টোর স্টাইলটি প্রখর। ব্রাশিং ও সমগ্র কম্পোজ়িশনে গাঢ়ত্ব ও আলোর বিচ্ছুরণ অসাধারণ। তবে অন্যতম পরিশ্রমী কাজ হল ‘সামার রিলিফ’। শিশুর সারল্য ও উচ্ছ্বাস, একই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস দেখার মতো। বিশেষ করে তীব্র গতিসম্পন্ন জলের ধেয়ে আসার অবস্থা এবং ছড়ানো জলবিন্দু শিশুর উদোম শরীরে যে ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে, তাতে শিল্পীর নিবিড় অনুধাবন ক্ষমতা, তাকে অনুসরণ করে নিজস্বতায় ব্যবহার করা নজর কাড়ে! যেমন ‘রেনড্রপস অন রোজ়’ ছবিিটতে জলের টলটলে ফোঁটা অনবদ্য।
প্রদর্শনীতে দু’টি অয়েল পেন্টিং ছিল। ‘ক্যাম্প মর্নিং’ একটি শিশুর গাল ফোলা প্রতিকৃতি। অন্যটি ‘ওশান’। এই ওশান রেফারেন্স-কৃত হলেও ছবির সমগ্র জুড়ে তরঙ্গাভিঘাত ও আপাতনিরীহ তার কল্লোল, প্রস্তর জেগে থাকা জল, দূরে পাহাড়সদৃশ অসমাপ্ত দৃশ্য বা মেঘলা আকাশের বিস্তার— সব মিলিয়ে মন ভরানো ছবি। বোঝাই যায়, এখানে তিনি ছবির হুবহু দৃশ্যকল্পনা থেকে সরে এসে, কোথাও কোথাও নিজের মতো কাজ করেছেন।
তবে জলরঙে-কাগজে করা তাঁর ‘পপিস’, ‘অ্যাপল ব্লসম’, ‘উইন্ডি ডে’, ‘কাউবয়’, ‘বাটার কাপস’ কাজগুলি মনোগ্রাহী। এতে যতই রেফারেন্সকে প্রাধান্য দেওয়া হোক, ট্রিটমেন্ট ও জলরঙের স্বচ্ছতোয়া স্নিগ্ধতা মনে থাকবে। নিঃসন্দেহে অ্যাক্রিলিকের ‘ফ্লাওয়ার বাস্কেট’ ও অয়েলের ‘ওশান’ প্রদর্শনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’টি কাজ।