নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: পরিমল গোস্বামী
(১)
বাইরে মেঘ। হয়তো তাই ভিতরেও জল থইথই... কোরাসে বর্ষার গান গেয়ে চলেছেন কয়েক জন যুবক। কাঠের বেঞ্চে উঠছে তবলার বোল। ওদের এক জনের গলা সপ্তমে।
দুম্... ছন্দপতন। দরজা ঠেলে ঢুকলেন এক সৌম্যকান্তি পুরুষ। মুহূর্তে সব চুপ! ‘পুরো গান শেষ না করলে ক্লাস নেব না,’ সিদ্ধান্ত জানালেন ‘স্যার’। অগত্যা শেষমেশ কাঁপতে কাঁপতে ওই সপ্তমে গলা তোলা ছেলেটিই গেয়ে দিলেন গানটি। স্যার পড়াতে শুরু করলেন। পড়ানো নয়, যেন ছবি আঁকলেন ‘রক্তকরবী’র বিশু পাগলের।
ওই ছেলেটির সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কটি অবশ্য আরও নিবিড়। ছেলেটি মাস্টারমশাইয়ের লেখা ‘রামমোহন’ নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করল। মিলল সারা ভারত বিশ্ববিদ্যালয় নাটক প্রতিযোগিতার সেরার শিরোপা। স্যার আশীর্বাদ জানালেন, ‘দেখবে, তুমি একদিন অনেক বড় অভিনেতা হবে— অনেক বড়— আর তখন আমি বসে বসে তোমার জীবনী লিখব।’ মাস্টারমশাইকে প্রণাম করেই অভিনয় শুরু করল ছেলেটি।
আশীর্বাদ বৃথা যায়নি। বিস্ময়ে চোখ বড় করে বাঙালি দেখল, তাঁদেরই ঘরের ছেলের অভিনয়কে অভিনন্দন জানাল আন্তর্জাতিক দর্শক। আজও যিনি সমান ভাবে আমাদের অবাক করেন।
ছেলেটি সিটি কলেজের প্রাক্তনী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘স্যার’ হলেন তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ‘টি.এন.জি’। ভারতীয় বৌদ্ধিক সমাজে যাঁর পরিচয় সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হিসেবে।
প্রত্যক্ষ ছাত্র সৌমিত্র ছাড়াও বাঙালির বড় আপনজন আরও দু’জন মানুষের সঙ্গেও জড়িয়ে নারায়ণবাবু। ২২এ পটলডাঙা স্ট্রিটের (২০, পটলডাঙা নয়) বাড়িতে নারায়ণবাবু আর তাঁর স্ত্রী আশাদেবীর সংসার। ছেলে অরিজিৎ তখন বেশ ছোট।
এমনই একদিন বাড়িতে বিশেষ এক জন এসেছেন। খবরটা চাপা থাকল না। বাইরে ভিড় জমেছে। ওই আগন্তুককে ছুঁয়ে না দেখা পর্যন্ত নড়বে না জনতা। নারায়ণবাবু বাইরে এসে উপস্থিত ভিড়কে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বিশেষ লাভ হল না। শেষমেশ পুলিশ ডাকতে হল।
আসলে বাড়িতে এসেছিলেন উত্তমকুমার। সিনেমার একটি চরিত্র বুঝতে। শুধু উত্তমই নন, এক বার নারায়ণবাবুকে যেতে হয় সুচিত্রা সেনের বাড়িতেও।
পঞ্চাননতলার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে গল্পটা শুনিয়েছেন ছেলে অরিজিৎ। সেই সময় হরিসাধন দাশগুপ্তের ‘কমললতা’ সিনেমার শুটিং চলছে। নাম ভূমিকায় মহানায়িকা। তাই অনুরোধ নারায়ণবাবুকে, ‘যদি বাড়ি এসে কিছু খুঁটিনাটি বিষয় একটু বুঝিয়ে দেন।’ খানিক কথাবার্তার পরেই সুচিত্রার জিজ্ঞাসা, ‘দাদা, ঠিক হচ্ছে তো?’ জিজ্ঞাসাটা সুচিত্রা ঠিক মানুষকেই করেছেন। কারণ উত্তম-সুচিত্রার ওই সিনেমার কাহিনি বিন্যাস, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনার গুরুদায়িত্ব যে নারায়ণবাবুরই।
এ ছাড়া ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘ইন্দিরা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’, ‘সাহারা’ প্রভৃতি অজস্র সিনেমায় নারায়ণবাবু চিত্রনাট্যকারের দায়িত্ব সামলেছেন। শুধু চিত্রনাট্যই নয়, ‘চারমূর্তি’, ‘নন্দিতা’, ‘সঞ্চারিণী’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘টোপ’— বহু বার নারায়ণবাবুর লেখা ফিরে এসেছে সিনেমার পরদায়। গানও লিখেছেন ‘ঢুলি’ ছবিতে।
বনফুলের সঙ্গে
(২)
তবে সিনেমা নয়, নারায়ণবাবুর সবচেয়ে তৃপ্তি বোধহয় পড়ানোয়। পড়িয়েছেন জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজ, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস নিয়েছেন সাউথ সিটি কলেজের (বর্তমান শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ) মর্নিং সেকশনেও। যদি সাহিত্য-অধ্যাপনার কোনও ইতিহাস রচনা করা যায়, তা হলে বোধ হয় বিশেষ একটি অধ্যায়ই ছাড়তে হবে নারায়ণবাবুর জন্য।
কেন এমনটা বলা?
বর্ণনাটা দিচ্ছেন শঙ্খ ঘোষ। এক স্পেশ্যাল ক্লাসের। অন্তত তিনশো পড়ুয়ার দাবি, স্যারের ক্লাস চাই। তা, শুরু হল ক্লাস। তিল ধারণের জায়গা নেই। এমন সময়ে ঢুকলেন অত্যন্ত গৌরবর্ণ নারায়ণবাবু। ছ’ফুট ছুঁই ছুঁই লম্বা। গায়ে ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। ক্লাসে তখনও পড়ুয়াদের অনেকে বসার জায়গা পাননি। পড়ানো শুরু করলেন নারায়ণবাবু। পড়ুয়াদের কেউ দেওয়ালে, কেউ বা অন্যের পিঠে খাতা রেখে ‘নোট’ নেওয়া শুরু করলেন। আনন্দে বোধ হয় খানিক উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন টি.এন.জি। বললেন, ‘আগে জানলে তো রিপোর্টারদের একটা খবর দিতাম, ছবি নিয়ে যেত।’
রিপোর্টার দরকার পড়েনি এমন অধ্যাপকের। কারণ তাঁর ছাত্র বাৎসল্য তো যে সে জাতের নয়।
তার প্রমাণ অন্তত দু’টি ঘটনা।
স্থান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষাতত্ত্ব পড়াচ্ছেন এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক। এক ছাত্র ক্লাসের বদলে ফিসফিসিয়ে আড্ডাতেই বেশি মনোযোগী। সে দিকে তাকিয়েই অগ্নিশর্মা অধ্যাপকের নির্দেশ, ‘এমন একটি বাক্য বলো, যাতে বিদেশি ভাষা আছে।’
বন্যা দুর্গতদের জন্য চাঁদা সংগ্রহের কাজে
সেই ছাত্র একটুও ঘাবড়ালেন না। কিন্তু যে বাক্যটি বলে ফেললেন, তা অধ্যাপকের কাছে ‘অশ্লীল’ ঠেকল। মুহূর্তে সেই ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের। প্রমথনাথ বিশী, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, আশুতোষ ভট্টাচার্যদের মতো দিকপাল অধ্যাপকেরা বসে। তলব করা হল ছাত্রটিকে। ছাত্রটির অপরাধ— তিনি দুষ্টুমি করে ‘কোমর’ সংক্রান্ত একটি বাক্য বলেছেন। কিন্তু নারায়ণবাবু যখন রয়েছেন, তখন ছাত্রের ভয় কী! স্বভাবরসিকতায় তিনি বাক্যটিকে লঘু করে দিলেন। তা শুনে প্রমথবাবু বললেন, ‘তুমি কোমর নিয়ে বাক্য রচনা করেছ বলে তোমাকে সতর্ক করে দেওয়া হল। ভবিষ্যতে—।’ এমন সময় নারায়ণবাবু বলে উঠলেন, ‘ওই কোমর কার? নারী না পুরুষের?’ প্রমথনাথ ছাত্রকে বললেন, ‘ওই বিতর্কে আমরা যেতে চাই না। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে। যাও।’ নিস্তার পেলেন ছাত্র সমরেশ মজুমদার।
দ্বিতীয় ঘটনাটির সঙ্গে জড়িয়ে বিশিষ্ট গবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। এমএ পড়াকালীন বা তার কাছাকাছি কোনও এক সময়ের ঘটনা। ঘটনাস্থল কলেজ স্ট্রিট। প্রিয় কালো রঙের গাড়ির দরজা খুলে উঠলেন মাস্টারমশাই। কাছেই দাঁড়িয়ে ছাত্র অমিত্রসূদন। বললেন, ‘আসবে?’ গাড়িতে চড়লেন অমিত্রসূদন। গন্তব্য তখনও অজানা ছাত্রের কাছে।
গাড়ি থামল কলকাতার এক স্টুডিয়োয়। স্টুডিয়োয় ঢুকে রীতিমতো থ’ অমিত্রসূদন। সামনে দাঁড়িয়ে রামমোহনরূপী স্বয়ং বসন্ত চৌধুরী। শুটিং চলছে নারায়ণেরই নাটক অবলম্বনে সিনেমা ‘রাজা রামমোহন’-এর।
নারায়ণ এমনই এক ব্যক্তিত্ব যে, সে কালে সিটি কলেজের ছাত্রনেতারা পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি দিতেন, ‘বাংলা ক্লাসে নারায়ণবাবুকে এনে দেব।’
তবে এমন জনপ্রিয়তা এক দিনে হয়নি। এর জন্য পরীক্ষাও দিতে হয়েছে নারায়ণকে, হয়তো বা অজান্তেই। তিনি ক্লাসে কখনও বই নিয়ে পড়াতেন না। অথচ দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য থেকে অবলীলায় অজস্র উদ্ধৃতি দিতেন। খানিক সুরেলা কণ্ঠে পাতার পর পাতা মুখস্থ বলতেন। স্তম্ভিত হয়ে যেেতন পড়ুয়ারা। এক দিন দুই বন্ধুর এক জন ঠিক করলেন, স্যারকে একটু পরীক্ষা করলে কেমন হয়!
‘স্যার রবীন্দ্রনাথের ‘বনবাণী’ কাব্যটা তো পাঠ রয়েছে... আপনি একটু বুঝিয়ে দেবেন।’ স্যার এক কথায় রাজি। দু’জনকে নিয়ে একটি ফাঁকা ক্লাসে গেলেন তিনি। আর তার পর বলতে লাগলেন, ‘ওটা ১৯৩১ সালে বেরিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের তখন ৭০ বছর চলছে... প্রথম কবিতাটা হল ‘বৃক্ষবন্দনা’— অসাধারণ। শুনবে?’ আড়াই পাতার কবিতাটি ঝাড়়া আবৃত্তি করলেন স্যার। দুই ছাত্রই মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। দু’জন, পরবর্তী সময়ের সাহিত্যের দুই দিকপাল অধ্যাপক উজ্জ্বল মজুমদার এবং সুধীর চক্রবর্তী।
মাস্টারমশাইয়ের এমনই ছিল স্মৃতিশক্তি।
এই স্মৃতিশক্তির সাক্ষী তাঁর সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তেতলায় চায়ের আড্ডা চলছে। আচমকা প্রবেশ প্রমথনাথ বিশীর। একটু যেন চিন্তিত।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করলেন এক অধ্যাপক। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, প্রমথবাবুর কবিতা সঙ্কলন বের হবে ‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স’ থেকে। কিন্তু ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল প্রমথবাবুর। সেই পত্রিকার সংখ্যাটি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
‘কী কবিতা?’ প্রশ্ন নারায়ণের। নাম শুনে খানিক বিনয়ী হয়ে নারায়ণ বললেন, ‘কবিতাটা আমার মুখস্থ আছে, প্রয়োজনে লিখে নিতে পারেন।’
বিস্ময়ে হতবাক প্রমথবাবু এ বার বললেন, ‘দেখুন এত স্মৃতি ভাল নয়, ভালমন্দ সবই আপনি মনে রাখতে পারেন দেখছি।’
(৩)
আসলে ‘ভালমন্দ’— এ সব কিছু নিয়েই নারায়ণের জীবনের পথচলা। জন্ম দিনাজপুরের বালিয়াডিঙিতে, ১৯১৮ সালে (মতান্তরে ২৭ জানুয়ারি, ১৯১৭)। আদি বাস বরিশালের বাসুদেবপুরের নলচারি গ্রামে। বাবা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। মা গোলাপীবালাদেবী। দিনাজপুরের ষষ্ঠীতলায় তখন থাকেন নারায়ণের পরিবার। বাবা প্রমথনাথ পুলিশের দারোগা।
কৈশোরেই ঘটল ঘটনাটা। মেজদা শেখরনাথের প্রভাবে আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের লেখা পড়ে তখন বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে এলেন নারায়ণ। সেই সময়ের একটি স্মৃতি ছেলে অরিজিতকে প্রায়ই শুনিয়েছেন নারায়ণবাবু।
স্মৃতিটা এ রকম—
বাড়িতে প্রমথনাথ রয়েছেন। এমন সময় ‘ঠক্ ঠক্’। দরজায় পুলিশ।
‘কী ব্যাপার?’
‘সার্চ ওয়ারেন্ট রয়েছে।’
ইতিমধ্যে কোন ফাঁকে বুদ্ধি করে কিশোর নাড়ু (নারায়ণের ডাকনাম) পিস্তল-সহ যাবতীয় আগ্নেয়াস্ত্র এক থলিতে পুরে রেখে দিয়েছেন ধানের গাদায়। আর যে অফিসার সার্চ করতে এসেছেন, তিনি তাঁর মাথার টুপিটি রাখলেন সেই গাদার উপরেই। বাড়ির সকলে প্রমাদ গনলেন।
শেষমেশ অবশ্য সেই থলির নাগাল পায়নি পুলিশ। কিন্তু সে যাত্রা রক্ষা পেলেও বাবার লাইব্রেরির মগ্ন পাঠক, কৃতী ছাত্র নারায়ণের পড়াশোনায় প্রভাব ফেলল রাজনীতি।
লেখালিখিতে ব্যস্ত
দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করলেন নারায়ণ। বাংলায় নম্বর ৮৪ শতাংশ। তার পর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ। বন্ধু হিসেবে পেলেন সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র ও অচ্যুত গোস্বামীকে। তবে সময়ে আইএ পরীক্ষাটা দেওয়া হল না তাঁর। হয়তো সেই ‘রেভোলিউশনারি সাসপেক্ট’ হিসেবে অন্তরিন থাকার কারণেই। এক বছর বাদে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ ও ডিস্টিংশন-সহ বিএ পাশ করলেন তিনি।
এ বার বাক্স গুছিয়ে কলকাতা যাত্রা। উঠলেন শোভাবাজার স্ট্রিটের মেসে। কলকাতায় আসার পরে ফের পুরনো বন্ধু নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা। এখানে থাকতে থাকতেই বেরোল ‘জোনাকী’ কবিতা সঙ্কলন। কবি তিন জন— নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র এবং বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণ কালক্রমে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন এমএ-তে। পেলেন ‘ব্রহ্মময়ী পদক’।
কিছু দিন পর তাঁর বিয়ে হয় রেণুদেবীর সঙ্গে। এর কয়েক বছর বাদে ঘনিষ্ঠতা আশা সান্যালের সঙ্গে। কালক্রমে বিয়ে। জন্ম পুত্র অরিজিতের। ঘরোয়া কথায় অরিজিতের কাছে বাবা সেই মানুষ, যিনি তাঁর হাতে তুলে দেন দেশ-বিদেশের নানা বই। আরও একটি স্মৃতি উজ্জ্বল অরিজিৎবাবুর।
একদিন বেলার ঘটনা। বাবা বৈঠকখানা বাজারে গিয়েছেন। রিকশায় চড়ে ফিরছেন। সঙ্গে বাজারের থলি। ফিরতি পথে প্রিয় মানুষটিকে দেখে তাঁকে পাকড়াও করে বাড়ি আনলেন নারায়ণবাবু। এসেই সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আধঘণ্টা গল্পগুজব করব। পরের ট্রেনেই ফিরতে হবে।’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিফিল, নারায়ণের স্ত্রী আশাদেবী বললেন, ‘ওটি চলবে না, উনি ইলিশ এনেছেন খুব ভাল। দুপুরে না খেয়ে যাওয়া চলবে না।’ ইলিশের নাম শুনে খাদ্যরসিক মানুষটি থেকেই গেলেন।
খাওয়াদাওয়া শেষ। কিন্তু আড্ডা চলতে থাকল। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা চারটে, সাড়ে চারটে ছুঁয়েছে। দ্রুত চায়ে চুমুক দিয়ে এর পর বেরিয়ে পড়লেন সেই ভদ্রলোক। যাবেন শিয়ালদহ। কিন্তু নারায়ণ আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও দাদা, ও যে হাওড়ার ট্রাম।’
ভদ্রলোকটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আসলে নারায়ণবাবু চিরকালই এমন অতিথিবৎসল। আর তাই দেখা যায়, জহর রায় যখন সবে কলকাতা এসেছেন, তখনও কয়েক দিনের জন্য ঠাঁই পেয়েছেন প্রিয় দাদা আর আশাবৌদির বাড়িতে। কখনও বা বৈঠকখানার বাড়িতে ইদ সম্মেলনও আয়োজন করতে দেখা গিয়েছে নারায়ণকে। অতিথির তালিকায় আবু সয়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুবেরা।
স্ত্রী আশাদেবী ও ছেলে অরিজিতের সঙ্গে
(৪)
এমন আড্ডাপ্রিয় মানুষটি একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন, লিখেছেন সিনেমার চিত্রনাট্য। ঢুঁ দিয়েছেন সভা-সমিতি, বামপন্থী রাজনীতির অলিন্দে। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও লেখার কাজে তিনি অক্লান্ত।
লেখার ভঙ্গিমাটিও চমৎকার। ছেলে অরিজিতের মনে পড়ে, বিছানায় আধশোয়া হয়ে, বুকের নীচে বালিশ রেখে জার্মান মঁ ব্লাঁ, পেলিকান বা শেফার্ড পেন নিয়ে লেখালেখি করছেন বাবা। সঙ্গত দিচ্ছে চা আর অবিরাম গোল্ড ফ্লেক সিগারেট। ছোট ছোট মুক্তোর মতো অক্ষরে লম্বা ফুলস্ক্যাপ সাইজের কাগজের এক পিঠে লিখতে লিখতেই সৃষ্টি ‘উপনিবেশ’, ‘শিলালিপি’, ‘মহানন্দা’র মতো উপন্যাস। ‘হাড়’, ‘টোপ’, ‘ডিনার’-এর মতো অবিস্মরণীয় ছোটগল্প। ওই ভঙ্গিমাতেই সৃষ্টি হয়েছে টেনিদা চরিত্রের। আবার ‘সাহিত্য ও সাহিত্যিক’, ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’র মতো প্রবন্ধের বই, তাতেও কম যায় না নারায়ণের কলম। দ্বিতীয় বইটির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিফিল-ও পান তিনি।
আসলে জীবন থেকেই লেখার উপাদান সংগ্রহ করে গিয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।
কী রকম?
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, যাঁকে দেখে টেনিদা চরিত্রের সৃষ্টি, তিনিই জানিয়েছিলেন এমন কিছু কথা। একদিন আড্ডা চলছে। উপস্থিত প্রভাতকুমার ও নারায়ণ। এক সময় কথা প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার জানালেন, ছেলেবেলায় রোগা চেহারায় তিনি ইয়াব্বড় চ্যাং ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন বিশ্বকর্মা পুজোয়। অমনি নারায়ণ বলেন, ‘অ্যাঁ, ঘুড়ির সঙ্গে সঙ্গে আপনিও আকাশে উড়ে গেলেন!’ এই প্রসঙ্গ নিয়েই তৈরি হল ‘ঢাউস’।
আড্ডা ছাড়া নারায়ণের আরও এক নেশা— ধর্মতলা আর শিয়ালদহ থেকে দুষ্প্রাপ্য নানা রেকর্ড সংগ্রহের। এই নেশাই হয়তো পরে কাজে লেগেছিল ‘রেকর্ড’ গল্পের বয়নে।
আরও এক বার। গরুমারার জঙ্গল দিয়ে গাড়িতে চলেছেন নারায়ণ এবং দু’জন সংগীতশিল্পী। আলোচনা চলছে— হঠাৎ যদি বাঘ সামনে পড়ে, তা হলে কী হবে? যেই না বলা, অমনি রাস্তার পাশের জঙ্গল থেকে এক লাফে অন্য দিকে চলে গেলেন বাঘমামা। সে দিনের দু’জন সংগীতশিল্পী ছিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র। এই প্রসঙ্গটাই খানিক অন্য ভাবে এসেছে ‘চারমূর্তির অভিযান’-এ।
ব্যক্তিজীবনে নারায়ণের আরও একটি শখ ছিল। তা হল ভাষাশিক্ষার। স্ত্রীর বই নিয়ে নিজেই অত্যন্ত ভাল ভাবে শিখেছিলেন ফরাসি ভাষা। পর্তুগিজ ভাষা-সাহিত্য নিয়েও আগ্রহ ছিল। যার ছাপ দেখা যায় ‘পদসঞ্চার’ উপন্যাসটিতে।
মঞ্চে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র-সহ অন্যান্যরা
নারায়ণের পদসঞ্চার কিন্তু সমাজ-নিরপেক্ষ নয়। মার্কসবাদে আমৃত্যু বিশ্বাসী নারায়ণকে তাই পাওয়া যায় বাম-গণ আন্দোলনেও। কখনও বা জলপাইগুড়ির বন্যার সময় দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে শোভাযাত্রায় এগিয়ে আসেন সস্ত্রীক নারায়ণ। কনিষ্ঠ সাহিত্যিক ও ছাত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চেয়ে দেখেন, কী ভাবে এই দম্পতি চার ঘণ্টা
ধরে পায়ে হেঁটে সেই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন।
(৫)
সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজের ত্রিসঙ্গমের এই শোভাযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতেই হয়তো এল সেই দিনটা। ১৯৭০ সালের ৭ নভেম্বর। রাতের খাওয়া হয়েছে সবেমাত্র। পুত্র অরিজিৎ পাশের ঘরে বসে বাবারই দেওয়া শার্লক হোমসের গল্প পড়ছেন। এমন সময়ই মা আশাদেবীর চিৎকার, ‘বাবলু দ্যাখ, বাবা কেমন করছেন!’
বাবার ঘরে দৌড়ে গেলেন ছেলে। বাবাকে দেখেই ছুট দিলেন কাছে থাকা চিকিৎসক-সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ বাড়িতে। গেঞ্জি গায়েই এলেন কিরীটির স্রষ্টা। পরামর্শ দিলেন, ‘এখনই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।’ বেশ কয়েকটা বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরলেন অরিজিৎ। সব জায়গাতেই এক রা, ‘বেড নেই।’ পরে ভর্তি করানো হল এসএসকেএম-এ।
মহাজাতি সদনের অভিনয়ে অন্যান্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (ডান দিকে বসে)
মাত্র একটা দিন। ৮ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাঙালির প্রিয় সুনন্দ।
বাঙালির কাছে খবরটা হাহাকারের মতো। কিন্তু সুনন্দর কাছেও কি এটা আকস্মিক ছিল? বোধ হয় না। তা না হলে কী ভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর শেষ জার্নাল ‘অসুস্থ শরীরের ভাবনা’য় সুনন্দ লিখবেন, ‘অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি, পরের সংখ্যায় ‘সুনন্দের পাতাটি’ যদি না থাকে, তা হলে বুঝবেন, আর একটি কমন ম্যান বাঙালির অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।’
ফুলে ফুলে সাজানো ট্রাকে চড়ে নারায়ণ চলেছেন শেষ যাত্রায়। সঙ্গী অগণিত ছাত্রছাত্রী, সংবাদমাধ্যম, নানা পত্রিকা, সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ।
এমন মেঘলা আবহাওয়ায় আচমকা শোনা গেল, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে...’ নিজেকে সামলে কখন দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন সুচিত্রা মিত্র।
ঋণ: ‘আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ’; অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়; ‘মাস্টারমশাই’: কোরক, সম্পাদনা: তাপস ভৌমিক; ‘নন্দন’; ‘কথাসাহিত্য’; ‘নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়’: সরোজ দত্ত। ছবিগুলি অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে