শান্তিনিকেতন! কবিগুরুর স্পর্শমাখা সে ভূমি যাঁদের শিক্ষাস্থল, তার প্রতাপ ছাত্রদের ছেড়ে যায় না শিক্ষা অন্তেও। অভিষেক রায়ের বাড়ির অলিন্দে পা দিতেই এই ধারণা আরও একবার মনে দানা বাঁধল। অভিষেকের পড়াশোনা শান্তিনিকেতনের নব নালন্দায়, তার পর কলাভবনে। কলকাতায় ফিরে আসার পর বেহালায় নিজের পৈতৃক ভিটেকেই বেছে নিয়েছিলেন আস্তানা হিসেবে। তার পর সেই বাড়িতে পুরনোর স্পর্শ রেখেও নতুন ঢঙে সাজাতে লাগলেন।
অভিষেকের বাড়ির বিশেষত্ব হল, ইন্টিরিয়ারে রিসাইকল-ভাবনা এবং পুরনো আসবাবে সামান্য বদল এনে তাকে নতুন রূপ দেওয়া। বাড়ির সামনের বড় বারান্দায় রোদের ছড়াছড়ি। সেখানে বাড়িতে পড়ে থাকা বাড়তি কাঠের টুকরোগুলো দিয়ে বানিয়েছেন ভারী সুন্দর এক ফ্রেম, যাতে রঙের ডিব্বাগুলো বসেছে ‘টব’ আকারে। সেখানে হাসছে ফুলগাছ, পাতাবাহার, কত কী... তাদের পাশে রবিঠাকুরের বিরাট প্রতিকৃতি।
ক্রিয়েটিভিটি তাঁর বাড়ির পরতে পরতে এবং দেশজ, আরও বিশদভাবে বলতে গেলে বাংলার নানা শিল্প এবং উপকরণের ভিন্ন-ভিন্ন রূপে ব্যবহার বাড়ি জুড়ে। বারান্দা পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই চোখ টানল ঘরের পরদা। অন্দরসজ্জার অন্যতম অ্যাকসেসারিজ। ঘিয়ে রঙের জুট কটনের পরদায় হালকা বাদামি স্ট্রাইপ। তার নীচে মলমলের পাতলা পরদা। এহেন পরদার কারণে আলো বাতাসের আসা-যাওয়ার পথ মসৃণ। বাড়ির অন্যান্য পরদাগুলোও বড় স্নিগ্ধ। কোনওটি তাঁর কলাভবনে পড়ার সময় বানানো, কোনওটি আবার নিজে এঁকে বানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, অভিষেক পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। তাই বোধহয় স্কেচ আর রং-তুলির নিবিড় সান্নিধ্য তাঁর পেশা ছাড়িয়ে জীবনযাপনের প্রতিটি স্তরকে ছুঁয়েছে।
যাই হোক, বসার ঘরে রয়েছে লো হাইটের সেন্টার টেবল, তাকে ঘিরে বেতের সোফা। তবে সবচেয়ে আকর্ষক, সোফার পাশে রাখা কাগজ ফেলার বিন। অর্ডার করে বানানো বেতের মোড়া উলটে তাকে পরিবর্তিত করা হয়েছে বিন-এ। অবশ্য তাতে বোধহয় কারও কাগজের টুকরো ফেলতেও মন চাইবে না। সেন্টার টেবলের নীচে কার্পেটের আভিজাত্য নয়, রয়েছে মাদুরের আটপৌরে চলন, যাতে অতিথির আরও আন্তরিকতা জন্মায় এ বাড়ির প্রতি। অভিষেকের কথায়, ‘‘মাদুর আর পাটি এই দুটো জিনিস খুব সুন্দর এবং আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উপযোগী। কিন্তু লোকে আজকাল এর ব্যবহার ভুলেই গিয়েছে। এগুলো কিছু দিন অন্তর পাল্টে পাল্টে ব্যবহার করা যায়, ধুলোও জমে কম।’’
ডাইনিং রুমের এক দিকের দেওয়ালে বাঁধানো রয়েছে কাঁথাস্টিচের শিল্পকর্ম। খাবার টেবলের উপরের ল্যাম্পটিকে মোড়া হয়েছে বেতের খোলসে। ডাইনিং টেবলের পাশের ট্যাপেস্ট্রি-টি অপূর্ব! কাঠের ফ্রেমের মাঝে নানা মাপের ব্লক। সেই ব্লকের ফ্রেমে কোথাও হ্যান্ডমেড পেপার, কোথাও কাঁথাস্টিচ, কোথাও টাই অ্যান্ড ডাই বা ব্লক প্রিন্ট, আবার কোনও খাপে সুতো স্পাইরাল করে আঁকাবাঁকা ভাবে জড়ানো। ঠিক যেন ছোটবেলায় ড্রয়িং খাতায় আঁকা নদীর স্রোত! চেঞ্জিং রুমের স্লাইডিং ডোরের কনসেপ্টও মনকাড়া। ইন্দোনেশিয়ান বাটিক প্রিন্টের কাপড়কে চার দিক থেকে ধরে রেখেছে একটি কাঠের ফ্রেম। তার রঙের বাহার পরিচয় করায় গৃহকর্তার শিল্পীমনের সঙ্গে।
এ বাড়ির বেডরুমটিও ভারি মিষ্টি। ঘরের মাঝে ছোটবেলায় দেখা চারটি স্ট্যান্ড দেওয়া খাট। যত্নের কারণে তার গায়ে মলিনতার আঁচড় নেই। আর তাকে নান্দনিক করেছে দু’দিক থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া মলমলের কাপড়। খাটের সামনে মাদুর, কার্পেটের মতো বিছানো। বেডরুমের ল্যাম্পশেডটি ভারি চমৎকার। মলমল কাপড় সিএফএল আলোর চারপাশ ঘিরে লম্বা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নীচের দিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কটনের কাটওয়র্কের বাড়তি কাপড়। অভিনব ল্যাম্পশেডের নীচে একটি পাত্রে ভাসিয়ে রাখা হয়েছে ফুল, যাতে খেলছে আলো।
যা কিছু পুরনো, তা যে ফেলনা নয়, অভিষেকের বাড়ি নিরুচ্চার সে কথাই বলে। সুতি, মাদুর, মাটির জিনিস, বেত... এ বাংলার খুব সাধারণ জিনিস দিয়ে সাজালেও যে একটি বাড়ি কতটা নান্দনিক হয়ে উঠতে পারে, তা সত্যিই অভিষেকের কাছে শিক্ষণীয়!
ছবি: নীলোৎপল দাস