COVID-19

অবিরল মৃত্যুর হাতছানি: এ কোন সময়?

দীর্ঘ সময় ব্যথাহত। বিশ্বকে এক দিক থেকে প্রায় দুমড়ে দেওয়া অতিমারির সে এক মহা বিপজ্জনক সঙ্কটকাল। যুদ্ধের বীভৎসতা থেকে কম কিছু নয়।

Advertisement

অতনু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৪৫
Share:

দৃশ্যকল্প: ‘লং অ্যান্ড শর্ট অফ ইট’ নামাঙ্কিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

দীর্ঘ সময় ব্যথাহত। বিশ্বকে এক দিক থেকে প্রায় দুমড়ে দেওয়া অতিমারির সে এক মহা বিপজ্জনক সঙ্কটকাল। যুদ্ধের বীভৎসতা থেকে কম কিছু নয়। শুধু একটি রোগ কেড়ে নিল লক্ষাধিক, আরও বেশি প্রাণ। শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আর এই প্রকোপের ভয়াবহতা আক্ষরিক অর্থে তছনছ করে গেল গোটা পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা সমস্ত রকম সফলতার বীজগুলিকে। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল সব। সেই ভয়াবহ মারাত্মক অভিঘাত সৃজনশিল্পীদের যেন ঘাড় ধরে অবগাহন করিয়েছিল বিশালকায় অন্ধকার এক দুঃস্বপ্নের কারাগারে। তবু সৃজন কি থামে? স্তব্ধ হতে পারে? সৃষ্টিসুখেরও এক রকম উল্লাস থাকে। হোক তা যন্ত্রণার, মৃত্যুচেতনার, বেঁচে থাকার তীব্র আকুতির। আর্তনাদের অন্তরালেও থেকে যায় জয়গান। থাকতে হয়।

Advertisement

তাই তো সাত জন নির্বাচিত সমকালীন শিল্পীর কাছে ‘এ এম আর্ট মাল্টিডিসিপ্লিন’-এর পক্ষ থেকে ওই দুঃসহ সময়ের প্রেক্ষিতটিকে কে কী ভাবে দেখেছেন, তা নিয়েই একটি প্রদর্শনীর কথা জানানো হয়েছিল। সদ্যসমাপ্ত ‘লং অ্যান্ড শর্ট অফ ইট’ নামাঙ্কিত প্রদর্শনীটি প্রথমে শিলিগুড়ি ইনফর্মেশন সেন্টারে, পরে অনলাইনে আয়োজিত হয়।

ওই সময়ের ‘মোদ্দা কথা’-ই শিল্পীরা তাঁদের প্রায় ৫০টির অধিক কাজে ব্যক্ত করেছেন। আর এটা করতে গিয়েই কেউ কেউ মোদ্দা কথার বিষয়টিকে হয়তো গুরুত্বই দিতে চাননি, কারণ ২০১১, ২০১৫-এ করা কয়েকটি পুরনো কাজও দেখা গেল, যা কোনও ভাবেই বিষয়ের সঙ্গে যায় না। ভাবনায় অনেকেই তার ছাপ রেখেছেন, তবে সব ক্ষেত্রে যে তা প্রত্যক্ষ ভাবে ওই অবস্থা বা সময়ের কথা ভেবে, তা একেবারেই নয়। ২০০৭-২০০৮-এর ছাপচিত্রও ছিল। ছবির সঙ্গে হয়তো জোর করে কোনও না কোনও ভাবে যন্ত্রণাবোধ বা মৃত্যুচেতনাকে মিলিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু বিচক্ষণতার সে মূল্যবোধকে তা আশাহতই করবে, সন্দেহ নেই।

Advertisement

যদি বিশেষত ‘সময় ও বিষয়কে’ ভিত্তি করে আয়োজকদের পক্ষে নির্মাণপর্বের দৃশ্যায়নকেই গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়, সেখানে অন্তত কিছু কিছু শিল্পীরও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই ভাবা উচিত ছিল।

আদিত্য বসাক বহু কাল যাবৎ মাদকাসক্তের পরিণাম ও বিবিধ যন্ত্রণাবোধের অভিব্যক্তি তাঁর সৃষ্টিতে নানা ভাবে ব্যক্ত করেছেন রং-রেখার পেন্টিংগুলিতে। বিশেষত কিছু মুখোশধর্মী মুখাবয়বের মধ্যে ভিন্ন প্রতীকী তাৎপর্য, বর্ণমালা, অক্ষরের শৈল্পিক ব্যবহার করেছেন। ঘোর কালো চক্ষুগহ্বর, উড়ন্ত চিল, পাখি, মুখের মধ্যে মানচিত্রের ছায়া-বিভ্রম, বিশ্বের নানা দেশের পতাকা... এ সবও দেখিয়েছেন। ভয়বিহ্বল কৌতূহলী আতঙ্কগ্রস্ত মুখ, সর্বত্র কালো পটভূমি— এ সমস্ত থেকেই তাঁর ছবিতে অন্তহীন এক যন্ত্রণা, মৃত্যুভয়ের আতঙ্ক ইত্যাদির এক জোরালো আবেদন লক্ষ করা যায়। মিশ্র মাধ্যম, জল রং, কালি-তুলির অসাধারণ টেকনিক ও ট্রিটমেন্ট।

জয়শ্রী চক্রবর্তী তাঁর নিজস্ব এক ধরনের স্টাইলে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন পটজোড়া বিমূর্ততার বিবিধ আঙ্গিকের মিশ্র মাধ্যমে। একটা ঝোড়ো আবহ, ব্রাশিং ও রং ছিটোনোর দ্রুত প্রয়াস, সাদা কালো ও অন্যান্য বর্ণের আপাতনম্র এক রকম অভিঘাত। তিনি কি অতিমারির যন্ত্রণাকে এ ভাবেই দেখেছেন?

ছত্রপতি দত্ত অনেক প্রখর ও মেধাসম্পন্ন এক দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন। তাঁর কম্পোজ়িশন কনটেন্টের বাস্তবতার গহীন ভাবনাটিকে সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষকে ভাবিয়েছেন ওই গভীর দর্শনে। ইঙ্ক, টি-টিন্ট, চারকোল, কন্টির ব্যবহারে তাঁর স্বল্প ব্রাউন ব্লকের ড্রয়িংগুলি অসাধারণ। এই ড্রয়িংগুলির পর্যবেক্ষণ-উত্তর মনে পড়ে ওই অমোঘ লাইন—‘দিনরাত্তির চেতনা আমাকে নির্দয় হাতে চাবুক মারে।’ অবয়বপ্রধান বা পশুপাখি-সম্বলিত ড্রয়িংয়ের অভ্যন্তরীণ স্কেলিটন, শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করা রেখা, শিঙের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, ধড়শূন্য শরীর ও কাঠামোর পড়ে থাকা ইত্যাদির আবহ তাঁর কাজকে একটা এমন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে, যেখানে দর্শক নিজেই বুঝতে পারেন এই বিশিষ্ট সামগ্রিক বিন্যাসে সময়, ব্যথাহত আশাহত অত্যাচারিতের বেঁচে থাকার অধিকারকে নৃশংসতার নখরে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে।

অতীন বসাকের পরিশ্রমী ছাপচিত্রগুলি আগে কিছু দেখা। তাঁর প্লেট মেকিং ও প্রিন্ট কোয়ালিটি— এই দু’টি পর্ব বরাবর তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা, যাতে তিনি সব সময় সেই সফলতার উত্থানকে চিনিয়েছেন। কিন্তু চড়াই, অন্যান্য পক্ষী-স্কেলিটনকে ভেঙেচুরে ব্যবহার ও রচনার আঙ্গিক, এমনকি বিভিন্ন টেক্সচার নির্মাণের প্রেক্ষিতের মধ্যেও এক ব্যথাহত ছাপ উপলব্ধি করিয়েছেন, পুরনো কাজ হলেও।

বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতটি এই যাপনকে ভয়াবহ ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়েছে এক অনির্বাণ মৃত্যুচেতনার দোরগোড়ায়। যে-সব অভিঘাত শিল্পীদের নির্মাণপর্বের মুহূর্তগুলিকে বাঙ্ময় করেছিল, নতুন সৃষ্টির প্রেক্ষাপটটিকে প্রত্যক্ষ ভাবে আলোড়িত করেছিল এক দীর্ঘ জার্নির মধ্য দিয়ে। ছত্রপতি ছাড়াও আরও যে-দু’জন তাঁদের কাজে যার সাক্ষ্যপ্রমাণ গভীর ভাবে রেখেছেন, তাঁরা অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় ও চন্দ্র ভট্টাচার্য।

অরিন্দমের গহন, কালচে, অন্ধকারাচ্ছন্ন পটভূমির মধ্যে ঘটমান দৃশ্যকল্পনায় কিছু অবয়বের, পশুর, কখনও সামান্য বিবর্তিত রূপের শরীরী বিন্যাস বড় প্রশ্ন তুলে দেয়। তিনি যে ভাবে দেখেছেন। চারকোল গ্রাফাইট প্যাস্টেলে সবটাই সাদাকালো ড্রয়িং-সদৃশ ছবি। তাঁর এই দর্শনও যেন কোথাও এক অমোঘ যন্ত্রণার কথাই বলে।

চন্দ্র ভট্টাচার্যও ওই কম্পোজ়িশনে কনটেন্টকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, আবার পরক্ষণেই অন্য গল্পে, অন্য ভাবনায় নিয়ে গিয়েছেন দর্শককে। অ্যাক্রিলিক, গ্রাফাইট, ড্রাই প্যাস্টেল, কন্টিতে তিনি কাগজের বা ক্যানভাসের টেক্সচারটিতে সূক্ষ্মতার ভিতরের আর এক সূক্ষ্মতাকে প্রকাশ করেছেন। এই নিরবচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্ট্রোক ও অন্ধকার ফুঁড়ে বেরোনো ক্ষয়িষ্ণু আলো, গাছের ডালে গজানো সাদা মাশরুম, দূরে ছোট্ট চাঁদ ও বক, মাস্ক পরা ঝুঁকে থাকা মুখ, কালো নিশ্চুপ বিহ্বল বায়স, একাকী গাছ অন্ধকারাচ্ছন্ন... বেশ চমৎকার কাজ। শ্রীকান্ত পালের বিষয়-বহির্ভূত দু’টি ছাপচিত্রও ছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement