শনিবারের নিবন্ধ ১

দীপক রতন এবং স্বপনকুমার

তিন-চার দশক ধরে এই ত্র্যহস্পর্শে উত্তেজনায় ফালা ফালা হয়েছে আবালবৃদ্ধবনিতা। লিখছেন শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।এক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ, দীপক চ্যাটার্জি পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ-গতিতে নীচে নামিয়া গেল।’’ শ্রীস্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি-রতনলালের রহস্যগল্প সিরিজের সবথেকে জনপ্রিয় বর্ণনা কিন্তু ওইটাই। ‘‘আমরা কিন্তু সেটাই গোগ্রাসে পড়তাম। গল্পগুলো যদি কখনও যুক্তি-বুদ্ধির ধার নাও ধরত, সে সব নিয়ে ভাবিইনি। বরং এক বার শুরু করলে শেষ না করে থামা যেত না,’’ বলছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ‘‘দীপক চ্যাটার্জির হাত ধরেই আরেক বিখ্যাত লেখক শশধর দত্তর মোহন সিরিজের সঙ্গে আমাদের আলাপ। সেই বিখ্যাত লাইন— কখন কেমন করিয়া কী ঘটিল বোঝা গেল না, শৃঙ্খলবদ্ধ মোহন মাঝসমুদ্রে ভাসিয়া উঠিল।’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৫ ০১:১২
Share:

এক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ, দীপক চ্যাটার্জি পাঁচতলা হইতে জলের পাইপ বাহিয়া বিদ্যুৎ-গতিতে নীচে নামিয়া গেল।’’

Advertisement

শ্রীস্বপনকুমারের দীপক চ্যাটার্জি-রতনলালের রহস্যগল্প সিরিজের সবথেকে জনপ্রিয় বর্ণনা কিন্তু ওইটাই।

‘‘আমরা কিন্তু সেটাই গোগ্রাসে পড়তাম। গল্পগুলো যদি কখনও যুক্তি-বুদ্ধির ধার নাও ধরত, সে সব নিয়ে ভাবিইনি। বরং এক বার শুরু করলে শেষ না করে থামা যেত না,’’ বলছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। ‘‘দীপক চ্যাটার্জির হাত ধরেই আরেক বিখ্যাত লেখক শশধর দত্তর মোহন সিরিজের সঙ্গে আমাদের আলাপ। সেই বিখ্যাত লাইন— কখন কেমন করিয়া কী ঘটিল বোঝা গেল না, শৃঙ্খলবদ্ধ মোহন মাঝসমুদ্রে ভাসিয়া উঠিল।’’

Advertisement

দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেটের একটা বইয়ের দোকান থেকে নিয়মিত স্বপনকুমারের বই কিনতেন সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এখনও সে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলায় কিশোরী বয়েসের উচ্ছ্বাস, ‘‘পড়িনি মানে! ভীষণ পড়তাম। স্বপনকুমার আর মোহন সিরিজ— নতুন বই বেরলেই কিনে আনতাম, কাড়াকাড়ি করে পড়া হত। অবশ্য সেটা সাময়িক উত্তেজনা। পড়ার পর বইগুলো হারিয়ে যেত বা হাতে হাতেই অন্য কোনও বন্ধুর কাছে চলে যেত। বইগুলো রেখে দেওয়ার কথা কখনও মনে হয়নি।’’

স্বপনকুমারের লেখা রহস্যকাহিনিগুলো খুঁজে পেতে এক জায়গায় জড়ো করে ‘স্বপনকুমার সমগ্র’-র প্রথম খণ্ডটা সদ্য ছাপিয়ে ফেলেছে ‘লালমাটি প্রকাশন’। সেই সুবাদে গত চার-পাঁচ বছরে দীপক চ্যাটার্জির অনেক গল্পই নতুন করে পড়ে ফেলতে হয়েছে প্রকাশক নিমাই গরাইকে। ‘‘এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে টর্চ নিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে যাওয়া বা দু’হাতে দুটো রিভলভার, বাঁ হাতে টর্চ নিয়ে দীপক, এমন বর্ণনা আমিও শুনেছি, কিন্তু পাইনি কোনও দিন,’’ হাসতে হাসতে বললেন তিনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ওই ‘পাল্প ফিকশন’ গোত্রের গল্পেরও যে একটা নিজস্ব জায়গা থাকা উচিত, সে ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ।

কিন্তু স্বপনকুমারের পাঠক হিসেবে তাঁর উত্তেজনার কারণ অন্য। ‘‘ভাবুন এক বার বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত এলাকার লোক আমি। পড়াশোনা, স্কুল সব ওখানে। বাংলা সাহিত্যের কোথায় কী ঘটছে, অত দূরে বসে জানাও সম্ভব ছিল না। কিন্তু স্বপনকুমারের নতুন কী বই বেরোল, সে খবরটা ঠিক পেয়ে যেতাম। সেই বই পৌঁছেও যেত হাতে হাতে।’’

একই কথা বললেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। আজকের মতো জেলায় জেলায় বইয়ের দোকান ছিল না তখন। কাজেই নতুন কী বই বেরোচ্ছে, সে খবর মেদিনীপুর বা জলপাইগুড়ির মতো মফস্সল শহরে বসে কেউ পেত না। কিন্তু স্বপনকুমারের চটি বই সুদূর মালবাজারেও পৌঁছে যেত, নিয়মিত! অথচ তিনি কোনও বড় প্রকাশকের ঘরের লেখক ছিলেন না। তাঁর নামে বা তাঁর বইয়ের কোনও বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ত না। কেবল কিছু বইয়ের শেষে দু-এক লাইন লেখা থাকত, স্বপনকুমারের পরের বই কী। সেইটাই ছিল পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার একমাত্র কৌশল।

স্বপনকুমারের চটি বইয়ের ধুন্ধুমার জনপ্রিয়তার আরেকটা কারণ ছিল বইয়ের মাপ। ঠিক এতটাই ছোট যে পড়ার বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রেখে পড়ে ফেলা যায়। ভাঁজ করে দিব্যি পকেটে লুকিয়ে রাখা যায়! সেই বইয়ের প্রচ্ছদে নারীচরিত্রগুলো আবার বিশেষ যত্ন নিয়ে আঁকা হত। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে নারায়ণ দেবনাথই ছিলেন প্রকাশকদের ‘ফেভারিট’। এ ছাড়া তুষার চ্যাটার্জি, শৈলেশ পাল থেকে শুরু করে বাজারচলতি অনেক জনপ্রিয় শিল্পীই ‘অলংকরণ’ করতেন। রঙিন প্রচ্ছদ, ভেতরে সাদা-কালো ছবি। কোনও কোনও প্রকাশক আবার শিরোনামের নীচে লিখে দিতেন, ‘কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’! অল্পবয়েসি স্কুলপড়ুয়ার কাছে সেটা ছিল একটা বাড়তি নিষিদ্ধ আকর্ষণ।

বাড়িতে লুকিয়ে পড়তে হত কি? বাবা-মায়েরা তো চাইতেন না ছেলে-মেয়েরা স্বপনকুমার পড়ে বখে যাক! না, সুচিত্রা ভট্টাচার্য নিজে সে ভাবে দেখেন না ব্যাপারটাকে। হ্যাঁ, হয়তো লুকিয়েই পড়তে হয়েছে কখনও, ‘‘কিন্তু ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ যখন প্রথম পড়েছি, লুকিয়েই তো পড়েছি। কাজেই সেটা বিষয় নয়। স্বপনকুমারের লেখায় সাহিত্যগুণ ছিল না, সেটা বরং আপত্তির একটা কারণ হতে পারত। কিন্তু যেহেতু পড়ার জন্য পড়া, মজা পাওয়ার জন্য পড়া, সাহিত্যগুণ নিয়ে কেউ তখন মাথা ঘামায়নি।’’

‘‘এটা নিয়ে বাবার একটা দুঃখ ছিল, জানেন?’’ বলছিলেন স্বপনকুমারের পুত্রবধূ শ্যামলী পান্ডে। শ্যামনগরের বিখ্যাত জ্যোতিষী শ্রীভৃগু-র পরিবারের বউ। বলছিলেন, ‘‘অথচ বাবা এত লিখেছেন! রহস্যগল্প ছাড়াও জ্যোতিষচর্চা, বাংলার ডাক্তারির বই, এ়ঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই, গাড়ি চালানো শেখা, সবজি চাষ, পশুপালন— এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন। অজস্র বিক্রি হয়েছে সে সব বই। বাবা না পেয়েছেন যথেষ্ট টাকা, না পেয়েছেন সাহিত্যিক হিসেবে সুনাম!’’

রহস্য সিরিজের লেখক শ্রীস্বপনকুমারই জ্যোতিষী শ্রীভৃগু। তিনিই বাংলায় ডাক্তারির বইয়ের লেখক ডা. এস এন পান্ডে। সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে। ওটাই আসল নাম। ওই নামেই ‘প্র্যাকটিস অব মেডিসিন’, ‘টেক্সট বুক অব প্যাথলজি’, ‘টেক্সট বুক অব অ্যানাটমি’ থেকে শুরু করে ফার্স্ট এড, হোম নার্সিং, অ্যালোপাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, এমনকী গাইনোকলজি, যৌনজীবন— অজস্র বই ডা. এস এন পান্ডের নামে। সব ক’টা চালু বই, বাজারে বিস্তর বিক্রি।

আরও আছে। নামে, বেনামে। প্রকাশকদের চাহিদামতো অনেক ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করে দিতেন। এমনকী শোনা যায়, তাঁকে দিয়ে এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের উপন্যাস, প্রসিদ্ধ নাট্যকারের নাটকও লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে, নামমাত্র পয়সায়। এ ছাড়া শ্রীভৃগু নামে জ্যোতিষচর্চার বই তো ছিলই। ওই পেশাটায় তা’ও কিছুটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, নাম করেছিলেন। ভাল পশার ছিল। এতটাই যে, পাশ করা ডাক্তার হয়েও বাড়ির বাইরে কোনও দিন ডাক্তারি করেননি।

‘‘বাড়িতে কারও শরীর খারাপ হলে বাবাই ওষুধ দিতেন। বাইরের ডাক্তারের কাছে আমাদের কখনও যেতে হয়নি,’’ বলছিলেন শ্যামলী পান্ডে। গরিবদুঃখীদেরও ওষুধবিষুধ দিয়ে সাহায্য করতেন। কিন্তু তাও ডাক্তারিটা পেশা হিসেবে নেননি। কারণ জ্যোতিষটা তত দিনে লেগে গিয়েছে বাজারে। লোকে শ্রীভৃগুর গণনার ওপর ভরসা করেছে।

ডাঃ পান্ডে থেকে শ্রীভৃগু হয়ে ওঠার ঘটনাটাও বেশ অবাক করা। তখনও শুধুই রহস্যগল্পের লেখক শ্রীস্বপনকুমার। প্রকাশকের কাছে গিয়েছেন পাওনা টাকা আনতে। প্রকাশক তাঁকে বসিয়ে রেখে অন্য আরেকজনের হিসেব নিকেশ করছেন। অধৈর্য হয়ে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘আরে, আমিও তো লিখি! আমাকে বসিয়ে রেখেছেন কেন!’’

উত্তরে সেই প্রকাশক নাকি বলেছিলেন, ‘‘আরে গোয়েন্দা গল্প তো সবাই লিখতে পারে। উনি জ্যোতিষের বই লেখেন, অনেক টাকার ব্যবসা দেন। ওঁকে আগে ছাড়তেই হবে। সে দিন নাকি প্রকাশকের দপ্তরে বসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, জ্যোতিষ শিখে এক দিন দেখিয়ে দেবেন। তা দিয়েও ছিলেন। নামমাহাত্ম্যে এক সময় শ্রীভৃগুরও একাধিক নকল বেরিয়ে গিয়েছিল বাজারে। সবাই বিজ্ঞাপনে দাবি করত, তারাই ‘আদি এবং অকৃত্রিম’!

‘‘অথচ কী কষ্টটাই না করেছেন সারাটা জীবন,’’ বলছিলেন শ্যামলী পান্ডে, ‘‘একটু বেশি রোজগারের আশায় দু’হাতে লিখতেন প্রায়। শিয়ালদা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে নিখরচায় আলো-পাখা পেতেন, সারা রাত ওখানেই বসে লিখে যেতেন, সকালে প্রকাশকের লোক এসে হাতে হাতে টাকা দিয়ে পান্ডুলিপি নিয়ে যেত। সে টাকা সংসারখরচের জন্য শ্যামনগরের বাড়িতে পাঠিয়ে উনি আবার লিখতে বসে যেতেন। খুব খিদে পেলে শিয়ালদা পাইকারি বাজার থেকে সস্তার কাঁচা টমেটো কিনে এনে নুন দিয়ে খেতেন।’’

আসলে সমরেন্দ্রনাথ পান্ডে, ওরফে ডা. এস এন পান্ডে, ওরফে শ্রীস্বপনকুমার, ওরফে শ্রীভৃগুর গোটা জীবনটাই খিদের সঙ্গে লড়াই। আদি বাড়ি রাজশাহী। চোদ্দো বছর বয়সে কলকাতায় আর জি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে এলেন। এক বছর পরেই বাড়ি থেকে খবর এল, সংসারে অভাব, ডাক্তারি পড়ার খরচ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। বাধ্য হয়েই কলম ধরলেন ‘শ্রীস্বপনকুমার’। লিখতে শুরু করলেন একের পর এক রহস্য গল্প। অনেক সময়ই একসঙ্গে একাধিক সিরিজ, আলাদা আলাদা প্রকাশকের জন্য।

গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির গল্পগুলো পড়লে প্রাণপণে লিখে যাওয়ার সেই তাড়নাটা প্রতি লাইনে স্পষ্ট। স্থান, কাল, পাত্র, ঘটনা বা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র যে মাথা ঘামাতেন না, সেটাও বোঝা যায়।

তাঁর লেখায় রেঙ্গুন শহর এমন ভাবে বর্ণিত হয় যে সেটা পৃথিবীর যে কোনও শহর হতে পারে। রেঙ্গুনের একটা জায়গার নাম দুম করে দিয়ে দেন ‘পিকাডেলি স্কোয়্যার’। গল্পের ভিলেন ‘বাজপাখি’-র চৈনিক শাগরেদের নাম হয় ‘ফুঁচাও’।

শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি আদৌ মনোযোগী নন। যেমন ‘‘ষষ্ঠ যে লোকটি দ্রুত পদে ঘরে প্রবেশ করল, সে আমাদের পূর্বদৃষ্ট ঢ্যাঙা লোকটি।’’ এখানে ‘ঢ্যাঙা’ শব্দটি যে বাক্যের বাকি শব্দগুলোর সঙ্গে মানানসই নয়, সেই নিয়ে স্বপনকুমার একেবারেই ভাবিত নন।

কারণ তাঁকে একটা লেখা শেষ করে নতুন আরেকটা লেখা ধরতে হবে। ‘রহস্য কুহেলিকা সিরিজ’-এর পরেই ‘ক্রাইম ওয়ার্ল্ড সিরিজ’। অথবা ‘ড্রাগন সিরিজ’ আর ‘কালনাগিনী সিরিজ’-এর দুটো গল্প একসঙ্গে।

একেকটা চল্লিশ-বিয়াল্লিশ পাতার গল্প। চরিত্রগুলো সব দৌড়চ্ছে। দ্রুত ঘটে যাচ্ছে একের পর এক ঘটনা। ধাঁ করে গুলি চালিয়ে দিল, তার পরই অপরাধীর পিছু ধাওয়া করল গোয়েন্দা, চলন্ত গাড়িতে বদলে নিল ছদ্মবেশ।

এক পাতা পর পরই হয় কেউ খুন হচ্ছে। নয়তো অপহৃত হচ্ছে। গোয়েন্দা ধরা পড়ছে ভিলেনের হাতে, আবার পরের পরিচ্ছেদেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে! গোয়েন্দা ভিলেনের হাতে ধরা পড়তে পড়তে পড়ছে না এবং এই করতে করতে এক সময় দুম করে গল্প শেষও হয়ে যাচ্ছে।

এতে আর কিছু না হোক, গল্পগুলোর মধ্যে অসম্ভব টান টান একটা থ্রিলারের উত্তেজনা তৈরি হত নিঃসন্দেহে। ‘ভারতের সেরা গোয়েন্দা’ দীপক চ্যাটার্জি হয়ে উঠতেন এক অতিমানব, কেউ কেউ বলতেন, যার সঙ্গে আর এক জনেরই তুলনা করা হয়। জেমস বন্ড! অবিশ্বাস্য ঘটনাপ্রবাহ, তীব্র গতি, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা আর কল্পনার প্রচুর রসদ।

বিলাসবহুল হোটেলের ভূগর্ভের ঘরে বসে গোপন জুয়ার আড্ডা। ঢুকতে হয় লুকনো সুড়ঙ্গপথ দিয়ে। শেষ রাস্তা়টুকু যেতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। কারণ, পথের শেষে যে দরজা, তার এমনই প্রযুক্তি, দরজা খুললেই একটা লোহার হাতুড়ি সবেগে এসে আঘাত করে অবাঞ্ছিত অতিথির মুখে। সেই আঘাত থেকে যদি কেউ বেঁচেও যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে দরজার সামনে বসানো স্বয়ংস্ক্রিয় পিস্তল থেকে (সূত্র: ‘মৃত্যুমুখে রাজেশ’/রাজেশ সিরিজ/১৯৬৩)। এই ধরনের তাকলাগানো কল্পবিজ্ঞানের মোড়কেই প়ঞ্চাশের দশকে জেমস বন্ডকে এনেছিলেন ইয়ান ফ্লেমিং। প্রায় একই সময়ে কিন্তু কলকাতায় বসে কলম ধরেছেন স্বপনকুমার।

অথচ তত দিনে আগাথা ক্রিস্টি প্রভাবিত, বিলেত ফেরত ডা. নীহাররঞ্জন রায়ের কিরীটী রায় তাঁর যাবতীয় ক্যারিশমা এবং সফিস্টিকেশন নিয়ে উঠে পড়েছেন শিক্ষিত বাঙালির বইয়ের তাকে।

তবু রহস্যপ্রিয় পাঠককুল অনেক দিন বাঁধা পড়েছিল স্বপনকুমারের হাতে। শুধু তাঁর গল্পের হিরো নয়, কখনও কখনও তাঁর ভিলেনও ন্যায়বিচারের প্রতীক। যে ইঞ্জিনিয়ার সিমেন্টে গঙ্গামাটি মেশায়, বা যে ডাক্তার ভ্রূণহত্যার মতো অনৈতিক কাজ করে, প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করে, তাদের ‘প্রাণদণ্ড’ দেয় ভিলেন। পেশাগত দায়পালনে নিরুপায় হিরো সমাজের ওই ‘শত্রু’-দের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। বাস্তবে না হোক, গল্পে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা ষাটের শেষ, সত্তরের দশকের শুরু। ফ্রন্ট স্টল থেকে হাততালি পাচ্ছেন ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’।

আর এ সবের সঙ্গে ছিল স্বপনকুমারের হুড়মুড়িয়ে গল্প বলার স্টাইল। কোথাও এক মুহূর্ত না থেমে স্রেফ একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। সুচিত্রা ভট্টাচার্য ‘দম বন্ধ করে’ পড়তেন। সমরেশ মজুমদার কবুল করেছেন, ‘‘একবার ধরলে শেষ না করে ছাড়া যেত না।’’ অন্য দিকে, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিন্তু কোনও রকম রাখঢাক না করেই বলছেন, ‘‘ভাল লাগত না, পড়তাম না। একটা-দুটো পড়েছি। খুব ‘অ্যামেচারিশ’ লেগেছে। গোঁজামিল আছে অনেক, তাই ভাল লাগেনি।’’

গোঁজামিল তো ছিলই। গোয়েন্দা গল্পের প্রাণভোমরা যেটা, ‘ডিডাকশান’, অপরাধের কাটা ছেঁড়া করে সত্যিটা খুঁজে বের করা, সেটাই কখনও থাকেনি স্বপনকুমারের রহস্যগল্পে। কিন্তু তাও লোকে গোগ্রাসে পড়েছে। গল্পগুলো নতুন কলেবরে প্রকাশিত হওয়ার সুবাদে গবেষক পাঠক হয়তো খোঁজ করবেন এক দিন, কী ছিল সেই জাদু-ফরমুলা, যা পাঁচ দশক ধরে আম বাঙালিকে চটজলদি মনোরঞ্জনের খোরাক জুগিয়েছে। বাস্তববর্জিত, ‘এসকেপিস্ট’ বিনোদনসর্বস্ব ‘পাল্প ফিকশন’ তো অনেকেই লিখেছেন, দ্বিতীয় ‘স্বপনকুমার’ কিন্তু হননি!

‘‘লেখা অন্তঃসারশূন্য হলে, লোকে সে লেখা ভাল না বাসলে কারও বই এত বিক্রি হয়! চাহিদা ছিল বলেই প্রকাশকরা ওঁকে দিয়ে অত লেখাতেন। কুড়িটা সিরিজ। কয়েকটা সিরিজে একশোর কাছাকাছি বই। আর এক জন লেখকের নাম আপনি বলতে পারবেন, যার একশোটা বই আছে? হলই বা বটতলার চটি বই, কয়েক হাজার বই ওঁর নামে। এমনি এমনি কি এটা সম্ভব?’’ বলছেন প্রকাশক নিমাই গরাই। ‘‘২০০১ সালের নভেম্বরে বাবা মারা যাওয়ার আগে খবরের কাগজ থেকে লোক এসেছিল। ছবি তুলে নিয়ে গেল, বাবার বেশ কয়েকটা বইও নিয়ে গিয়েছিল। বাবা ওঁদেরকে বলেছিলেন, টাকা-পয়সা চাই না, শুধু নামটুকু দিয়ো। বাবা খুব আশায় ছিলেন, বড় করে কিছু একটা বেরোবে, বাবাকে নিয়ে আবার আলোচনা হবে। আমাদেরকে বলতেন, হয়তো আমি দেখে যেতে পারব না, কিন্তু তোমরা তো থাকবে,’’ কথাগুলো বলে একটু চুপ করে থাকলেন শ্যামলী পান্ডে। তার পর বললেন, ‘‘কিছুই বেরোয়নি কোথাও। ভাগ্যিস বাবাকে সেটা দেখে যেতে হয়নি।’’

আর ‘সাহিত্যিক’ হয়ে উঠতে পারেননি শ্রীস্বপনকুমার। লালচে কাগজে ছাপা ‘তেজপাতা’ বই কোনও লাইব্রেরিতে রাখা হত না। প্রকাশকরা ভাবেনি, এমনকী লেখক নিজেও কোনও দিন ভাবেননি, নিজের লেখা বইয়ের স্থায়িত্বের কথা। বইয়ের কপিরাইট নিয়েও তাঁর কোনও সতর্কতা ছিল না। যখন যে যা ফরমায়েস করেছে, লিখেছেন। সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।

যা নিজের নামে ছিল, একমাত্র পুত্র বাবলা মারা যাওয়ার পর তার উত্তরাধিকার নিয়েও পারিবারিক জটিলতা আছে।

ফলে ডা. এস এন পান্ডের বাংলায় লেখা ডাক্তারির বই বা শ্রীভৃগুর জ্যোতিষচর্চার যে সব বই এখনও বাজারে আছে, তার বিক্রি যথেষ্ট হলেও রয়্যালটির টাকা অধরাই থেকে যায়।

কিন্তু স্বপনকুমারের নামে এখনও বই চলে! এ পারে নয়, ও পার বাংলায় এখনও ছদ্মবেশে গোয়েন্দাগিরি করে চলেছে দীপক চ্যাটার্জি আর রতনলাল। ‘টপ সিক্রেট’ খবরটা দিলেন সমরেশ মজুমদার। ঢাকার লোকজন এখন কলকাতার মতোই, তাঁরাও স্বপনকুমার পড়েন না। ঢাকার অদূরে কুমিল্লাতে এখনও স্বপনকুমারের গল্পগুলো ছাপা হয়, দেদার বিক্রি হয়। লোকে পড়ে আর ভালবাসে। সেটাও ঠিক আগের মতোই। কোনও বিজ্ঞাপন নেই, প্রচার নেই, তবু বই ঘোরে হাতে হাতে।

সমরেন্দ্রনাথের জন্মস্থান রাজশাহী থেকে কুমিল্লা অনেকটাই দূর। তবুও, ভাগ্যবিড়ম্বিত সাহিত্যযশপ্রার্থী এক ‘ঘরের ছেলেকে’ বাংলাদেশের কিছু লোক অন্তত মনে রেখেছে।

অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

রাজশাহীর সমরেন্দ্রনাথ

আসল নাম সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। এই পাণ্ডে পরিবারটি ছিলেন কনৌজের ব্রাহ্মণ। আদি বসতবাড়ি ছিল রাজশাহী। সমরেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯২৭-এর ২৬ অক্টোবর। বাবা, ঠাকুরদা ব্যারিস্টার। আইনজীবী পরিবারে জন্ম হলেও সমরেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার। কৈশোরেই চলে আসেন কলকাতায়। এক সময় ভর্তিও হন আর জি কর মেডিকেল কলেজে। কিন্তু অর্থাভাবে ছেড়ে দিতে হয় ডাক্তারি। এর পরই তাঁর ‘শ্রীস্বপনকুমার’ হয়ে ওঠা। বলা যায়, রোজগারের জন্যই। সমরেন্দ্রনাথ ছিলেন উদারমনা, আদর্শবান একজন মানুষ। কিন্তু তাঁর মধ্যেও তাঁর সম্মানবোধ, জেদ ছিল দেখার মতো। অনেকটা সে কারণেই এক সময় তিনি জ্যোতিষচর্চা শুরু করেন। এ নিয়ে প্রচুর বইও লেখেন। আবার অন্য দিকে রেজিস্ট্রেশন-সহ ডাক্তারও হন। তাঁর লেখা অসংখ্য ডাক্তারি বইও আছে। আছে মোটর ড্রাইভিং, ট্রানজিস্টর তৈরি থেকে সবজি চাষের বইও। এক সময় টাকা রোজগারের জন্যই মুম্বই গিয়েছিলেন ছায়াছবির চিত্রনাট্য লিখতে। সেখানে বিশেষ সম্মান বা অর্থ না পেয়ে ফিরে আসেন। অনেকে তাঁর ‘শ্রীস্বপনকুমার’ সিরিজের লেখাকে মার্কিন লেখক রবার্ট লেসলি বেলামের সঙ্গে তুলনা করেন। ২০০১ সালের ১৫ নভেম্বর মৃত্যু হয় সমরেন্দ্রনাথের।

(সংকলিত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement