অতুল বসুর আঁকা লেডি রাণুর ছবি।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল। তখন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক কবি। বিরাট ব্যক্তিত্ব। রোজই তাঁর কাছে যেমন নানা মানুষের অসংখ্য অনুরোধ, উপরোধ নিয়ে আনাগোনা চলেছে, তেমনই আসছে অজস্র চিঠি। এমনই এক সময়ে ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে তাঁর কাছে এসে পৌঁছল একটি চিঠি। তাতে যা লেখা ছিল, তা পড়ে রবীন্দ্রনাথ থমকে গিয়েছিলেন। এমন চিঠি তিনি এর আগে কখনও পাননি।
‘রবিবাবু’ সম্ভাষণে চিঠিতে তাঁর কাছে যেমন জানতে চাওয়া হয়েছে তাঁরই লেখা কোনও গল্পের মানে, তেমনই কোনও গল্পের পরিণতিকে বদলে দেওয়ার পরামর্শ রয়েছে সেখানে। তখনও অবধি প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পত্রলেখক পড়ে ফেলেছে। আর তাই রবীন্দ্রনাথকে তার ‘খু উ উ উ উ উ উব’ দেখতে ইচ্ছে করছে। তাঁকে সে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিনি এলে নিজের ‘শোবার ঘরে’ তাঁকে শুতে দেবে আর লোভ দেখিয়েছে তার ‘পুতুলও’ দেখাবে। চিঠিটি এসেছে কাশী থেকে। ঠিকানা ২৩৫ অগস্ত্য কুণ্ড। পত্রলেখকের নাম শুধুই ‘রাণু’।
এমন এক চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ চিনেছিলেন পত্রলেখককে। ইচ্ছে ছিল উত্তর দেবেন সময় করে। কারণ রাণুর পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আগেই ঘটেছিল। কিন্তু সেই চিঠি যত্ন করে রাখলেও হারিয়ে গিয়েছিল। তার পর একদিন, ‘হঠাৎ না খুঁজতেই ডেস্কের ভিতর হতে আপনিই বেরিয়ে পড়ল’। আর তার পরেই শুরু হল স্নেহ ও কৌতুক ভরা অভিনব এক রবীন্দ্রপত্রধারা, যা আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অন্য এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
যামিনী রায়ের সঙ্গে।
রাণুর ভাল নাম প্রীতি অধিকারী। বয়স তখন ১১। বাবা ফণিভূষণ অধিকারী, কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের নামজাদা অধ্যাপক। মা সরযূবালা রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ পাঠিকা ও অনুরাগিণী। ফণিভূষণ নদিয়ার টুঙ্গি গ্রামের পণ্ডিত বংশের বেণীমাধব অধিকারীর পুত্র। বেণীমাধব ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞ। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি সন্ন্যাস নিলে তাঁর নাম হয় পরমহংস স্বামী যোগানন্দ। তাঁর এক শিষ্য কাশীতে খানিকটা জমিসহ একটি বাড়ি দান করেন। এই বাড়িতে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে জীবনের বাকি সময় কাটান।
বেণীমাধবের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে চার পুত্রের তৃতীয় জন ফণিভূষণ। তিনি নদিয়ায় শিক্ষালাভের পরে কর্মজীবন শুরু করেন নেপালের রাণা পরিবারের গৃহশিক্ষক হিসেবে। ক্রমে দিল্লির হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ও দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে ১৯০৫ সাল অবধি কাজ করে, অ্যানি বেসান্তের আহ্বানে তৎকালীন কাশীর হিন্দু সেন্ট্রাল কলেজে দর্শনের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এরই মধ্যে তাঁর বিয়ে হয় চন্দননগরের হরিমোহন চট্টোপাধ্যায়ের ছোট মেয়ে সরযূবালার সঙ্গে। ১৯১৪ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে ফণিভূষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। সরযূবালাও চন্দননগরের এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছিলেন। তাঁর বাবা হরিমোহন ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, সঙ্গীতজ্ঞ, ভাষা ও চিত্রকলাবিদ। সরযূবালার বড়দাদা কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় খুব গুণী মানুষ ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনিও ছিলেন রবীন্দ্র অনুরাগী এবং রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পেতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নিজ কর্মস্থল ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকা সম্ভব হয়নি তাঁর। তবে পুত্র বিশ্বনাথকে আশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
সরযূবালার জীবন তাঁর এই দাদার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনিই রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে সরযূবালার পরিচয় করিয়ে দেন। শৈশব থেকে সরযূবালা রবীন্দ্রনাথের যে কোনও কবিতা মুখস্থ বলতে পারতেন। সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। অ্যানি বেসান্তের থিয়োসফিক্যাল স্কুলে গান শেখাতেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে সরযূবালা একটি গান রচনা করেন, যার সুর দেন কালীপ্রসন্ন।
লেডি রাণু ও স্যর বীরেন।
ফণিভূষণও রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। ১৯১০ সালে কলকাতা থেকে কাশীতে তাঁর কর্মস্থলে যাওয়ার আগে কয়েক ঘণ্টার জন্য শান্তিনিকেতন ঘুরে গিয়েছিলেন এবং শান্তিনিকেতন নিয়ে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় তিনি একটি প্রশস্তি লেখেন। লেখাটির নাম ছিল ‘বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয়’। অবসর গ্রহণের পরে রবীন্দ্রনাথ ফণিভূষণকে শান্তিনিকেতন বিদ্যাভবনে ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে কাজ করার জন্য ডেকে নেন।
ফলে এঁদের সন্তানরাও যে রবীন্দ্র অনুরাগী হবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ফণিভূষণ- সরযূবালার চার কন্যা ও এক পুত্র। বড় আশা, মেজ শান্তি, সেজ প্রীতি (রাণু) ও ছোট ভক্তি আর সবচেেয় ছোট পুত্র অশোক। রাণুর জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯০৬ (মতান্তরে ২৫ অক্টোবর ১৯০৮) কালীপুজোর দিন, কাশীর ‘মিশ্রি পুকুরা’ নামে পাড়ার একটি বাড়িতে। রাণুর নিজের কথায়, “যে সময়ের কথা বলছি তখন আমরা চার বোন। ছোট ভাই অশোক তখনও হয়নি। ...আমার বড় বোন আশা (পরে আশা আর্য্যনায়কম) ছোট থেকেই ছিলেন অন্য রকম, কাজ না থাকলে একা থাকতে ভালবাসতেন, কিন্তু সংসারে সব রকম কাজে তাঁর ছিল অবাধ অধিকার। ...আমাদের ভাই ছিল না বলে বাবা বড় বোনকে ডাকতেন ‘বেটা’ ... আমাকে ‘বাবা’, মেজ বোন শান্তিকে ‘মুন্না’ আর ছোট বোন ভক্তিকে ‘ভুলা’। মনে পড়ে তখন বাবা কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কাজের শেষে বাড়িতে এসেই একসঙ্গে বেটা, মুন্না, বাবা, ভুলা বলে হাঁক পাড়তেন। আর আমরা ছুটে এসে বাবার কোলে চড়তাম। বাবা যেমন ছিলেন আদর্শবাদী শিক্ষক, অন্যদিকে পরম স্নেহময়।”
রাণুদের পাড়ার চার দিকে রাম, লক্ষ্মণ সীতা আর শিবের মন্দির ছড়িয়ে ছিল। সেখানে নিত্য পুজোর বন্দোবস্ত। রোজ গরিবদের প্রসাদ বিতরণ হত। রাণুদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হত প্রতি বছর। ফণিভূষণের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল। কাশীর সচ্ছল এক বাঙালি বাড়ির বিবরণ পাওয়া যায় রাণুর স্মৃতিকথা থেকে। “বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। মনে পড়ে আমার এক ছোট পিসিমার কথা। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে থাকতে না পেরে এসে উঠেছিলেন আমাদের বাড়িতে। বাবার বড় বোনের দুই ছেলে পটল আর গটল – তারা আমাদের এখানে থেকেই পড়াশুনা করতেন।”
রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সেই আংটি।
মা সরযূবালার চারিত্রিক দৃঢ়তার ছাপ পড়েছিল রাণুর চরিত্রের মধ্যে। তার বড় হয়ে ওঠা বাড়িভর্তি রবীন্দ্রনাথের নানা বইয়ের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথকে লেখা কাশীতে অ্যানি বেসান্ত স্কুলের ছাত্রীর প্রথম চিঠি প্রমাণ দেয় মাত্র এগারো বছর বয়সে রাণু ‘গল্পগুচ্ছ’র সব গল্প পড়ে ফেলেছে। এ ছাড়া পড়েছে, ‘গোরা’, ‘নৌকাডুবি’, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘রাজর্ষি’, ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’, ‘গল্পসপ্তক’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’, ‘রাজা’ ও ‘শারদোৎসব’। এই তালিকা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু রাণুর রবীন্দ্র নিমগ্নতা বলে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না।
উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষে জর্জরিত, বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে তখন বিশ্বভারতীর ভাবনা অঙ্কুরিত হচ্ছে। সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তিনি তখন রীতিমতো সরব, তাঁর বক্তৃতা শুনতে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। তখন এগারো বছরের রাণুর বালিকামনে ছাপ্পান্ন বছরের নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার পুতুলগুলোর মতোই। যাকে সে বলতে পারে, “শুনুন আপনি ভাল করে চুলটুল আঁচড়াবেন। কাপড়ও বেছে বেছে পরবেন, দিনরাত লিখবেন না। দুপুরবেলা ঘুমুবেন। আর রাত্রিতে শিগ্গির ঘুমুতে যাবেন।” কিন্তু সেই পুতুল তো রাণুর কাছে নেই। তাই তাঁকে সে পেতে চায়। অন্য পুতুলের পাশেই সাজিয়ে রেখে দিতে চায়। সেই সব পুতুলের নামও ছিল। যেমন— ছোটবৌ, গাবলোর বৌ, লিলি, লটি, সোনালি, টগর, জুঁই, গোলাপ। তাই সে লেখে, “আমার আপনার জন্য মন কেমন করে।”
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, কী ভয়ঙ্কর মৃত্যুর পরম্পরা তিনি পার হয়েছিলেন। অল্প কিছু বছরের ব্যবধানে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী মৃণালিনী, কন্যা রাণু এবং কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রকে হারিয়েছিলেন। তাঁর ভরা সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল মাত্র আট বছরের সময়সীমার মধ্যে। ফলে পিতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেখানে হঠাৎই ফণিভূষণের কন্যা রাণু যেন রবীন্দ্রনাথের সেই হারিয়ে যাওয়া ‘রাণু’ হয়ে ফিরে এসেছিল। তার উল্লেখ রয়েছে প্রথম উত্তরেই, “তোমার নামটি খুব মিষ্টি। আমার একটি মেয়ে ছিল, তাকে রাণু বলে ডাকতুম, কিন্তু সে এখন নেই।”এই শূন্যতাই রাণু অধিকারী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। অল্প বয়সে রাণু বাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথের লেখার নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠেছিল। দু’জনের মধ্যে যে পত্র বিনিময় শুরু
লিজিয়ঁ দ’নরে সম্মানিত হন লেডি রাণু।
হয়, তার হিসেব নিলে দেখা যাবে ১৯১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৪০ সাল অবধি রবীন্দ্রনাথের লেখা মোট চিঠি ২০৮টি। আর রাণুর লেখা মোট চিঠির সংখ্যা ৬৮। এই চিঠিগুলি প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে ‘বিচিত্র’ পত্রিকায় ও পরবর্তী কালে বই হয়ে প্রকাশিত হয় ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ নামে।
প্রথম পরিচয়পর্ব ১৯ অগস্ট ১৯১৭ থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯১৮, রবীন্দ্রনাথ রাণুকে চিঠি দিয়েছিলেন মোট ৯টি। চিঠিগুলি কৌতুকে ভরা। রবীন্দ্রনাথকে কাশীতে তাদের বাড়িতে আসতে বারবার অনুরোধ করছিল রাণু তার চিঠিতে। তাঁকে সে দেখতে চায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময় আর হয় না। মাঝে রবীন্দ্রনাথ আশ্রম বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভীমরাও শাস্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন কাশীতে রাণুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসতে। যত দিন তিনি কাশীতে ছিলেন রাণুদের বাড়ি রোজ যেতেন। সেখানে তিনি গেয়ে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গান। কিন্তু তবু রাণুকে ভোলানো যায় না। রবীন্দ্রনাথ রাণুকে ভয় দেখাতে লেখেন, “আমাকে দেখতে নারদ মুনির মত – মস্ত বড় পাকা দাড়ি।”
অবশেষে ১৯১৮ সালে ফণিভূষণ অসুস্থ হয়ে কলকাতায় আসেন চিকিৎসার জন্য। ১২ মে ১৯১৮, রবিবার কাশী থেকে রওনা হয়ে ১৩ মে কলকাতায় এসে তাঁরা ওঠেন ভবানীপুরের ৩৫ ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে। সেই বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে রাণু পরদিনই মঙ্গলবার রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখে এক চরমপত্র, “আপনি মঙ্গলবার দিন সন্ধ্যাবেলা নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ি আসবেন। নয়ত জন্মের মতন আড়ি।”
কিন্তু কোনও কারণে মঙ্গলবার রবীন্দ্রনাথ যেতে পারেননি। তাই পরদিন ১৫ মে রাণুকে নিয়ে ফণিভূষণ জোড়াসাঁকোয় আসেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “রাণু, দ্য লিটল গার্ল অফ ইলেভেন উইথ হুম ফাদার হ্যাজ হ্যাড সাচ অ্যান ইন্টারেস্টিং করেসপনডেন্স, কেম দিস ইভনিং উইথ হার ফ্যামিলি।” সেই তাঁদের দু’জনের প্রথম দেখা। কিন্তু মস্ত দাড়িওয়ালা নারদ মুনিকে দেখে রাণু নির্বিকার ছিল। ভয় পাওয়ার লক্ষণমাত্র ছিল না তার মুখে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমি যখন তোমায় লিখেছিলুম যে, আমাকে তুমি নারদমুনির মত মনে করে হয়ত ভয় করবে, তখন আমি কত বড় ভুলই করেছিলুম – আমি যে ছ ফুট লম্বা মানুষ, এত বড় গোঁফ দাড়িওয়ালা কিম্ভুতকিমাকার লোক, আমাকে দেখে তোমার মুখশ্রী একটুও বিবর্ণ হল না, এসে যখন আমার হাত ধরলে তোমার হাত একটুও কাঁপল না। অনায়াসে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলে, কণ্ঠস্বরে একটুও জড়িমা প্রকাশ হল না – একি কাণ্ড বল দেখি?”
কিন্তু পরের দিনই ১৬ মে ১৯১৮ রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতা বা বেলার ক্ষয়রোগে মৃত্যু হয়। হাসপাতালে পৌঁছেই রবীন্দ্রনাথ ডাক্তারদের কাছে খবর পান, বেলা নেই। ডাক্তাররা জানতে চান, তিনি মৃত কন্যাকে দেখতে চান কি না। রবীন্দ্রনাথ রাজি হননি। তিনি ফিরে আসেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “উই লেট হিম রিমেন ভেরি কোয়াইট আপস্টেয়ার্স, হি ওয়াজ় কম্পোজ়ড।” কিন্তু তবু বিকেলে তিনি বেরোলেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ফাদার ওয়েন্ট টু সি রাণু ইন দ্য আফটারনুন।”
এর পর প্রায় রোজই রাণুর সঙ্গে দেখা করতে তাদের ল্যান্সডাউনের বাড়িতে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়ে রাণুর সান্নিধ্য তাঁকে শোক থেকে উত্তীর্ণ হতে কতখানি সাহায্য করেছিল, তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন রাণুকে, “আমার খুব দুঃখের সময় তুমি আমার কাছে এসেছিলে; আমার যে মেয়েটি সংসার থেকে চলে গেছে সে আমার বড় মেয়ে; শিশুকাল থেকে তাকে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছি।” এ শোক থেকে বেরোতে রবীন্দ্রনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। লিখেছেন, “দুঃখ ভোগ করে দুঃখের উপরে উঠতেই হবে” তাই “খুব বেদনার সময় তুমি যখন তোমার সরল ও সরস জীবনটি নিয়ে খুব সহজে আমার কাছে এলে” আর “এক মুহূর্তে আমার স্নেহ অধিকার করলে তখন আমার জীবন কাজে বল পেলে।” এই জন্যই রাণু হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কন্যাসমা।
পরের মাসে কন্যার মৃত্যুশোক ও আমেরিকায় ‘হিন্দু ষড়যন্ত্র’ মামলায় রবীন্দ্রনাথকে অন্যায় ভাবে যুক্ত করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে, তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। ফণিভূষণের রোগ সারছিল না বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সপরিবার শান্তিনিকেতনে চলে আসতে বলেন। বারো বছরের রাণু বাবা-মায়ের সঙ্গে সেই প্রথম পৌঁছেছিল শান্তিনিকেতনে। রাণুর স্মৃতিকথায় পাই, “আমরা থাকতাম উত্তরায়ণের কাছেই একটা বাড়িতে।” বাড়িটি ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ি। এই বাড়িতেই ফণিভূষণ সপরিবার ১০ জুলাই অবধি ছিলেন।
শান্তিনিকেতনে থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে চেষ্টা করত রাণু। শান্তিনিকেতনে শিক্ষক পরিবারের মেয়েরা যেমন, লাবু (মমতা দাশগুপ্ত, ক্ষিতিমোহন সেনের দ্বিতীয়া কন্যা) রেখা (ঠাকুর, পরে মেনন) কল্যাণী (রায়, পরে শূর) প্রমুখ কয়েক জন বন্ধুও জুটে গিয়েছিল। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। রাণু লিখেছেন, সাগরময় “ছোটবেলায় ভীষণ ডানপিটে ছিল। ও গাছে উঠে আম আর পেয়ারা পাড়ত। আমার পাতা আঁচলে গাছের ওপর থেকে টপাটপ ফল পড়ছে।” এমন একটি ছবি রাণু অধিকারীর মনে চিরকালের মতো স্থায়ী ছিল। এই ভ্রমণে সে পরিচিত হয়েছে রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী, চার্লস অ্যান্ড্রু, সুরেন্দ্রনাথ কর, নন্দলাল বসুর মতো আরও অনেকের সঙ্গে।
ফিরে যাওয়ার দিন রবীন্দ্রনাথ নিজে বোলপুর স্টেশন থেকে ফণিভূষণের পরিবারকে ট্রেনে তুলতে আসেন। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই বোলপুর থেকে কাশীর পথে যেতে-যেতে ট্রেনে বসে রাণু চিঠিতে লেখে, “এখন গাড়ী চলছে। আমি খুব কাঁদছি।” আর কাশী পৌঁছে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের বয়স সাতাশ বছরে বেঁধে দিতে চেয়েছে রাণু। রবীন্দ্রনাথ, তার ভানুদাদা আসলে রাণুর কাছে হয়ে উঠেছিল এক স্বপ্নের ‘রাজকুমার’। প্রশান্তকুমার পালের মতে, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে “রাণুর সান্নিধ্য পাওয়ার স্বার্থবুদ্ধিও তাঁর আমন্ত্রণের পিছনে কাজ করেছিল।” তিনি প্রায়ই চিঠি লিখে রাণুকে শান্তিনিকেতনে আসতে বলেছেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হতে বলেছেন।
ক্রমশ রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে রাণু অধিকারী শান্তিনিকেতনের মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। বদলেছে দু’জনের মধ্যেকার চিঠির মেজাজও। এই একাত্মতা এতটাই ছিল যে, শান্তিনিকেতন আশ্রমের অর্থকষ্ট মেটাতে তেরো বছর রাণু স্কুল থেকে পাওয়া ছাত্রবৃত্তির তিরিশ টাকার পুরোটাই দান করেছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমকে, যা দিয়ে সুরেন্দ্রনাথের পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছিল আশ্রমের বিখ্যাত ঘণ্টাতলাটি। আশ্রমের ছাত্রছাত্রীরা তার বন্ধু হয়েছিল। শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা নিয়েছে। আবার রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে চেকস্লোভাকিয়ার চিত্রকর নেসচস্কি তার একটি প্রতিকৃতি এঁকেছেন। এমনকি সুন্দরী রাণুর কাল্পনিক ‘ন্যুড স্টাডি’ও তিনি করেছিলেন বলে জানিয়েছে রাণু নিজেই। এ ছাড়া শিল্পী অতুল বসু, প্রতিমাদেবী, অবনীন্দ্রনাথ, অসিত হালদার, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার তার প্রতিকৃতি এঁকেছেন। বোঝাই যায়, রাণু খুব সাধারণ ছোট্ট মেয়ে ছিল না রবীন্দ্রনাথের কাছে।
কিন্তু রাণুর ভালবাসায় অধিকারবোধের প্রকাশ ঘটছিল। তা দেখে রবীন্দ্রনাথ সাবধানও হয়েছেন পরের দিকে। ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সেই ভালবাসা যখনই বন্ধনের রূপ নিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ সেই বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে অস্থির হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রেরণাদাত্রী নতুন বৌঠানের ক্ষেত্রে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনই রাণুর ক্ষেত্রেও। রাণুকে থামাতে তিনি লিখেছেন, “আমি ভিতরের সৌন্দর্য্যকে সব চেয়ে ভালবাসি...মেয়েদের মনে এই সৌন্দর্য্যটি যখন দেখা যায় তখন তার আর তুলনা কোথাও থাকে না।” কিন্তু মেয়েরা যখন সংসারে জড়িয়ে পড়ে, সব কিছুকেই ‘আমার আমার’ করে। তখন সে “পৃথিবীর সব মহৎ লক্ষ্যকে আড়াল করে রাখে।”
রবীন্দ্রনাথের কথা সদ্য তরুণী বুঝতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার টান এতটাই জড়িয়ে ধরেছিল যে, একবার কাউকে কিছু না জানিয়ে রাণু একলাই শান্তিনিকেতনে পৌঁছে গিয়েছিল। এ ভাবে যাওয়ার ইচ্ছে রাণু চিঠিতে আগেই জানিয়েছিল। অবস্থার সামাল দিতে রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিলং পাহাড়ে। সেখানে রাণুর উপস্থিতি রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের ‘নন্দিনী’ চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাকে দিয়ে ‘নন্দিনী’ চরিত্রে অভিনয়ও করাতে চেয়েছিলেন। তা সম্ভব না হলেও জয়সিংহর চরিত্রে ৬২ বছরের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘বিসর্জন’-এর অপর্ণা ও ‘রাজা’ নাটকে সুদর্শনার ভূমিকায় অভিনয় করেছে রাণু।
রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে ‘বিসর্জন’ নাটকে অভিনয় পর্ব রাণুর জীবনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক বিপর্যয়ের সূচনা করেছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রতি রাণুর মনে যে ভালবাসা তৈরি হচ্ছে, তা রবীন্দ্রনাথ জানতেন। ‘বিসর্জন’ নাটকের মহড়ার জন্য রাণুকে অনেক দিন জোড়াসাঁকোয় থাকতে হয়েছিল। সে তখন বিবাহযোগ্যা এক নারী। তার রূপ, দৈহিক সৌন্দর্য ও মিশুকে স্বভাবের টানে অনেক যুবক পাণিপ্রার্থী হয়ে আসতে থাকে। এদের মধ্যে অনেককেই রাণু প্রশ্রয় দিয়েছিল। এই সব ঘটনা রবীন্দ্রনাথের জানা ছিল না, তা ভাবতে রাজি নন রবিজীবনীকার। রবীন্দ্রনাথ পরিণতি বিবেচনা না করেই কোনও কোনও পাণিপ্রার্থীকে নিয়ে রাণুর সঙ্গে মশকরা করেছেন। এমনকি কৌতূক করে নিজেকেও পাণিপ্রার্থী করেছেন। সরল অনভিজ্ঞতায় ১৬/১৭ বছরের রাণু তাঁকে বিশ্বাস করেছে আর কষ্ট পেয়েছে। এই পাণিপ্রার্থীদের একজন ছিলেন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের পুত্র পূর্ণেন্দুনাথ (ডাক নাম বুড়ো)। তার ও রাণুর মধ্যে কিছু চিঠি পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশান্তকুমার পাল। চিঠিগুলি সবই ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে লেখা। পূর্ণেন্দুকে থামাতে রবীন্দ্রনাথ তাকে তিরস্কারও করেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যত দিনে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন, তত দিনে রাণুর প্রণয়ীরা পৌঁছে গিয়েছে কাশীতে। কেউ-কেউ প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাণুর নামে কলঙ্কজনক চিঠি লিখতে শুরু করেছে তার বাবা-মাকে। রাণুর বিয়ে দিয়ে তাঁরা সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে সচেষ্ট হয়েছেন। এতে রবীন্দ্রনাথ অসহায় বোধ করেছেন। রাণুর বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্রের সন্ধানে নেমেছেন। কিন্তু ফণিভূষণ ও সরযূবালা রবীন্দ্রনাথের উপরে আর ভরসা করেননি। সাহিত্যিক অনুরূপা দেবীর দেওয়া স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে বীরেনের সঙ্গে ‘সম্বন্ধ প্রস্তাব’ গ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ বিদেশে থাকাকালীন।
কিন্তু পূর্ণেন্দু হাল ছাড়েনি। মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে রাণুর বিয়ে বন্ধ করার জন্য। রবীন্দ্রনাথকেও ছেড়ে কথা বলেনি। আবার স্যর রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী লেডি যাদুমতীকে রাণুর নামে কলঙ্ক রটিয়ে চিঠি লিখেছে। যাই হোক, শেষ অবধি বিয়ে নির্বিঘ্নে হয়েছিল। তবে স্যর রাজেন্দ্র জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা’ বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব মানেননি। পাকাদেখা থেকে বিয়ের সব অনুষ্ঠানই হয়েছিল রাজেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হ্যারিংটন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে। রবীন্দ্রনাথ সবই বুঝেছিলেন। যে সামাজিক অসুবিধে ও অসম্মান স্যর রাজেন্দ্র ও ফণিভূষণ ভোগ করেছিলেন, তার জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করেছিলেন। তাই প্রথমে ভেবেছিলেন রাণুর বিয়েতে তিনি যাবেন না। কিন্তু রাণুর মনে আঘাত দিতে চাননি বলে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন সোনার বাক্সে নিজের কাটা চুল, যা ছোট্ট রাণুর অনেক দিনের চাহিদা ছিল। রবীন্দ্রনাথের এই সময়ের মানসিক অস্থিরতার বিবরণ রয়েছে ইন্দিরাদেবী চৌধুরানীর ‘রোজনামচা’ বা দিনলিপিতে।
এক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার থেকে রাণু প্রবেশ করেছিলেন তৎকালীন কলকাতার এক উচ্চবিত্ত শিল্পপতি পরিবারে। সেখানে বিপুল বৈভব ও ইংরেজ আদবকায়দার সঙ্গে তাঁকে মানিয়ে নিতে হয়েছিল। রাণু ও বীরেন তিন সন্তানের জন্ম দেন— গীতা, রমেন ও নীতা। ভানুদাদার রাণু ক্রমশ বদলে গিয়েছিলেন লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়-এ। রাণুর জীবনালেখ্যর রচয়িতা সমর ভৌমিক রাণুর শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, “মেয়েরা অন্তপুরিকা, ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের লোক হলেও রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীল মনোভাব রবীন্দ্রনাথের কাছে অবাধে যাবার প্রতিকূল ছিল।” তাই দেখা যায়, বিয়ের পরে ভানুদাদাকে লেখা রাণুর চিঠির সংখ্যা কমে অনিয়মিত হয়ে এসেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নে পৌঁছেও রাণুর প্রতি তাঁর স্নেহ বজায় রেখেছেন। রাণুকে লেখা প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথের শেষ চিঠির তারিখ ১৫/১১/১৯৪০, মৃত্যুর ন’মাস আগে।
তবে রবীন্দ্রনাথ রোগশয্যায় শুয়েও রাণুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন হোয়াইট মেটালের মাঝখানে চড়ুই পাখির ডিমের মতো চোখধাঁধানো নীলা। তার চারপাশ জুড়ে উজ্জ্বল আঠারোটা ছোট্ট হিরের টুকরো বসানো একটি আংটি। বলেছিলেন, “হারাস না। বাড়ির জিনিস।” যা ১৩ জুলাই ১৯৭৪, ডিনার টেবল থেকে হারিয়ে যায় ও সারা কলকাতা জুড়ে হইচই পড়ে যায়। আংটি অবশ্য ফিরে পেয়েছিলেন রাণু।
এর পর নিজ গুণে রাণু ইঙ্গ-বঙ্গ পরিবারের ঘরনি হয়েও রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন থেকে পাওয়া তাঁর শিল্পবোধকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় শিল্পচর্চার জগতের ‘লেডি’ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর হাতে গড়া ‘অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস’-এর নাম বিশ্বের শিল্পমহলে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সে ইতিহাসকে রাণুর জীবনের দ্বিতীয় ভাগ বলা যায়। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সূচনা হয় ১৯৩৮ (মতান্তরে১৯৩৩) সালে ভারতীয় জাদুঘরের একটি কোণে। উদ্যোগকর্তাদের মধ্যে ছিলেন প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় ও ডা. ডি সি ঘোষ। এঁরাই ১৯৪৫ সালে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়কে যুক্ত করেন অ্যাকাডেমির সঙ্গে।
সে সময়ে কলকাতায় কোনও শিল্প প্রদর্শশালা ছিল না। ব্যাপারটা প্রথম নজরে পড়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর। পঞ্চাশের দশকে তিনি কলকাতায় আসেন ইহুদি মেনুহিনের কনর্সাট শুনতে। তখন পাশে বসা রাণুকে তিনি কিছু একটা করতে বলেন। এগিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তিনি উদ্যোগ নিয়ে সরকারি জমির ব্যবস্থা করে দেন। মার্টিন বার্নের প্রাণপুরুষ স্যর বীরেন মুখোপাধ্যায় সেখানে আজকের অ্যাকাডেমি ভবনটি নির্মাণ করে দেন।
অ্যাকাডেমির দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস লেখার জন্য আরও বড় পরিসরের প্রয়োজন। কিন্তু যা না বললে রাণুর জীবনকথা অসম্পূর্ণ থেকে যায় তা হল, স্বাধীন ভারতে এই অ্যাকাডেমি নতুন এক ভারতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। চিত্রকলা, নাট্যকলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আজও জীবন্ত।
ফরাসি সরকারের লিজিয়ঁ দ’নর সহ আরও অন্যান্য সম্মানে ভূষিত ভারতীয় শিল্পজগতের শেষ লেডি, রাণু মুখোপাধ্যায় ১৫ মার্চ ২০০০ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান।
তথ্যসূত্র:
রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল
রাণু মুখোপাধ্যায়ের জীবনালেখ্য: সমর ভৌমিক