সারারাত ঘুমোতে পারেনি ডুগ্গু!
লাদাখ থেকে আমাকে ফোন করেছিল প্রায় তেইশবার। প্রতিবার সেই একই প্রশ্ন, ‘‘তা হলে কি আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম ড্যাডি? আমার কেরিয়ার কি শেষ হয়ে গেল?’’
প্রথম দু’এক বার ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু তার পরেও ছেলের সেই একই প্রশ্ন, ‘‘আমার কেরিয়ার কি শেষ হয়ে গেল?’’
কিছুটা ধমকে ছিলাম সে দিন।
কঠিন গলায় বলেছিলাম, ‘‘যদি ব্যর্থতা সহ্য করতে না পারো তা হলে সিনেমা করা ছেড়ে দাও। সিদ্ধান্ত যেমন নিয়েছ, তার দায়টাও তোমাকেই নিতে হবে।’’
তার পর বিরক্ত হয়েই ফোনটা সুইচ অফ রেখেছিলাম সারারাত।
পরে জেনেছিলাম, সেই রাতে একটুও ঘুমোয়নি ও। লাদাখের হোটেলের লবিতে সারারাত পায়চারি করেছিল আমার ছেলে। ডুগ্গু।
হৃতিক রোশন!
ঠিক তেরো বছর আগের কথা।
মুম্বইয়ের এক স্টুডিয়োতে ‘ম্যায় প্রেম কি দিওয়ানি হুঁ’-র বিশেষ স্ক্রিনিং দেখতে গিয়েছিলাম। পর্দায় এক দিকে হৃতিক, অন্য দিকে করিনা কপূর আর অভিষেক বচ্চন। তবু ছবিটা আমার ভাল লাগেনি। এবং, স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়েই হৃতিককে ফোন করে জানিয়েছিলাম সেই কথা।
কেরিয়ার নিয়ে তখন সত্যিই টেনশনে ও। পর পর সাতটা ছবি ফ্লপ। ইন্ডাস্ট্রিতে চালু হয়েছে নতুন রসিকতা—‘হিরো বনা জিরো’। সেই সময়েই ‘ম্যায় প্রেম কি দিওয়ানি হুঁ’-র রিলিজ। মনে আছে, স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে ওকে বলেছিলাম, ‘‘তোমার আট নম্বর ছবিটাও ফ্লপ হবে।’’
তার পরেই ওই তেইশবার ফোন। এবং, লাদাখে বিনিদ্র রজনী যাপন।
মাসখানেক আগে আবার সেই এক প্রশ্ন। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘মহেঞ্জোদাড়ো’। চতুর্দিকে সমালোচনা। কেউ লিখছে, ‘হৃতিক শেষ’, তো কেউ বলছে ‘ব্যক্তিগত জীবনে এত সমস্যা থাকলে তো এটাই হবে...’। ‘কাবিল’য়ের শেষ পর্বের শ্যুটে যাওয়ার সময়, হঠাৎ ডুগ্গু আবার জিজ্ঞেস করল, ‘মহেঞ্জোদাড়ো’ কি না করলেই পারতাম?
এ বার আমি চুপ।
কী বলব একজন অভিনেতাকে যার নতুন ছবিটা সদ্য ফ্লপ হয়েছে? শুধু বলেছিলাম—এখন যে কাজটা করছ, সেটায় মন দাও, দেখবে তুমি ঘুরে দাঁড়াবেই।
আমার কথা শুনে মুখে কিছু বলেনি, হেসেছিল শুধু।
আর সেদিনই ‘কাবিল’য়ের সেটে পৌঁছে আমি চমকে গিয়েছিলাম ওর ডেডিকেশন দেখে। একটা শট এক টেকে ওকে করেছেন পরিচালক সঞ্জয় গুপ্ত। কিন্তু তবু খুশি নয় হৃতিক।
সুতরাং, টেক, আবার টেক।
প্রায় দশটা টেকের পর খুশি হল হৃতিক। মুচকি হেসে সঞ্জয়কে বলল, ‘‘ফ্লপেরও তো ডেডিকেশন থাকে!’’
উত্তরটা শুনে আমরা দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি।
আসলে ও বাইরে এ রকমই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সব সময় নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এবং বোধহয় সেই জন্যই পর পর আটটা ছবি ফ্লপ হওয়ার পরেও ‘কোই মিল গ্যয়া’ করে সেরার সম্মান ছিনিয়ে নিতে পারে। আবার তোলপাড় করা ব্যক্তিগত সমস্যার মাঝেও নিজের সেরাটুকু উজাড় করে দিতে পারে ‘কাবিল’য়ে।
এই অদ্ভুত ছেলেটিই হৃতিক!
এ ভাবে আর পারছি না
কয়েক মাস আগের ঘটনা। খবরের কাগজ খুললেই তখন ওকে নিয়ে নানান মুখরোচক খবর। সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। বলিউডের এক জনপ্রিয় অভিনেত্রীর নিত্য নতুন অভিযোগের তির হৃতিকের দিকে। প্রতিদিনই মুচমুচে গল্পে নতুন মোড়।
মাঝে মাঝে কয়েকজন বন্ধুও ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, ‘‘হৃতিকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কি সত্যি?’’
সে রকম এক সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে থমথমে মুখে হাজির হৃতিক। মুখচোখে টেনশনের ছাপ স্পষ্ট। বোধহয় সারারাত ঘুমোতেও পারেনি। হাতে একটা স্ক্রিপ্ট। এসেই বলল, ‘‘আই অ্যাম নট হ্যাপি ড্যাডি।’’
বুঝলাম ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে। একটু হাসল। জুস-য়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘‘আমাকে ভাল কাজ করতেই হবে, ড্যাডি। এ ভাবে আর পারছি না।’’
পরের কয়েক দিন ওকে বাড়িতে প্রায় দেখিনি। বারো-তেরো ঘণ্টা করে থাকত ‘কাবিল’-য়ের সেটে। সেই টালমাটাল সময়ে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে নিজেকে শান্ত করেছিল হৃতিক।
সেই অভিনেত্রী যখন নিয়মিত মিডিয়ায় বয়ান দিচ্ছেন, এক বারও মুখ খোলেনি ও। চুপ করে থেকেছি আমরাও। এই সময়ে পরিবারের পাশে থাকাটা খুব জরুরি। এত দিন বলিউডে থাকার ফলে জানি, এখানে কী ভাবে স্রেফ স্বার্থসিদ্ধির জন্য, খবরে থাকার জন্য বিতর্ক তৈরি করা হয়।
অন্য কেউ হলে হয়তো ডিপ্রেশনে ডুবে যেত। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাত হৃতিক ওই সময়। এই ছেলেদের নিয়ে সুইমিং করতে যাচ্ছে, তো পর মুহূর্তেই আমার সঙ্গে ছবি নিয়ে আলোচনা করছে। কাজ আর পরিবারের মধ্যে ডুবে থেকে, নিজেকে সামলেছিল ডুগ্গু।
ঠিক এ ভাবেই, ব্যর্থতা থেকে বিচ্ছেদ সব সময়েই ওর পাশে থেকেছে পরিবার আর সিনেমা। সেই জন্যই, মন খারাপ নিয়েও বার বার ছুটে যায় সেট-এ। পর্দায় যতই মাচো ইমেজ রাখুক, আসলে হৃতিক ভীষণ নরম। ভীষণ ইমোশনাল!
ম্যাজিকের আশায়
হাতে ওয়াকিং স্টিক।
চোখে কালো চশমা।
মনিটরে চোখ রেখে সঞ্জয় বললেন, ‘‘হৃতিককে দেখে তো মনে হচ্ছে, সত্যিই অন্ধ।’’
‘কাবিল’য়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শ্যুট। ছবিতে এক অন্ধ হিরো-র ভূমিকায় দেখা যাবে হৃতিককে।
প্রথম যে দিন স্ক্রিপ্টটা শুনল, সে দিনই ঠিক করেছিল, ওয়ার্কশপ শুরু করার আগে, কয়েকজন অন্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। ওঁদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে, কী ভাবে প্রতিবন্ধকতা এড়িয়েও সমাজের মূল স্রোতে থাকা যায়। এবং বোধহয় সে কারণেই এক অন্ধ ব্যক্তিকে নিজের ট্রেনার হিসেবে রেখেছিল কয়েক মাস।
সহ-অভিনেত্রী ইয়ামি গৌতম-য়ের জন্য রাখা হয়েছিল আরেকজন ট্রেনার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই ট্রেনারের সঙ্গে সময় কাটাত হৃতিক আর ইয়ামি। বোঝার চেষ্টা করত, কী ভাবে চরিত্রগুলো আরও ফুটিয়ে তোলা যায়।
‘মহেঞ্জোদাড়ো’-র আগেও ঠিক এ রকম পরিশ্রম করেছিল হৃতিক। আগের ছবি ‘ব্যাং ব্যাং’ বক্স-অফিসে আশানুরূপ সাফল্য পায়নি। সুতরাং আশুতোষ গোয়াড়েকরের এই ছবিটা নিয়ে প্রচণ্ড এক্সসাই়টেড ছিল।
পরিশ্রমের কোনও মূল্য পায়নি।
বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল ছবি। কয়েক বছরের মেহনত, ধূলিসাৎ হয়েছিল কয়েক ঘণ্টায়। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, ছবির শেষ কুড়ি মিনিট ভীষণ অবাস্তব লেগেছিল দর্শকদের। তাই এই ব্যর্থতা। একটা স্বপ্নের প্রজেক্ট যে এ ভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, ভাবেনি হৃতিক নিজেও। এবং সেই কারণেই, ছবি মুক্তির দিন নিজেকে প্রায় গৃহবন্দি করে রেখেছিল।
বিকেলে দুই ছেলের সঙ্গে যখন খেলছিল, তখনও মুখে ম্লান হাসি। যেন এই মাত্র প্রিয়জনকে হারিয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনেও তো কম ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরোতে হয়নি, তবু বারবার ফিরে এসেছে ডুগ্গু। এবং সে কারণেই ওর ফ্যানেদের মতো, আরেকটা হৃতিক ম্যাজিকের আশায় যে দিন গুনছি আমিও!
‘কাবিল’-য়ে ইয়ামি গৌতম ও হৃতিক রোশন
তোমরা বেশি চিন্তা করো
পিঠের ব্যথায় কাবু। ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেটও খেলতে পারেনি বেশ কয়েক দিন। এরই মাঝে একটি ডান্স সিকোয়েন্স শ্যুট করার কথা আমাদের।
সালসা করতে হবে হৃতিককে।
সবার এক প্রশ্ন, ‘‘এই শরীর নিয়ে কি এতক্ষণ নাচবে ও?’’
আমরা যখন শিডিউল পিছোনোর কথা ভাবছি, হঠাৎ সেটে হাজির হৃতিক। আমাদের বারণ অগ্রাহ্য করে, সালসা-র স্টেপ শ্যুট করেছিল সে দিন। শট ওকে হওয়ার পর বলেছিল, ‘তোমরা বেশি চিন্তা করো, ড্যাডি!’
আসলে জীবনের ওঠা-পড়া ভাঙা গ়়ড়াগুলোকে মানতে শিখেছে ও। এবং আজকাল সে জন্যই, ব্যর্থতার পরেও নিজেই নিজেকে সামলায়।
বুড়ো বাবাকে আর মাঝরাত্তিরে তেইশবার ফোন করে না!
কথা রাখেনি শাহরুখ
তবে এত কিছুর মাঝেও ‘কাবিল’ নিয়ে সামান্য চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। তার কারণ, ওই একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে শাহরুখের ‘রইস’।
আমরা অনেক আগে থেকেই ‘কাবিল’য়ের রিলিজ ডেট ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু কিছুটা অবাক করেই সেই একই দিনে ‘রইস’য়ের রিলিজও ঘোষণা করা হল।
দিন কয়েক আগে, হঠাৎ আমার আর হৃতিকের সঙ্গে দেখা করতে এল শাহরুখ স্বয়ং। ওকে আমরা বোঝালাম, কেন দুটো বড় ছবি একই দিনে মুক্তি পাওয়াটা ইন্ডাস্ট্রির পক্ষে ক্ষতিকর। অন্য দিন মুক্তি পেলে ‘রইস’ যখন একাই তিনশো কোটির ব্যবসা করতে পারবে, সেখানে ‘কাবিল’য়ের সঙ্গে মুক্তি পেলে, দুটো ছবিরই ক্ষতি। এই আর্থিক সঙ্কটের আবহে সেটার কোনও প্রয়োজন আছে কি?
প্রথমে ওরা রাজি হলেও কথা রাখেনি শাহরুখ। একজন সিনিয়র হিসেবে শাহরুখকে ওই কথাগুলো বলেছিলাম। কিন্তু আজকাল বোধহয় সিনিয়রদের কথা না শোনাটাই নিয়ম।
তবে দেখলাম, এই নিয়ে বেশি ভাবতে রাজি নয় হৃতিক। সে দিন বলল, ‘‘এত চিন্তা কোরো না ড্যাডি।’’
ওই দুটো কথা সে দিন আমাকে স্বস্তি দিয়েছিল। তেরো বছর আগে যার ফোনে বিরক্ত হয়েছিলাম, সে-ই বলছে, ‘‘ফিকর মত করো, ম্যায় হুঁ।’’ এর থেকে বেশি আর কী’ই বা
চাইতে পারি।
এই ছেলেটিই যে আসল ডুগ্গু!
আপনাদের হৃতিক রোশন!