পেট না কেটে-২

অপারেশনের ধকল বাঁচিয়েও বন্ধ্যত্বের সমাধান

বয়স যাই হোক, জননাঙ্গেরও কোনও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। লিখছেন গৌতম খাস্তগির। যোগাযোগ-৯৮৩০৬৬৬৬০৬মৌসুমি চক্রবর্তীর বিয়ের আগে থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। পেটে অস্বস্তি, যন্ত্রণা ও বমি বমি ভাব। আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ওভারিতে সিস্ট ধরা পড়ায় পেট কেটে সার্জারি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

মৌসুমি চক্রবর্তীর বিয়ের আগে থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। পেটে অস্বস্তি, যন্ত্রণা ও বমি বমি ভাব। আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে ওভারিতে সিস্ট ধরা পড়ায় পেট কেটে সার্জারি। বিয়ের এক বছর পরে আবার একই সমস্যা। তখন ধরা পড়ে দুটো ওভারিতেই সিস্ট রয়েছে, যার নাম এন্ডোমেট্রিওসিস। এর পর ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির ছয় মাসের মধ্যেই গর্ভবতী হন মৌসুমী। বন্ধ্যত্বের সমস্যায় পড়তে হয়নি মৌসুমিকে। হাসপাতালে মাত্র একদিন থেকেই বাড়ি।

Advertisement

সারছে বন্ধ্যত্বের সমস্যাও

Advertisement

বদলেছে আদ্যিকালের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গিও। অপারেশন মানেই লম্বা ছুটি, যন্ত্রণা, দুর্ভোগ। এক সময় এমন ব্যাপার হলেও পরিস্থিতি এখন অন্যরকম। ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির সুযোগে হাসপাতাল থেকে ১-৩ দিন-এ বাড়ি ফেরা। ছেলেদের থেকে কোনও অংশেই কম ব্যস্ত নয় মেয়েরা। তবে শারীরিক কারণে নারী একটু নরম ধাঁচেরই। কাজেই বড় অপারেশনের ফলে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায় না। ল্যাপারোস্কোপি থাকায় তা এখন অতীত। তাছাড়া বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভোগা মহিলাদের জননাঙ্গের কোনও ক্ষতি করা বা বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রয়েছে বিকল্প সমাধানও। অস্ত্রোপচার। পেটে আর ছুরি চালানোর দরকার নেই। ফালা ফালা করে কাটতেও হয় না। অপারেশনের নাম ‘কি-হোল’ এন্ডোস্কোপিক সার্জারি। একে ‘মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি’ও বলে।

ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির উদ্দেশ্য

পেট কেটে অস্ত্রোপচার না করে শরীর বাঁচিয়ে অস্ত্রোপচার হল এন্ডোস্কোপি। বহু স্ত্রী রোগ সারানো সম্ভব। একজন ডাক্তারকে নারীর শরীরে অস্ত্রোপচারের আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন রোগীর বয়স, বিবাহিত না অবিবাহিত, কটি সন্তান। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জননাঙ্গ অক্ষত ও খুঁতহীন রাখার দরকার। অবিবাহিত, সদ্য বিবাহিতা, একটি মাত্র সন্তান আছে, সন্তান চান না—প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই জননাঙ্গ বাদ দেওয়ার প্রশ্নে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে। এন্ডোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে স্ত্রী জননাঙ্গ সমূহকে অটুট রাখা সম্ভব। এই অস্ত্রোপচারে সন্তান ধারণের ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে বজায় থাকে। নারীর জননাঙ্গগুলি থেকে এমন কিছু হরমোন নিঃসৃত হয় যারা শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে যেমন, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড এবং অস্থিতে কাজ করে। এই হরমোনগুলির অভাবে নানা ধরনের উপসর্গ মহিলাটির জীবনকে দুর্বিষহ করতে পারে। কোনও কারণে অস্ত্রোপচারের সময় জননাঙ্গ বাদ পড়ে গেলে মেনোপজে যে সমস্যা আসবার কথা, তা অনেক কম বয়সেই চলে আসে। যেমন অবসাদ, ক্লান্তি, বুক ধড়ফড়, স্মৃতি বিলোপ, অনিদ্রা, বদমেজাজ, যৌন সম্পর্কে অনীহা এবং মূত্রনালীর সংক্রমণ। পেট কেটে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে এই সব সমস্যার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়ে, বন্ধ্যত্বও আসতে পারে। যেমন, ডিম্বাশয়ে সিস্ট অপসারণে পেট কেটে অস্ত্রোপচার করলে অনেক ক্ষেত্রেই চির-বন্ধ্যত্ব এসে যায়। এ ছাড়া এমন অস্ত্রোপচার সৌন্দর্যের পক্ষেও হানিকর।

এন্ডোস্কোপিক অস্ত্রোপচারেও পেটে সেলাইয়ের দাগ পড়ে না। ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচার তাই অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত।

বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ল্যাপারোস্কোপি

মেয়েদের বন্ধাত্বের একটা প্রধান কারণ ওভারিতে সিস্ট। এই সমস্যায় ল্যাপারোস্কোপিই সহজ সমাধান। পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যায় ওভারিতে কয়েকটি ছোট ফুটো করে দেওয়া হয়। আর সিস্ট থাকলে ওভারির কার্যকারিতা বাঁচিয়ে নিখুঁতভাবে সিস্ট বাদ দেওয়া সম্ভব। বন্ধ্যত্বের আরেকটি বড় কারণ ফ্যালোপিয়ান টিউবে ব্লক। যার জন্য তলপেটের সংক্রমণ বা আশপাশের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পূর্ববর্তী অপারেশনই দায়ী। ল্যাপারোস্কোপের সাহায্যে টিউবের বাধা সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। জন্ম নিয়ন্ত্রণের পরে আজকাল অনেকেই চান তা আবার খুলতে। তার কারণ মানুষের সামাজিক ও মানসিক চেতনার পরিবর্তন। অনেকেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করছেন। অথবা সন্তানের মৃত্যুর পর নতুন করে জীবন গড়ার সাহসিকতা দেখাচ্ছেন। ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে লাইগেশন করে টিউব খুলে দেওয়া সম্ভব। মেয়েদের বন্ধ্যত্বের আরেকটি কারণ এন্ডোমেট্রিওসিস। এই সমস্যায় তলপেটে রক্ত জমাট বেঁধে জননাঙ্গকে জড়িয়ে দেয়। ফলে ডিম্বানু বের হওয়া, ফ্যালোপিয়ান টিউবে ঢুকে পড়া, শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন এবং ভ্রূণের প্রতিস্থাপনে বাধা পায়। ল্যাপারোস্কোপিতে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ওভারিতে এন্ডোমেট্রিওসিস হলে যে সিস্ট হয় তাও সারিয়ে তোলা যায়। টিউমারও বাদ দেওয়া সম্ভব। পেটের ভেতরে অনেক সময় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে তাকে অ্যাডহেশন বলে। ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি স্বাভাবিক ভাবে নাড়াচাড়া করতে পারে না। ল্যাপারোস্কোপি করে এই সমস্যা ধরা যায় এবং সম্ভব হলে সেগুলিকে ছাড়িয়ে তাদের কার্যকারিতা ফিরিয়ে দেওয়া যায়।

ল্যাপারোস্কোপির সুবিধা

১) হাসপাতালে মাত্র ১ থেকে ৩ দিন থাকতে হয়। ১০ দিনের মধ্যেই কাজকর্মে ফিরে আসা যায়।

২) ল্যাপারোস্কোপির সময় অভিজ্ঞ শল্যবিদ প্রয়োজনীয় মেরামতিও করে দিতে পারেন। যেহেতু এই ধরনের সার্জারিতে যে কোনও অঙ্গকে ৪ থেকে ৪০ গুণ বা ৪০ থেকে ৪০০ গুণ বড় করে দেখা যায়, তাই ছোট্ট ঘা বা সামান্য রক্তপাতও নজর এড়ায় না।

৩) অত্যাধুনিক ল্যাপারোস্কোপি অস্ত্রোপচারে হারমোনিক স্ক্যালপেল, ডায়াথার্মি সিজার্স জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অস্ত্রোপচারে ব্যথা বেদনা ও রক্তপাত হয় না বললেই চলে।

৪) পেট না কাটায় সেলাইয়ের দাগ নেই।

৫) অস্ত্রোপচারের পরে ব্যথা, বমি, অম্বল, কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের অস্বস্তি কম হয়। সংক্রমণেরও সম্ভাবনা থাকে না।

৬) ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির খরচ ৩০ শতাংশ কম।

ল্যাপারোস্কোপির অসুবিধাও আছে

তবে ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচারে সব কিছুই যে ভাল তা নয়। অসুবিধাও আছে।

১) সবার ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়। আগে যাঁদের বহুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে শরীরের অভ্যন্তরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

২) অত্যন্ত মোটাদের ক্ষেত্রেও ল্যাপারোস্কোপিক অস্ত্রোপচার করা যায় না। অস্ত্রোপচারের সময় মাথা নীচের দিকে রাখতে হয়। স্থূল রোগীদের এতে হৃৎপিণ্ডে চাপ পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

৩) অভিজ্ঞ শল্যবিদরাও অনেক সময় অপারেশন করতে গিয়ে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে ফেলতে পারেন।

৪) পেট কেটে অস্ত্রোপচারের তুলনায় এই অপারেশনে একটু বেশি সময় লাগে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement