বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু

এই প্রবাদবাক্য সত্যি করে তোলার পালা এ বার। জল বাঁচাবেন কী করে? ভেবে দেখার সময় এসেছেসম্প্রতি চেন্নাইয়ে জলকষ্টের চিত্র সারা দেশের সামনে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালেই হয়তো ভারতের ২০টির বেশি শহর জলশূন্য হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে কিছু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া দরকার।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share:

ঘুম থেকে উঠে জলের বোতলের দিকে হাত বাড়িয়ে হতাশ হলেন, জল নেই। শুকনো ঢোঁক গিলে বাথরুমে গিয়ে দেখলেন, সেখানেও জল নেই। রান্নাঘরের বেসিনেও একই অবস্থা। উপায়? খোঁজ নেওয়া যাক পাড়ায়। জানালার বাইরে চোখ রাখতেই দেখলেন, আপনার বাড়ির সামনে থেকে লম্বা লাইন, জল নেওয়ার। সেই লাইনে পাড়ার ডাক্তার-বদ্যি থেকে শুরু করে স্কুলমাস্টারও অপেক্ষমান। ভাবছেন, নিশ্চয়ই কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছেন! কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন কড়া বাস্তবে পরিণত হতে খুব দেরি নেই, যদি না আমরা এখন থেকেই সাবধান হই।

Advertisement

সম্প্রতি চেন্নাইয়ে জলকষ্টের চিত্র সারা দেশের সামনে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালেই হয়তো ভারতের ২০টির বেশি শহর জলশূন্য হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দেশের নাগরিক হিসেবে কিছু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া দরকার। যেখানে সমস্যার নাম জল, যার অপর নাম জীবন। এখন থেকেই না হয় শুরু করা যাক জল বাঁচানোর প্রচেষ্টা। দেখা যাক, বিন্দু বিন্দু জল বাঁচিয়েই সিন্ধু তৈরি করা যায় কি না!

Advertisement

রোজকার রুটিনে

প্রত্যেক দিন পরিবার পিছু খরচ হয় প্রায় ৬০ গ্যালন জল! স্নান, শৌচকার্য, রান্না, জামাকাপড় কাচা ও খাওয়ার জন্য প্রত্যেক দিনই প্রায় এই পরিমাণ জল কাজে লাগে। দৈনন্দিন কাজে জলের এই ব্যবহার যদি সব ক্ষেত্রেই অল্প অল্প করে কমানো যায়, তা হলেই অনেকটা জল বাঁচানো সম্ভব।

•প্রথমেই বাড়ির সব কল, পাইপ ও সিস্টার্ন ঠিক আছে কি না, দেখে নিন। বাড়ির কোথাও জলের লিকেজ থাকলে সারিয়ে ফেলুন।

•চেষ্টা করুন জামাকাপড় জমিয়ে সপ্তাহে এক বার ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতে। হাতে কাপড় কাচার চেয়ে ওয়াশিং মেশিনে জল অনেকটাই বেশি লাগে।

•যে কোনও কাজের সময়ে বালতিতে জল ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। ধরুন, স্নানের সময়ে শাওয়ারের তলায় না দাঁড়িয়ে বালতিতে জল ভরে স্নান করুন। পরিবারের প্রত্যেকের জন্য এক বালতি জল ধার্য করতে পারেন। এতে জল খরচের হিসেব থাকবে। শাওয়ার চালিয়ে স্নান করলে অনেকটা জল এমনিতেই নষ্ট হয়।

•বাড়ির ট্যাঙ্ক ভরার জন্য পাম্প চালালে তা ঘড়ি দেখে বন্ধ করুন। ট্যাঙ্কের ওভারফ্লো করা জল বাঁচাতে অ্যালার্ম বসাতে পারেন। এতে ট্যাঙ্ক ভরে উঠলেই অ্যালার্ম বেজে আপনাকে সতর্ক করবে।

•একই ভাবে দাঁত মাজার সময়ে বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সময়েও কল বন্ধ রাখুন। শুধু মুখ বা হাত ধোয়ার সময়ে কল খুলুন।

•প্রত্যেক দিন ঘর না মুছে ড্রাই ক্লিন অর্থাৎ মব দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে পারেন।

•গাড়ি পরিষ্কারের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। হোস পাইপে জল ব্যবহার না করে বালতির জলে কাপড় ভিজিয়েও কিন্তু গাড়ি পরিষ্কার করা যায়। এতে জলের অপচয় কমবে।

•বাড়িতে বাচ্চারা থাকলে তাদের স্নানের সময়ে একটু খেয়াল রাখুন। বাচ্চারা অনেক সময়েই জল নিয়ে খেলা করে জল নষ্ট করে। ফলে সে দিকেও সাবধান হতে হবে।

জলের পুনর্ব্যবহার

•আনাজ ধোয়া বা চাল ধোয়া জল ফেলে না দিয়ে বালতিতে জমিয়ে রাখুন। এই জল গাছে দিন। এতে জল নষ্ট হবে না, আবার গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টিও জোগাবে।

•জামাকাপড় কাচার জল ফেলে না দিয়ে রেখে দিন। বাথরুম পরিষ্কার করা বা দেওয়ালের টাইল্‌স মোছার কাজে ব্যবহার করুন। জামাকাপড় কাচার পরে যে পরিষ্কার জলে তা ধুয়ে নেন, সেটা না ফেলে, তা দিয়ে ঘর মুছে নিন। একই জলে একাধিক কাজ হয়ে যাবে। প্রয়োজন শুধু ঠিক মতো পরিকল্পনা করার।

কিন্তু শুধু জল বাঁচিয়ে জলের পরিমাণ বাড়ানো তো সম্ভব নয়, তার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

রেন ওয়াটার হারভেস্টিং

ক্রান্তীয় অঞ্চলে আমাদের দেশ। ফলে বরুণ দেবের হাত রয়েছে মাথার উপরে। শুধু জানতে হবে এই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপায়। রুফটপ রেনওয়াটার হারভেস্টিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টির জল দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা যায়। বাড়িতে রুফটপ হারভেস্টিং করা সহজ। তবে শুরুতে কিছু খরচ করতে হবে জিনিস কেনার জন্য। দেখে নিন কী ভাবে করবেন।

রুফটপ রেন ওয়াটার হারভেস্টিং: দরকার: ক্যাচমেন্ট, ট্রান্সপোর্টেশন, ফার্স্ট ফ্লাশ ও ফিল্টার। ক্যাচমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন বাড়ির ছাদ। ট্রান্সপোর্টেশনের জন্য রেন পাইপ। এই রেন পাইপের মুখেই বৃষ্টির জল ভাগ করার জন্য কাজে লাগান ফার্স্ট ফ্লাশ। ফিল্টারের জন্য ব্যবহার করতে পারেন স্যান্ড-গ্র্যাভেল বা চারকোল কিংবা স্পঞ্জ ফিল্টার। তার জন্য বাড়ির কাছেই মাটির নীচে বড় গর্ত খুঁড়ে নিতে হবে। সেখানে সবচেয়ে নীচের স্তরে থাকবে পেবলস বা নুড়ি, তার উপরে গ্র্যাভেল এবং সবচেয়ে উপরে থাকবে বালি। প্রতিটি স্তর নেটের জাল দিয়ে একে অপরের থেকে আলাদা করতে হবে। এটি হল স্যান্ড ফিল্টার। চারকোল ফিল্টার বানাতে জলের ড্রামে সবচেয়ে নীচে ২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা পর্যন্ত গ্র্যাভেল, তার উপরে ২৫ সেমি বালি, তার উপরে ১০ সেমি চারকোল ও তার উপরে ১০ সেমি গ্র্যাভেলের স্তর রাখতে হবে। একই ভাবে নেট দিয়ে এখানেও স্তরের মাঝে ভাগ করতে হবে।

পদ্ধতি: ছাদের জল রেন পাইপ দিয়ে নীচে আসবে। পাইপের মুখে থাকবে মেশ ফিল্টার। এতে জল প্রাথমিক ভাবে শোধিত হবে। এর পরে ফার্স্ট ফ্লাশের পরে জল সরাসরি এসে পড়বে ফিল্টারে। পরিশোধিত জল আবার পাইপের মাধ্যমে নিয়ে যেতে হবে জল সংরক্ষণ করার ট্যাঙ্কে। সেখান থেকেই বাথরুম, রান্নাঘর ও অন্যত্র পৌঁছে যাবে পরিশোধিত জল।

বৃক্ষরোপণ

পরিবেশ বাঁচাতে ও জলের জোগান বাড়াতে সকলের আগে প্রয়োজন গাছের। তাই অবিলম্বে বৃক্ষরোপণ শুরু করা জরুরি। প্রত্যেকে নিজের বাড়ির সামনেই যদি কিছু কিছু করে গাছ লাগান, তা হলেই দেখবেন, কাজ অনেকটা এগিয়ে যাবে। তবে আম, কদম, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার মতো বড় ছায়াপ্রদানকারী গাছ লাগানোই শ্রেয়। যে কোনও নার্সারিতে তার চারাও পেয়ে যাবেন।

আগামী এক মাস প্রতি রবিবার প্রত্যেকে যদি একটি করেও গাছ পোঁতেন, তা হলেই প্রকৃতির দিকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। শুধু গাছ পুঁতলেই অবশ্য হবে না। গাছ বড় হওয়া পর্যন্ত তার দেখাশোনা করাও জরুরি। অনেক চারাগাছ গরু, ছাগলে খেয়ে যায়। তাই গাছ পুঁতে চারপাশে অবশ্যই লোহার খাঁচার মতো গার্ড বসাতে হবে। বাড়ির কাছে ফাঁকা জমিতে গাছ পুঁতলে তার পরিচর্যাও সহজ হবে।

এই পৃথিবী সুজলা, সুফলা থাকলে আখেরে লাভ হবে আমাদেরই। নিজেদের বাঁচানোর তাগিদেই প্রকৃতিকে রক্ষা করার কিছু কিছু সংকল্প নেওয়া যাক এখন থেকেই...

মডেল: ঐশ্বর্য সেন; ছবি: অমিত দাস; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত; পোশাক: ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল, গড়িয়াহাট; লোকেশন: ভর্দে ভিস্তা, চকগড়িয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement