কুলধারার স্থানীয় মন্দির। ছবি: ভাস্কর বাগচী।
সমৃতিমেদুরতা ভ্রমণেরই অনুষঙ্গ। ভ্রমণ শুধু পায়ে পায়ে নয়। মানসভ্রমণও। রাজস্থানের জয়সলমের, ভোর পাঁচটা। বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। আজ শোনাব এক রহস্যময় গ্রামের কথা। গতকালের ব্যস্ততার পর অলস ভাবে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে তাজিয়া টাওয়ারের পার্শ্ববর্তী এলাকা। আদুরে সোনার কেল্লার গায়ে সুয্যিমামার প্রথম স্পর্শ। বাসস্ট্যান্ডে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গেই বিক্রি হচ্ছে এখানকার প্রসিদ্ধ রাবড়ি। শীতভাঙা সকালে চা খেয়ে বেশ-তরতাজা মনে হল নিজেকে। মরুশহর জয়সলমেরকে হাভেলির শহরও বলা যেতে পারে। শতাধিক বছরের পুরনো অসংখ্য প্রাসাদোপম হাভেলি রয়েছে সারা শহর জুড়ে। প্রতিটি হাভেলি অসাধারণ দেওয়ালচিত্র অর্থাৎ ফ্রেসকো পেন্টিংয়ে সুশোভিত। সোনার কেল্লা বা জয়সলমের দুর্গ থেকে বেরিয়ে শহরের গলিপথে আছে কয়েকটি বিখ্যাত হাভেলি। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মরু বাণিজ্যের সূত্রে ধনবান ব্যবসায়ী পাটোয়াদের ‘পাটোয়া কি হাভেলি’, ২০০ বছর আগের অত্যাচারী দেওয়ান তথা মন্ত্রী সেলিম সিংহের ‘সেলিম সিং কি হাভেলি’ উল্লেখযোগ্য। এই সেলিম সিংহের অত্যাচারেই ৮৪টা গ্রাম এক রাতে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তাজিয়া টাওয়ারের পাশে প্রাইভেট গাড়ির স্ট্যান্ডে আলাপ হল এক রাজপুত যুবকের সঙ্গে। তাঁর গাড়িতেই আমরা মরুভূমির পরিত্যক্ত কুলধারা গ্রাম দেখে খুরি মরুগ্রামে রাত্রিবাস করব। এ বারে আসি কুলধারার কথায়।
সারি সারি ঘরবাড়ি, পাতকুয়ো, মন্দির, পাথুরে রাস্তা সবই আছে এই গ্রামে, নেই শুধু থাকার লোক। প্রায় ২০০ বছর ধরে এ ভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম। সোনার কেল্লার শহর জয়সলমের থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে।
রাজস্থান সরকারের তৈরি করা কুলধারা গ্রামের মূল দ্বার। ছবি: ভাস্কর বাগচী।
জানা যায় থর মরুভূমিতে এই গ্রামের পত্তন হয়েছিল ১২৯১ সালে। জোধপুরের পালি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা এখানে বসতি গড়েছিলেন। তাঁরা কৃষি ও ব্যবসায় সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁরা নাকি মরুভূমিতেও গমের ফলন করতে পারতেন। ৮৪টি ছোট ছোট সম্প্রদায়ভিত্তিক গ্রাম মিলেই গড়ে উঠেছিল কুলধারা নগরী। সে সময় প্রায় ১৫০০ মানুষের সমৃদ্ধ জনপদ ছিল কুলধারা। রাজস্থানের চারপাশ মরু অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কুলধারায় সমস্যা ছিল না। আবহাওয়া ও প্রকৃতি একটু ব্যতিক্রমী ছিল বলা যায়। এই অঞ্চলে শস্যের কমতি ছিল না। পালি ব্রাহ্মণরা মূলত কৃষিকাজে দক্ষ ছিল। ফলে এলাকাটি কৃষি এবং ব্যবসার জন্য বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠে সে সময়। প্রাচীন মন্দির থেকে শুরু করে নিখুঁত নকশায় বানানো বাড়ি এখনও দেখা যায়। ১৮২৫ সাল নাগাদ এক রাতেই কুলধারার অধিবাসীরা স্রেফ গায়েব হয়ে যান। কারণ অবশ্য নিশ্চিত জানা যায় না।
তবে তার পর আর কখনও নতুন জনবসতি গড়ে ওঠেনি কুলধারায়। কুলধারার আশপাশের অঞ্চলগুলো উন্নত হয়ে গেলেও একই সময়ে যেন থমকে আছে কুলধারা। বর্তমানে ভারত সরকার এই গ্রামকে হেরিটেজ নগরী হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কুলধারা গ্রামের মুখেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ক্যাকটাসের জুরাসিক পার্ক। জয়সলমের থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে লোদুর্ভার অবস্থান। জয়সলমের তৈরির আগে এখান থেকেই শাসিত হত এ অঞ্চল। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাওয়ল রাজা জয়সল লোদুর্ভা ছেড়ে জয়সলমেরে তৈরি করেন সোনার কেল্লা। পরিত্যক্ত হয় লোদুর্ভা। এই পরিত্যক্ত রাজধানীর মুখ্য আকর্ষণ প্রাচীন জৈন মন্দির ও কল্পতরু বৃক্ষ। জয়সলমের থেকে মরুভূমির মধ্য দিয়ে খুরির পথেই পড়ে উট ফসিল পার্ক। এখানে জানতে পারলাম থর মরুভূমি সৃষ্টির ইতিহাস। ১৮ কোটি বছরের পুরনো জীবাশ্ম রয়েছে সেখানে। গবেষণায় জানা গিয়েছে এক কালে থর মরুভূমি নাকি ছিল জলের তলায়!
জয়সলমের থেকে কালো পিচের রাস্তা মরুভূমির বুক চিরে পৌঁছে গিয়েছে বাড়মের হয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত শহর মুনাবাড়ের দিকে। পথে লক্ষ করলাম দু’দিকে সোনালি বালির ধুধু প্রান্তর। বালি পাহাড় আর পাথর সবই সোনালি রঙের। সেই জন্যই জয়সলমেরকে গোল্ডেন সিটি বলা হয়। পথে দেখা মিলল একঝাঁক ময়ূর ও হরিণের। গাড়ির আওয়াজে হরিণরা পলকেই অদৃশ্য হয়ে গেল বালিয়াড়ির আড়ালে। দুপুর দুটো নাগাদ পৌঁছলাম সুন্দরী মরুগ্রাম খুরিতে। রাজস্থানের প্রসিদ্ধ লোকনৃত্য কালবেলিয়া দেখলাম খুরিগ্রামে। পর দিন সকালে আর-এক চমক অপেক্ষা করেছিল। এখানে সূর্যোদয়। এই সূর্যোদয় ও পড়ন্ত বেলায় সূর্যাস্ত মনের মণিকোঠায় আজও অম্লান। সে গল্প না হয় আর-একদিন হবে।